করোনাভাইরাস: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসীর দিনলিপি

গ্রাম বাংলায় একটা কথা আছে, পাগলের সুখ মনে মনে। এ কথাটার একটা গূঢ় অর্থ আছে, যেটার সহজ মানে করলে দাঁড়ায় ‘মনের সুখই প্রকৃত সুখ’।

মো. ইয়াকুব আলী, সিডনি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 March 2020, 07:17 AM
Updated : 13 March 2020, 07:17 AM

এছাড়া ছোটবেলায় পড়া রবীন্দ্রনাথের ছড়ার কথা মনে পড়ে, ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া একটা ধানের শীষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু’। অবশ্য এ কথাগুলোকে অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন সাধ্য নেই তাই সাধারণ জিনিসের মধ্যেই সুখ খুঁজে নেওয়া। সে যাই হোক, সুখের অনুভূতিটাই আসল। সেটা যেকোনোভাবেই আসতে পারে।

আমাদের সুখের অনুভূতিগুলো নিতান্তই সাদামাটা, তবে তাতে প্রাণের স্পর্শ থাকে ষোলো আনা। ভোরবেলায় শিশিরে পা ভিজিয়ে হাঁটা থেকে শুরু করে দুপুরের বৃষ্টিতে ভেজা, বিকেলের নরম আলোয় দৌড়াদৌড়ি আর রাতের বেলায় হাঁটাহাঁটি সবকিছুই আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িত। এগুলো দেখে আড়ালে মানুষ বিভিন্ন উপনামে আমাদের ডাকলেও আমরা অবিরাম এগুলো করে চলেছি।

এবার আসি গতকালের জোৎস্নাবিলাসের গল্পে। করোনাভাইরাস আতঙ্কের কারণে একটা খুবই রুঢ় সত্য সামনে চলে এসেছে। সেটা হলো মানবতা নিয়ে আমরা যতই বড় বড় গল্প ফাঁদি না কেন আধুনিক যুগে মানবতার অবস্থান আস্তাকুঁড়ে। সারা পৃথিবীতে মানুষ স্বার্থপরের মতো নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মজুদ রাখতে শুরু করেছে। আর অস্ট্রেলিয়রা স্টোর করতে শুরু করেছে স্যানিটাইজার আর টিস্যু। এর কারণ হিসেবে আমার স্কুলপড়ুয়া মেয়ে বলল, ‘বাবা কিছুদিন পর চীন থেকে এগুলো আমদানি নিষিদ্ধ করা হবে, তাই সবাই এগুলোর আগাম মজুদ শুরু করেছে।’

পাশাপাশি মুদির অনেকগুলো আইটেমও সোল্ড আউট। আমাদের পরিবারে কোন কিছুর ঘাটতি পরলে একেবারে শেষ মুহূর্তে আমরা টের পাই। আগের বাসায় থাকতে প্রতিবেশী নাজমুল ভাইয়েরা ছিলেন আমাদের জরুরি যোগানদাতা। কিন্তু এখন ছুটতে হয় শপিংমলে। তরকারি চুলায় তুলে দেওয়ার পর দেখা যায়, নুন মরিচ নেই। চায়ের পানি বসানোর পর আবিষ্কার হয় যে চা-পাতা অথবা চিনি শেষ।

পরশুদিনও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো। নুন ও চা পাতা নেই। তরকারি তখন চুলোয়। আমি আর আমার ছেলে রায়ান তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম। মিন্টো শপিংমলের উলিসে গিয়ে চা পাতা পেলেও রান্নার নুন পাওয়া গেলো না। তাই আপাতত এক কৌটা টেবিল সল্টই নিয়ে আসলাম। সেখানে একজন নারীকর্মী রিফিল করছিলো। আমি উনাকে বললাম, এগুলো আগাম মজুদ করে কোন লাভ নেই। কারণ যখন সারা পৃথিবীর মানুষ মরবে তুমি আমি আলাদাভাবে বেঁচে থাকতে পারবো না। উনিও আমার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে বললেন, ‘দিস ইস ম্যাডনেস।’ অনেক আগেই টয়লেট টিস্যু শেষ হয়ে গেছে তাই আমি আর টয়লেট টিস্যুর সারিগুলোর দিকে গেলাম না, কারণ মানুষের স্বার্থপরতার বাস্তব উদাহরণ আমি নিতে পারবো না।

