সিডনিতে বুয়েট ৯৮ ব্যাচের বিশ বছর পূর্তি উৎসব

অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বসবাসরত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ৯৮ ব্যাচ শিক্ষার্থীদের মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

মো. ইয়াকুব আলী, সিডনি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 March 2020, 10:10 AM
Updated : 16 March 2020, 10:10 AM

রোববার সিডনির রকডেলের হাট বাজার কমিউনিটি সেন্টারে এ অনুষ্ঠানে সাবেক শিক্ষার্থীরা তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে অংশ নেন।

বুয়েটের ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রত্যেকটা ব্যাচের একটা করে শৈল্পিক নাম দেওয়া হয় আর ৯৮ ব্যাচের নাম হচ্ছে ‘পথিক’। তাই এটাকে ‘পথিকদের মিলনমেলা’ বললেও অত্যুক্তি হবে না। গত বছর অক্টোবরে বিশ বছর উদযাপনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেও শেষ মুহূর্তে স্থগিত করা হয় বুয়েটের বর্তমান ছাত্র আবরারের নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে। তখনই পরিকল্পনা নেওয়া হয় যে বিশ বছর পূর্তি পালন করা হবে পরের বছর মার্চে। তবে এবারও এসে বাগড়া দেয় করোনা প্রভাব। কিন্তু পথিকেরা করোনার ভয়কে উপেক্ষা করে রকডেলের হাটবাজারে জমায়েত হতে থাকে সেই সকাল থেকেই।

জমায়েতের শুরুতেই পথিকদের কর্মী বাহিনী কাজে লেগে গেলো। কেউ শুরু করলো মঞ্চসজ্জার কাজ, আবার কেউ শুরু করলো শব্দযন্ত্র দোতলায় তোলার কাজ। কেউ নিয়ে আসলো পথিকদের ব্যাচের লোগো সম্বলিত টি-শার্ট যার বুকের জমিনে ব্যাচের লোগো আঁকা আর পিঠের জমিনে বিশ বছর পূর্তির কথা লেখা।

কেউ নিয়ে আসলো কেক, আবার শুরু করে দিলো অনুষ্ঠান পরিচালনার পরিকল্পনা। আর এ পুরো কার্যক্রমে সহায়তা করে গেলো পথিকদের পরবর্তী প্রজন্ম। এরপর মূল কার্যক্রম শুরু হলো টি-শার্ট বিতরণের মধ্যে দিয়ে। সবাই একই টি-শার্ট পরে যখন সারা হলময় ঘুরে বেড়াচ্ছিলো তাদের দেখে মনে হচ্ছিলো তারা যেন ফিরে গেছে তাদের বুয়েট জীবনে অনুষ্ঠিত র‍্যাগ কর্নারে। বুয়েটে প্রত্যেকটা ব্যাচের বিদায়ী অনুষ্ঠানের নাম র‍্যাগ ডে, তবে এই র‍্যাগ সেই র‍্যাগ না যার কথা শুনলেই এখন অভিভাবকদের মনে আতংক তৈরি হয়।

বিশ বছর পূর্তির আয়োজন চলতে থাকুক সেই ফাঁকে আমরা ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৪ সময় থেকে একটু ঘুরে আসি। বুয়েটে উচ্চ মাধ্যমিক পাশের বছর অনুযায়ী ব্যাচের প্রাথমিক নামকরণ করা হয়। যেমন যারা ১৯৯৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে তাদের ডাকা হত ‘৯৮ ব্যাচ’ হিসেবে। যদিও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ১৯৯৮ সালে ক্লাস শুরু করা সম্ভব হয়নি। ৯৮ ব্যাচের ক্লাস শুরু হয় ১৯৯৯ সালের ২৭ অক্টোবর।

এরপর দ্রুতই সময় গড়িয়ে যায়। তখনকার দিনে বুয়েটে র‍্যাগের যে প্রচলন ছিলো তাকে র‍্যাগ না বলে পরিচয় পর্বই বলা উচিত। ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি কোন হলে ওঠার পর সেই ফ্লোরের বড় ভাইয়েরা একটা দিন ঠিক করে নতুনদের বরণ করে নেন। ফ্লোরের একটা কক্ষের দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে সারা ফ্লোরের সবাই সেখানে জড়ো হতে থাকেন। সবশেষে ডাকা হয় নবীনদের। তাদের জন্য কক্ষের মাঝখানে আলাদা চেয়ার রাখা হয় যেন তারা সেদিনের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। অবশ্য সেটাকে অনুষ্ঠান না বলে পারিবারিক আলোচনা বলাই শ্রেয়। নবীনরা আসার পর শুরুতেই তাদের পরিচয় নেওয়া হয়। এরপর শুরু হয় বারোয়ারি আড্ডা।

