ফুজি পাহাড় চূড়ায় আরোহণের স্মৃতি

অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম ১৯ অগাস্ট ১৯৯১ এর স্মৃতির পাতা থেকে পর্বত আরোহণের অভিজ্ঞতা সবার সঙ্গে শেয়ার করব। এ কাজটা সহজ করে দিলো ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বর্তমান যুগ। ভালো লাগবে যদি সবাই উপভোগ করেন আমার অভিজ্ঞতা।

শফিকুল আলম, জাপান থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 March 2020, 08:50 AM
Updated : 5 March 2020, 08:50 AM

ছোটবেলা থেকে ফুজি পাহাড়ের নাম শুনে এসেছি। জাপান আসার পর আমাদেরই এক শিক্ষকের বিভিন্ন পাহাড় আরোহণ করার অভিজ্ঞতা আছে শুনে আমরাও ফুজি পাহাড় আরোহণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আর এ দুর্লভ মুহূর্তকে সার্থক করলাম ১৯ অগাস্ট ১৯৯১ এর ভোরবেলায়।

আমরা চার বন্ধু আমি, আখি, আহসান ও কাইয়ুম, আমাদের শিক্ষক ও উনার দুই ছাত্র মোমিন ও তপন। ১৮ অগাস্ট সন্ধ্যা ৬টায় সিনজুকু স্টেশনে সবাই মিলিত হলাম। সবার কাছেই ব্যাগ ছিল। ব্যাগে যেসব জিনিস ছিল তা হল জীবনবীমা, টর্চ, গরম কাপড়, রেইনকোট, বিভিন্ন পানীয় ও খাবার, আরও টুকটাক জিনিসপত্র। বাসে করে পাহাড়ের নবম ধাপের মধ্যে পঞ্চম ধাপে নামলাম রাত সোয়া নটায়।

রেস্ট রুমে এসে পাহাড় আরোহণ করার কাপড় পরে কিছু খেয়ে রাত ১০টায় যাত্রা করলাম। তখন চারদিক ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুধু তারা দেখা যাচ্ছিল। তখন পর্যন্ত ভাবিনি পাহাড় আরোহণ এত কষ্টকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। বেশ আরাম করে গল্পগুজব করে আমরা সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম।

পাহাড়ের মোট উচ্চতা ৩ হাজার ৭৭৬ মিটার। বাসে করে ২ হাজার মিটার (পঞ্চম ধাপ) এসেছি। আর বাকি ১ হাজার ৭৭৬ মিটার, হেঁটে পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে হবে। এ দূরত্ব পার হতে সাধারণত ৬/৭ ঘণ্টা সময় লাগে। প্রায় ২ ঘণ্টা হাঁটার পর গরম গরম ভাব লাগায় গরম কাপড় খুলে ফেললাম। আস্তে আস্তে কেমন যেন শ্বাস-নিঃশ্বাসে কষ্ট হচ্ছিল, আর অল্প হেঁটেই পরিশ্রান্ত হয়ে যেতাম। যার ফলে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলাম।

অষ্টম ধাপে এসে আবার সবার সঙ্গে দেখা হলো। তখন রাত প্রায় সাড়ে তিনটা বাজে। সবার চেহারাতে কেমন যেন ক্লান্তির ভাব। তবে তপনের অবস্থা খুব ভাল না। ওকে নিয়ে সবাই চিন্তায় পড়লাম। আমাদের সঙ্গে ৪/৫ জন বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের দেখে অবাক হলাম, ওদের বয়স ৭/৮ বৎসর। সঙ্গে ওদের মা-বাবা।

সবচেয়ে বেশি খারাপ লেগেছে অষ্টম ধাপ থেকে নবম ধাপে যেতে, কারণ এ পথটুকু ছিল খুবই খাড়া এবং বড় বড় পাথর যা ছিল অসম্ভব ভয়ংকর। একবার আমার হাতে টর্চ ছিল না, তখন এক বড় পাথরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পা ও হাত ছিলে রক্ত বেরিয়ে যায়। ভোর ৫টার দিকে অবস্থা আরও করুণ হয়ে দাঁড়ালো। দেখা যাচ্ছিল খাড়া চূড়া, ওই খানটায় উঠব আমরা।