বাইরে বেরিয়ে এসে পূর্ব আকাশে তাকিয়ে দেখি চাঁদমামা তার পূর্ণ যৌবন নিয়ে মিটিমিটি হাসছে। আর আমাদের দেখে ছাইরঙা মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়ছে। আমি আর রায়ান বাসায় ফিরে সদাইগুলো নামিয়ে গিন্নীকে বললাম, আমরা একটু জোছনা বিলাস করে আসি। গিন্নী মনে মনে বিরক্ত হলেও আর না করলো না, কারণ জানে একবার যখন কোনকিছু আমার মাথায় ঢুকেছে তখন সেটা আমি করেই ছাড়বো। আমরা ড্রাইভ করে আমাদের ছোট নদীর পাড়ের খোলা জায়গাটায় চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি ফ্লাডলাইট জ্বালিয়ে লোকজন রাগবি খেলছে। তাই বাধ্য হয়েই ফিরে আসতে হলো।

এরপরই মনে হলো ওয়ান মিন্টোর কিগমাউন্ট রিজার্ভের কথা। মিন্টোর নতুন এলাকার নাম দেয়া হয়েছে ‘ওয়ান মিন্টো’ আর সেখানকার রাস্তা, পার্কগুলোও অনেক গোছানো। কিগমাউন্ট রিজার্ভের বিশেষত্ব হলো এটা অনেক উঁচুতে। ওখানে গিয়ে বসলে সামনের নিচু এলাকার বাড়িগুলোর আলো দেখা যায়। আমার কাছে মনে হয় আকাশের সমস্ত তারা যেন মাটিতে খসে পড়ে মিটিমিটি জ্বলছে। ওখানে পৌঁছে দেখি পুরো পার্কে শুনশান নীরবতা। পাশের একটা বাসা থেকে কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে থেমে থেমে। অন্যান্য দিন হলে সেখানে রাতের বেলাতেও লোকে লোকারণ্য থাকতো।

রায়ান কিছুক্ষণ দোলনায় দোল খেলো আর আমি সেই ফাঁকে মেঘের ভেলায় চাঁদের ভেসে চলা দেখলাম। সূর্য ও চাঁদের আলোর মধ্যে মূল পার্থক্য হলো আপনি সূর্যের দিকে তাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিতে পারবেন না, কিন্তু চাঁদের দিকে তাকিয়ে আপনি পুরো রাত পার করে দিতে পারবেন।

রায়ানের দোল খাওয়া শেষ হলে ভাবলাম এইতো সুযোগ একটা ছোটখাটো ড্রাইভ দেয়া যায়। যেই ভাবা সেই কাজ। আমরা ড্রাইভ শুরু করলাম। এটা অবশ্য আমাদের বেশ পুরনো অভ্যাস। রায়ান যখন আরও ছোট ছিলো রাতের বেলা ওকে ঘুম পারানোর জন্য আমি ওকে নিয়ে বের হতাম আর ওর মা রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পরতো। আমরা এদিক ওদিক ড্রাইভ করে একটা জায়গায় চলে যেতাম যেখানে রাস্তাটা শেষ হয়ে গেছে। চারদিকে শুধু উঁচু বৃক্ষরাজি। যেদিক দিয়ে এসেছি সেদিক দিয়েই ফিরতে হবে। জায়গাটায় দিনের বেলা মানুষ বেড়াতে গেলেও রাতের বেলা আমাদের মতো শুধু দু’একজন পাগলেরই দেখা পাওয়া যায়৷

