ভ্রমণকাহিনী: উন্নয়ন মানে উঁচু উঁচু দালান নয়

হৃদয়ের গহীনে চিনচিন করা এক অজানা আশঙ্কার টনটনে ব্যাথাটাকে সারাতে গরম আর আর্দ্রতার মাঝে নিজেদেরকে হাসিমনে সঁপে দিয়েছিলাম এই বছরের পুরো জুলাই মাসটা।

সাদেকুল ইসলামমো. , কানাডা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Jan 2020, 10:05 AM
Updated : 22 Jan 2020, 10:05 AM

গ্রামের নির্মল পরিবেশে মাটির মায়ায় সবুজের সমারোহে বেঁচে থাকা বৃদ্ধ বাবা, মাটির নীচে চিরনিদ্রায় শায়িত মায়ের পরশ পেতে, আর দেশের আনাচে কানাচে থাকা সবাইকে দেখতে নাড়ির টানে সপরিবারে গিয়েছিলাম বাংলাদেশে। ভিন্ন রকম আনন্দে কেটেছে সেইসব দিনগুলো।

ফিরে এসেই গতিময় ব্যস্ত জীবন শুরু। টরন্টো শহরে সবার ভিড়ে কর্মময় জীবন সংগ্রামে ছুটে চলায় মিশে গিয়ে ছন্দেতো বটেই, অবস্থানটা আগের মতো এখনও প্রথম সারিতেই হবে হয়ত। আত্মীয় পরিজন ছাড়া মাতাপিতা নির্ভরশীল ছোট ছোট বাচ্চাদের সামলিয়ে জীবন ও জীবিকার জন্য কাজের মাঝে প্রচণ্ড ব্যস্ততা বলেই এই এগিয়ে থাকাটা। তবু এর মাঝেই খুঁজে নিতে হয় এতটুকু অবসর।

বরফের দেশে গ্রীষ্মকালটা জনজীবনের জন্য প্রকৃতির এক বিশাল উপহার।সেটা দেশে কাটিয়ে কানাডায় এসে অবসরের জন্য তাকিয়ে থাকতে হয়েছিল ডিসেম্বরের শেষ তৃতীয়াংশে। কর্মজীবীদের প্রায় এক সপ্তাহ ছুটি। আর স্কুল বন্ধ থাকে দুই সপ্তাহ। গত বছর ২০১৮ এর ক্রিসমাসের দিনে গাড়ি হাকিয়ে ৮০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছি। মেরিল্যান্ডে বাংলাদেশি জিনিয়াসদের কাছাকাছি গিয়েছি। তাই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মিশিগানে বসবাসকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু ডক্টর আশরাফের নিমন্ত্রণে সাড়া দিতে পারিনি।

আশরাফের প্রাণোচ্ছল হাসি

টরন্টোতে এবার নভেম্বরেই অনেক বেশি তুষারপাত হলো। ডিসেম্বরের শুরুতেও। আর তাপমাত্রা কখনো মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মাঝে মাঝে হঠাৎ তাপমাত্রায় অসামঞ্জস্যতা। হিমাঙ্কের অনেক নিচে থেকে উঠে হয়ে যায় ৫-১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

চারদিকে জমে যাওয়া বরফ পরিষ্কারের ঝামেলা তখন না থাকলেও মানব শরীর কিছু প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারায়। আবহাওয়ার এই হেঁয়ালি খেলার মাঝেই দারুণ উৎসাহ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যাবো এবার মিশিগান। দেখবো আলোক ঝলমলে ডেট্রয়েটসহ আরো সব দর্শনীয় স্থান। সঙ্গে থাকবে সদা কৌতুহলী সন্তানেরা। এদের হাজারো প্রশ্নের উত্তর আমি সবসময় দিতে পারি না। নিতান্তই কম জানি তাই। আগ্রহের কমতি নেই যদিও।  

দুই.

যাত্রার জন্য পূর্ব পরিকল্পনায় সেই ক্রিসমাসের দিনটাকেই বেছে নিয়েছি। দূর-দূরান্তের ভ্রমণপিয়াসু মানুষেরা যখন গন্তব্যে পোঁছে কাছের মানুষের সঙ্গে ক্রিসমাসের ছুটির বিনোদনে থাকবে, ফাঁকা রাস্তায় আমরা তখন নির্বিঘ্নে এগিয়ে চলবো। সুভেনির কেনাকেটা আর সব প্রস্তুতিতে আগের দিনটা কেটেছে আরামহীন। রাতের ঘুমটাও এসেছে দেরিতে।