নবীনদের দিয়ে আড্ডাটা শুরু হলেও তা এরপর আর কোন নির্দিষ্ট গতিপথ অনুসরণ না করে চলতে থাকে তার আপন মহিমায়। সেখানে বুয়েট থেকে শুরু করে দেশ, দেশের ইতিহাস, সমকালীন রাজনীতি, বৈশ্বিক পরিস্থিতি সবকিছুই চলে আসে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে সেখানে একটা একান্নবর্তী পরিবারের আড্ডা চলছে। আপনি কোনভাবেই বুঝে উঠতে পারবেন না যে কে সিনিয়র আর কে জুনিয়র।

কিন্তু তার মধ্যেই এমন মানুষ আছে যিনি দুদিন পর বুয়েট ছেড়ে চলে যাবেন, আবার এমন মানুষ আছে যিনি বুয়েটে ভর্তি হতেয়েছেন মাস ছয়েক আগে। সেই আড্ডা শেষে সামান্য খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এই আড্ডার পরপরই জুনিয়ররা বুঝতে পারতো তারাও সেদিন থেকে এই একান্নবর্তী পরিবারের অংশ হয়ে গেলো।

এরপর সময় যতই গড়াতো হৃদ্যতা আরো বাড়তে থাকতো। বড় ভাইয়েরা ছোট ভাইদের নিজ গরজে নোটপত্র সরবরাহ করতেন এবং নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন তাদের পরীক্ষা এবং ফলাফলের। পরীক্ষার ফল খারাপ হলেই বড় ভাইয়েরা আবার বন্ধু থেকে অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে শাসনও করতেন। জুনিয়রদের টিউশনি খুঁজে দেয়া থেকে শুরু করে সব আর্থসামাজিক সমস্যার সমাধানে বড়রা সাহায্য করতেন। এমনকি অনেকের পছন্দের মানুষের সাথে বিয়ের ব্যাপারেও তারা সাহায্য করতেন।

তাই যখন পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে হল থেকে বিদায় নেয়ার মুহূর্ত হাজির হতো তখন তৈরি হতো এক আবেগঘন পরিবেশের। সেদিনও বসতো আড্ডা, কিন্তু সেটা শেষ হতো বিদায়ী বড় ভাইদের চোখ ছলছল অবস্থা দিয়ে। অনেকেই জুনিয়রদের জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করতেন যেন নিজের পরিবার ছেড়ে তারা বহুদূরে চলে যাচ্ছেন।

হল জীবনের পাশাপাশি চলতো ক্যাম্পাস জীবন। সেখানেও পড়াশোনার পাশাপাশি সব রকমের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডই চলতো পাল্লা দিয়ে। লেভেল পূর্তি, বাৎসরিক বনভোজন সবকিছুরই আয়োজন চলতো বছরব্যাপী। একসময় চলে আসতো বিদায়ের ক্ষণ। বিদায়ী ব্যাচের কর্মকাণ্ডকেও বলা হতো র‍্যাগ ডে। র‍্যাগ ডে সামনে রেখে সারা বছরব্যাপী চলতো বিভিন্ন কর্মকাণ্ড। প্রত্যেকটা হলে হলে র‍্যাগ ডে পালনের পাশাপাশি কেন্দ্রীয়ভাবেও র‍্যাগ পালনের প্রস্তুতি চলতো মহাসমারোহে।

র‍্যাগের অনুষ্ঠান শেষ হতো র‍্যাগ কনসার্টের মাধ্যমে। সেই কনসার্ট শেষেও একই আবেগঘন পরিস্থিতি তৈরি হতো। এক বন্ধু অন্য বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে যেন আর তাদের দেখা হবে না। এভাবেই পথিকদেরও মিলনমেলা ভেঙেছিলো সেই ২০০৪ সালে। তারপর পথিকেরা ছড়িয়ে গেছে বিশ্বময় তবে বাংলাদেশের বাইরে সংখ্যার দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি পথিকের বসবাস অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। তাই বিশ বছর পূর্তির এ আয়োজনকে সামনে রেখে শুরু থেকেই সিডনির পথিকেরা ছিলো আন্তরিক। প্রবাসের রুটিন জীবনের বাইরে গিয়ে কোন কিছু করাটা আসলেই ঝক্কির বিষয়। বিশেষ করে যেখানে অনেক লোকের সমারোহ হওয়ার কথা আছে, তবুও সিডনি প্রবাসী পথিকেরা তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সেটা সফল করেছে।