কিন্তু এত রাস্তা পেরিয়ে যেতে যে কত কষ্ট হবে চিন্তা করে শেষ করা যাচ্ছিল না। সব আশা শেষ হয়ে গেল নিমিষের মাঝে। বারবার মনে হলো কেন যে এ দোযখখানায় এসেছিলাম, মনের অবস্থা খুবই খারাপ। পাঁচ মিনিট উপরে উঠেই বিশ্রাম, সেই সঙ্গে ঠাণ্ডা বাতাস ও শীত। সমস্ত গরম কাপড় পরেই শীত নিবারণ হচ্ছিল। পাহাড়ের চূড়া থেকে সূর্য দেখব এই প্রতাশায় তারপর কিভাবে চূড়ায় উঠেছিলাম বলতে পারব না। এখনও ভাবতে ভয় হয়।

তবে এটা সত্য যে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যেন সব ভুলে গেলাম। মনে হল কোন কষ্টই আমাদের হয়নি। চূড়ায় উঠে অনিগিরি (ভাতের তৈরি), বিস্কুট, পানীয় ইত্যাদি খেয়ে ছবি তুললাম। সব ক্লান্তি নিমিষের মাঝে দূর হয়ে গেল। উপরে গরম, শীত দুটোই লাগছিল। তবে যেটা ছিল দেখার বিষয় সেটা হল সূর্যোদয়। এমনিতেই জাপান সূর্যোদয়ের দেশ। তার উপর ৩ হাজার ৭৭৬ মিটার উপর থেকে সূর্যোদয় দেখা কজনের ভাগ্যেই বা জুটে!

হ্যাঁ, ১৯ অগাস্ট কোটি কোটি মানুষের মাঝে সবার আগে সূর্য দেখেছি ভাবলে খুব একটা খারাপ লাগে না। এত উপর থেকে নিচের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না মেঘের জন্য। সূর্যটাকে যতটুকু সুন্দর প্রত্যাশা করেছিলাম ততটুকু পাইনি এই মেঘের কারণে। সূর্য উঠার আগ মুহূর্ত পূর্বদিকে খুব সুন্দর লাল রঙের আভা ছিল। সূর্য হঠাৎ করেই যেন অসম্ভব তেজি ভাব নিয়ে উদিত হচ্ছিল। পুরো মন প্রাণ ভরে দেখলাম সূর্যটাকে। এর আগে সূর্যাস্ত এত সুন্দরভাবে উপভোগ করিনি বা সময় পাইনি।

ফুজি পাহাড়ের চূড়ায় লেখক

পুরো রাত হেঁটে চূড়ায় উঠে সূর্য দেখে সার্থক মনে হল। প্রায় তিন ঘণ্টা উপরে ছিলাম। দিনটি শনি-রোববার ছিল বলে প্রচুর ভিড় ছিল। এক সময় মানুষের লম্বা লাইন ছিল চূড়ায় উঠার জন্য। উপরে সব জাতীয় জিনিসের দাম ছিল অসম্ভব। এমনকি টয়লেট ব্যবহার করতে হয়েছে পয়সার বিনিময়ে এবং লম্বা লাইন দিয়ে, তখন আমাদের ঢাকার কথা মনে হয়ে যায়।

এবার নামার পালা। উঠার সময় যখন কষ্ট হয়েছে, নামার সময়ও তেমন কষ্ট হবে ভেবেছিলাম, এবং হলও ঠিক তাই। নামার জন্য একেবারে উপর থেকেই রাস্তা করা, কিন্তু রাস্তাটা ছিল বেশ খাড়া আর ছিল ধুলো-বালি, ছোট বড় কাঁকর। খুব সাবধানতার সঙ্গে না নামলে যে কোন বিপদ ঘটতে পারে। যেমনটা হয়েছিল মোমিনের বেলায়। নামার সময় হঠাৎ সে দৌড় দেওয়ার চেষ্টা করে এবং সফল হয়ে সে আর দৌড় থামাতে পারেনি। দৌড় থামানোর জন্য সে অন্য উপায় না দেখে বসে পরে এবং অনেক দূর পর্যন্ত পিছলিয়ে থেমে যায়। অবশ্য বেশি আঘাত পায়নি। তারপর থেকে সে আর দৌড় দেওয়ার নাম পর্যন্ত মুখে আনেনি।