সকাল সাড়ে ১০টা। কয়েকটি ব্যাগে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পুরে তা গাড়িটায় উঠালাম। গাড়ি ওয়ার্ম আপ করতেই মনের আশঙ্কাটা সত্যি হলো। ইঞ্জিনে বার্ন হয়ে উদ্ভুত অপ্রয়োজনীয় গ্যাস বেরিয়ে যাবার পাইপে একটু ত্রুটি। শীতের লবণাক্ত এই পরিবেশে ধাতব লম্বা পাইপটা কিছুটা ক্ষয়ে একটা ছিদ্র হয়েছে। বরফের দেশ এটা, পিচ্ছিল রাস্তায় প্রচুর পরিমাণে লবণ ছিটানো হয়। লবণ করোসিভ মেটারিয়াল। 

কানাডার উন্ডমিল

দমে যাইনি। ওটা যাত্রায় অশুভ কোন কিছু নয়। দ্রুই সিদ্ধান্ত হলো টয়োটার ছোট গাড়িটাই নেয়া হবে। মোটরগাড়ির এক নির্ভরতার প্রতীক জাপানের টয়োটা। জ্বালানি খরচও কম। ঘড়ির কাটায় বেলা ঠিক ১১টা। যাত্রা শুরু। স্কারবোরোর পূর্ব সীমানা। পাঁচজনের দল। বাবা-মার সঙ্গে কৌতুহলী তিন সন্তান, এতে স্কুল বয়সী দুই বোন আর তাদের 'খুকু' লিটল ব্রাদার ইহান। সর্বকনিষ্ঠ এই সদস্যর একমাত্র কাজ বাড়িঘর এলোমেলো করা। বোনদের ভাষায় 'ইহান ডাজ লট অফ খুকু বিজিনেস'।       

আমার স্ত্রী ইভা এই পরিবারের 'হোম মিনিস্টার'। সবকিছুতে তার সিদ্ধান্তই ফাইনাল। কিন্তু হাসবেন্ড সঙ্গে থাকলে সে চালকের আসনে বসবে না। বরাবরের মতো তাই আমিই মূল চালক। টরন্টোয় সেদিন বিরল কুয়াশা। তুষারপাত হয়নি। হাইওয়ে ৪০১ এর নরম হৃদয়ের শক্ত বুক চিরে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। মিসিসাগা শহরকে অতিক্রম করতেই দেখলাম রাস্তায় প্রচুর গাড়ি। ফাঁকা না। পরিকল্পনায় থাকা নিজের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করলো।

যে কোন কিছু করার আগে উপযুক্ত পরিকল্পনা দরকার। সুফল পাওয়া যায়। আজ হচ্ছে না। লন্ডনের আগে ও পরে দুইবার বিরতি। লোকালয়ে সব দোকানপাট বন্ধ। ভরসা শুধু টিম হরটোন, আর অনরাউট। নর্থ আমেরিকায় মানুষেরা বড়ই অদ্ভুত। কফি তৈরিতে বাসায় দুই মিনিট সময় নষ্ট করা যাবে না, কিন্তু টিম হরটোনের এক কাপ কফির জন্য লম্বা লাইনে সময় ব্যয় করে এরা আনন্দ পায়।

মজার বিষয়টা ভিন্ন রকম। কেউ ভ্রমণে মজা পায়, কারো কাছে এটা অসহ্য। কফি ছাড়াই ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি গাড়ি চালাতে পারি, আর ইভা চলন্ত অবস্থায় স্টিয়ারিং হুইল হাতেই একদিন ঘুমিয়ে পড়ে। কারণটা অবশ্য বের করেছি। সে একজন মা। পাইরোফোরিক (অতিমাত্রায় দাহ্য) সব জটিল যৌগের গুণাগুণ এনালাইসিস শেষ করে অফিস থেকে ফিরে বাসায়ও সব কাজ সামলায়। রান্নার কাজ, বাচ্চাদের পড়ানো, ওদের বিনোদন সবকিছুতে সে।

মাঝে মাঝে ভাবি সে একজন রোবট। বিধাতা নিজ হাতে অনেক যত্নে বিশেষ গুণাবলী দিয়ে তাকে তৈরি করেছেন। বিধাতাকে ধন্যবাদ, গুণী এই নারীকে আমার জীবনে জুড়ে দিয়েছেন।

কানাডা আর যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বের হাত 'এম্বাসাডর ব্রিজ'

লন্ডন অতিক্রম করে সোনালী রোদের নরম ছোঁয়ায় সুন্দর প্রকৃতিকে উপভোগ করছি। উদাস মনে তখন বাকের ভাইয়ের প্রিয় গান 'হাওয়া মে উড়তা যায়ে'। হুমায়ূন আহমেদ স্যারকে খুব মনে পড়ে। তিনি একজন রসায়নবিদ। নিজেও। অথচ বাংলাভাষীদের জন্য কী রসটাই না তিনি দিয়ে গেছেন। সহজ কথাকে অতি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে সাহিত্যের সংজ্ঞাকে তিনি বদলে দিয়েছেন।