ফিরে আসা যাক বিশ বছর পরের সাত সমুদ্রের তের নদীর পাড়ের মিলনমেলায়। অনুষ্ঠানের শুরুতেই পথিকদের পরবর্তী প্রজন্মের কণ্ঠে পরিবেশিত হলো অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সংগীত এবং বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। তারপর বুয়েটের ছাত্রী সনি আবরার ও পথিক শিবলীর স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হলো।

এখানে উল্লেখ্য ‘পথিক ব্যাচ’ ক্যাম্পাসে থাকা অবস্থায় সনি হত্যাকাণ্ড ঘটে এবং পথিক ব্যাচই সেই আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি প্রতিবাদ জানিয়ে তখনকার সরকার এবং বুয়েট প্রশাসনের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে। আজ আবারও যখন আবরারের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তখন দেশে বিদেশে বর্তমান ছাত্রছাত্রীদের বাইরে পথিকেরাই সবচেয়ে বেশি আন্দোলন ও কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে।

পথিকদের অন্যতম সদস্য আহমেদ জাভেদ জামাল যিনি ছিলেন সনি আন্দোলনের অগ্রপথিক তিনিই আবার নিজ উদ্যোগে আবরার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বুয়েটের শহীদ মিনারে সববয়সী বুয়েটিয়ানদের নিয়ে সম্মেলন করে বুয়েটের উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন।

এরপর শুরুতেই পথিকদের পরবর্তী প্রজন্ম একে একে দারুণ সব পরিবেশনায় উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করেছে। এছাড়া পথিক এবং তাদের পরিবারবর্গের পরিবেশনাও ছিলো অনেক বৈচিত্রময় এবং মনোমুগ্ধকর। পথিকদের পরিবেশনা শেষে মঞ্চে উঠেন ৯৯ ব্যাচের মাশফিক। মাশফিক একইসঙ্গে গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। তার প্রত্যেকটা গান পথিকদেরকে আবার সেই বিশ বছর আগের কথা মনে করিয়ে দেয়।

মাসফিকের পরিবেশনা শেষে চলে খাওয়ার পর্ব। আর পাশাপাশি চলতে থাকে বাচ্চাদের ফেস পেইন্টিংসহ বিভিন্ন কার্যক্রম, যাতে করে বাচ্চারা বিরক্ত না হয়ে অনুষ্ঠান উপভোগ করেছে। দুপুরের খাওয়ার শেষে মঞ্চে উঠেন সিডনির প্রখ্যাত ব্যান্ড ‘ধূমকেতু’। ধূমকেতু ব্যান্ডের পরিবেশনা ছিলো এক কথায় অসাধারণ। তাদের প্ৰত্যেকটা গানে কণ্ঠ মিলিয়ে গেয়েছেন এবং নেচেছেন সব পথিক।  দেখে মনে হচ্ছিলো এটা যেন বুয়েট ক্যাম্পাসের ক্যাফেটেরিয়ার সামনের মাঠের সেই র‍্যাগ কনসার্ট।

সময় যে কিভাবে চলে যাচ্ছিলো সেটা টেরই পাওয়া যাচ্ছিলো না। কখন যে সকাল গড়িয়ে বিকেল আবার বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে সেদিকে কারোই খেয়াল ছিলো না। এর মধ্যেই একসময় পথিক হানির হাতের তৈরি সুন্দর এবং সুস্বাদু কেকটি কাটা হলো। এরপর একসময় মিলনমেলা শেষ হলো। সবাই যার যার বাসায় ফেরার আগে আবারও একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করে নিলো ঠিক যেমন র‍্যাগ কনসার্ট শেষে সবাই একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করেছিলো সেই ২০০৪ সালে।

এখন থেকে প্রতিবছর একটা করে পুনর্মিলনী আয়োজনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করে শেষ হলো পথিকদের প্রাণের মিলনমেলা। তখন সবারই মনের কোণে বেজে চলেছিলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত গান, ‘আয় আর একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়/ মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।’

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!