আমাদের বাসায় রাতে কেউ বেড়াতে আসলেও আমরা তাদেরকে এখানটায় নিয়ে আসি বেড়াতে। মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই এটা সবচেয়ে ভালো ব্যাপার। মাথার উপরে ফিনকি দেয়া জোছনা আর নিচে নীরব বৃক্ষরাজি। এ সৌন্দর্য বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নেই। আমরা শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে অনুভব করি। বনের শীতল বাতাস মুহূর্তের মধ্যে গা জুড়িয়ে দেয়। গতকাল অবশ্য সেখানে যাওয়া হলো না তার আগেই ফিরে আসতে হলো গিন্নীর তলব পেয়ে। বাসায় ফিরে দেখি আমাদের ঘরের চালার উপর দাড়িয়ে চাঁদমামা নৃত্য শুরু করে দিয়েছেন।

আমরা সবকিছু গোছগাছ করে শুরু করলাম বাংলাদেশের ব্লকবাস্টার সিনেমা ‘ঢাকা অ্যাটাক’ দেখতে। সবমিলিয়ে সিনেমাটা আমাদের ভালো লেগেছে। এমন আরো সিনেমা তৈরি হওয়া দরকার। আমাদের বাসায় বাংলাদেশের শিল্পীদের গানও বাজে সারাদিন। প্রিতম হাসানের যে কোনো গান বের হলে শুধু আমরাই কয়েক হাজারবার দেখে ফেলি। আর ছুটির দিনগুলো শুরু হয় সৈয়দ আব্দুল হাদীর দরাজ কণ্ঠ দিয়ে অথবা কখনও সুবীর নন্দী বা নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী বা লাকী আখন্দ বা একেবারে পুরোনো আমলের শচীন কর্তা বা আব্দুল আলীমকে দিয়ে। গান ছেড়ে দিয়ে আমরা আমাদের প্রাত্যহিক কাজকর্ম চালিয়ে যাই।

সিনেমা শেষ করে সবাই ঘুমাতে গেলে আমি পিছনের দরজা খুলে আস্তে করে বাইরে গিয়ে দেখি চাঁদমামা একেবারে মগডালে উঠে পড়েছেন। আমাকে দেখে বললেন ঘুমাবি না। আমি বললাম, তোমার জ্বালায় কি আর ঘুমানোর উপায় আছে, তোমার মায়াবী আলোয় মনের মধ্যে প্রেম ভাব জাগ্রত হয়েছে। ইচ্ছে ছিলো কিছুক্ষণ তোমার পাশে বসার। কিন্তু মশা তার প্রেমভাব প্রকাশ করতে শুরু করেছে, তাই এক্ষুণি ভিতরে যেতে হবে। তুমি পৃথিবী পাহারা দাও সকালে দেখা হবে।

ভোরে ঘুম থেকে উঠে নাকে মুখে তৈরি হয়ে ঘর থেকে বের হতেই দেখি চাঁদ মামা আমাকে দেখে মুচকি হাসছেন আবার। জিজ্ঞেস করলেন, কিরে ঘুম কেমন হলো? আমি বললাম, মামা ইদানিং গভীর ঘুম হয় মনে হয়, বয়স বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ। ততক্ষণে চাঁদমামার জৌলুসও ফিকে হয়ে এসেছে, কারণ পূর্ব আকাশে সূর্যিমামার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আমি বললাম, মামা ভালো থাকো।

আমি দৌড় শুরু করি। এরপর আমি মিন্টো স্টেশনের দিকে ড্রাইভ করা শুরু করলাম আর চাঁদমামা পশ্চিমের গাছগুলোর আড়ালে লুকিয়ে পরলো। আবার তার সঙ্গে দেখা হবে পরের রাতে, হবে আলাপ, হবে মান অভিমান। আপনি মানুষের পাশাপাশি যদি মহাজাগতিক কোনকিছুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেলেন তাহলে জীবন থেকে কখনওই আনন্দ উপকরণগুলো হারিয়ে যাবে না। কারণ জীবনে মানুষ বদলালেও প্রকৃতি, আকাশ, বাতাস, চন্দ্র, সূর্যের পরিবর্তন হয় না। তারা আপনাকে ঠিকই নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে যাবে যতদিন আপনি বেঁচে থাকবেন।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!