আর আমরা চারজন সেই পাহাড়ের উপর থেকে পিছলিয়ে পিছলিয়ে খুবই অল্প সময়ে নিচে নেমে আসলাম। মাথায় টুপি, মুখে রুমাল, তারপরও ধুলোয় সবকিছু লাল হয়ে গেল। জুতোর অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল, যে কোন মুহূর্তে জুতার তলাটা সরে যেতে পারত। কিন্তু তা হয়নি বলে রক্ষা। পায়ের নখের অবস্থাও বেশি ভাল না। ছোট ছোট কাঁকর ঢুকায় একটু পর পরই জুতো খুলে পরিষ্কার করতে হয়েছে।

নামার সময় অসম্ভব গরম বোধ হয়েছে। আমরা মাত্র দুই ঘণ্টা ত্রিশ মিনিটে পাহাড় থেকে নেমে এলাম। সময়টা ছিল খুবই দ্রুত। আসার অনেক পর তপন ও মোমিনের সাক্ষাৎ পাওয়া গেল। না ঘুমিয়ে, ভালভাবে না খেয়ে, উঠা নামা করে চেহারাই পাল্টে গেল সবার। সেই পঞ্চম ধাপে এসে হাতমুখ ধুয়ে, খেয়ে দেয়ে, ছবি তুলে দুপুরের বাসে চড়লাম টোকিওর উদ্দেশ্যে। ঘুমাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ক্লান্ত শরীরটা ঘুমাতে নারাজ। তাই বারবার পুরনো কথা মনের মাঝে এক এক করে ভেসে আসছিল। সুখ-দুঃখের কথা ভাবতে ভাবতে একটু নিদ্রায় চলে এলাম। না কেন যেন ঘুম এলো না। বাসের অধিকাংশ যাত্রী ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়ে ঘুমোচ্ছে।

চলে এলাম সিনজুকুতে। তখন আকাশ ছিল মেঘলা। হয়ত ঘণ্টাখানেক পর বৃষ্টি পড়বে। আবহাওয়াবিদদেরও তাই ধারণা। সবাই সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে আমি ও আখি রওনা হলাম। বাসায় এসে এক লিটার দুধ ও রুটি খেয়ে সামান্য বিশ্রাম করে গোসল করলাম। মোজা জোড়া ধুতে গিয়ে ময়লা দেখে না ধুয়েই ফেলে দিলাম। গোসল করে ভাত খেয়ে ভিডিও দেখতে দেখতে সম্ভবত ৮টায় ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।

উঠলাম পরদিন ভোর ৬টায়। আখি নাকি মাঝরাতে খেয়ে আবার ঘুমিয়েছে, এখনো ঘুমোচ্ছে। আর আমি অল্প একটু হেঁটে হোমওয়ার্ক নিয়ে টেবিলে বসে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম খোদা যেন আর কখনও পাহাড় আরোহণের বার্তা নিয়ে না আসেন।

দুই-একদিন পর জানা গেল আমাদের সবাই ভাল আছে। সবারই কম বেশি হাত পা ব্যাথা ছিল। যেটা আমারও ছিল, এতকিছুর পরও এই পাহাড় আরোহণ  করাটা ছিল খুবই আনন্দদায়ক। যেটা কখনো ভাবিনি করিনি, সেটাই করে এলাম। অনেক দিন হয়ত স্মৃতির পাতায় ঝরঝরে হয়ে থাকবে। স্মৃতির বিরাট একটা অংশ ধরে রাখবে এই পাহাড় আরোহণের অভিজ্ঞতা। তেনজিং হিলারি কি করে, কত কষ্ট করেই না হিমালয়ের পর্বত জয় করেছিল।

স্মৃতি মানুষকে দুঃখ দেয়, দেয় সুখ, দেয় সাহস। আমিও সেই সাহস পেয়েছি। সত্যি জাপান এসে অনেক কিছুই পেলাম। পেলাম সময়ের মূল্য দিতে, পেলাম সাহস। তাই মাঝে মাঝে দেশের জন্য দুঃখ হয়। প্রতিটি মানুষ যদি এ দুটো জিনিস আঁকড়ে ধরে রাখতে পারত, তবে আমরাও জাপানের মতো এগিয়ে যেতে পারতাম। জাপানও তো ৩০-৩৫ বছর আগে আমাদের মতোই ছিল। জাপান ‘গামবারি মাসো’ (চেষ্টা করে যাব) দিয়েই এতদূর এসেছে। তবে কেন আমরা পারব না? ‘মিন্নাদে গামবারি মাসো’ (চলো সবাই মিলে চেষ্টা করে যাই)।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!