প্রচণ্ড ঝড়ের মতো ঘণ্টায় ১০০-১১৫ কিলোমিটার গতিতে হাইওয়ে ৪০১ দিয়ে পশ্চিমে এগিয়ে যাচ্ছি। এখানে গতির বৈধতা সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার। বেশিতে টহল দেয়া পুলিশের টিকিট আর শাস্তি। শাস্তির মাত্রা নির্ভর করে অপরাধের পরিমাণের উপর, গতি কতো বেশি, মাদকাগ্রস্ত কিনা, সঠিক নিয়মে চলেছে কিনা ইত্যাদি। সাধারণত ১০-১৫ কিলোমিটার বেশিকে পুলিশ ছাড় দেয়।

গাড়ির বেশি গতিতে পুলিশি সমস্যা থাকলেও বাতাসের গতি কিন্তু সভ্যতার উন্নয়নে সাহায্য করে। বিজ্ঞানের অবদান। এই হাইওয়ের বরাবর প্রায় ১০০ কিলোমিটার রাস্তার দুই দিকে সুবিশাল এলাকা রিজটাউন থেকে তিলবুরি হয়ে প্রায় উন্ডজর পর্যন্ত কানাডার সর্ববৃহৎ 'উইন্ড ফার্ম' এর বিস্তৃতি। শত শত উইন্ডমিলের মাধ্যমে বাতাসের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে এখানে।

ওন্টারিও প্রদেশে বিদ্যুৎ চাহিদার প্রায় ৮-১০ ভাগ বাতাসের শক্তি থেকে আসে। কানাডায় প্রায় তের হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় এই বাতাস থেকেই। এটা ক্লিন এনার্জি। কয়লা পুড়িয়ে প্রাকৃতিতে কার্বনডাইওক্সাইড ছড়িয়ে দেয়া নয়। নিউক্লিয়ার শক্তি পেতে প্রকৃতিতে তার বিষাক্ত বর্জ্য মিশিয়ে দেয়াও না। ক্লিন এনার্জি বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার সমস্যাতে এক বিশাল আশীর্বাদ।

উন্ডজরে যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় বেলা ৪টা। এটা কানাডার সীমান্ত শহর। বেশ বড়। এখানটায় ঘুরে দেখতে এক ঘণ্টার বিরতি। তিয়াসকে ফোন দিলাম। দেখা করে তাকে নিয়ে উন্ডজরটা ঘুরে দেখবো এই আশায়। বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি, তাই সে মামার কাছে ওন্টারিওর লন্ডনে। এবারও দেখা হলো না। বুয়েটের মেধাবী এই ছাত্র এখন উন্ডজর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কলেজের প্রিয় ইংরেজি শিক্ষক তৌহিদ স্যারের ছেলে এই তিয়াস। যদি কেউ না আসে তবে একলা চলো রে। অন্য কাউকে সেখানে না পেয়ে আমরাই সেই শহরকে ঘুরে ঘুরে দেখলাম।

এই শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ডেট্রয়েট নদী। ‘লেক এরি’ ও ‘লেক সেন্ট ক্লেইর’ সংযোগ করেছে এই নদী। নয়নাভিরাম দু’পাশের দৃশ্য। এপার থেকেই দেখলাম নর্থ আমেরিকার ব্যস্ততম আন্তর্জাতিক ক্রসিং 'এম্বাসাডর ব্রিজ'। প্রায় একশ বছরের পুরনো এ ব্রিজের দৈর্ঘ্য ২.৩ কিলোমিটার। একদিকে কানাডার বাণিজ্যিক শহর উইন্ডজর আর অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েট। দুই দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখছে। দুই পাশের এ দুই শহরই নিজ নিজ দেশের জন্য গাড়ির রাজধানী বলে পরিচিত। নান্দনিক সৌন্দর্য আর বাণিজ্যিক গুরুত্বের কারণে প্রতিদিন প্রচুর পর্যটকের আনাগানা এখানে।

রেনাইসান্স সেন্টারের আলোক ঝলকানিতে

গবেষণার প্রতি আগ্রহের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেখার নেশাকে দমাতে না পেরে গেলাম উন্ডজর বিশ্ববিদ্যালয়েও। ভালো বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ থেকেও অনেক ছাত্র-ছাত্রী এখানে পড়তে আসে। স্কুল বয়সী নাবিহা আর নাশিতা বেশ উৎসাহ নিয়ে এই ক্যাম্পাসেও ছোটাছুটি করলো। এর আগে তারা টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক জায়গায় ঘুরে উচ্চশিক্ষার ধারণা নিয়েছে। এক বছর আগে দেখে আসা সেই বিশ্বখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘এনআইএইচ’ এর স্মৃতি এতটুকু ভুলেনি।

তিন.

সবার মাঝে কিছুটা ক্লান্তির ছাপ। ছুটির দিন হওয়ায় সেই টিম হরটোনই মূল ভরসা এখানেও। ফ্রেশ হয়ে কফি, ডোনাট, টিমবিট নিলাম। তারপর 'এম্বাসাডর ব্রিজ' পেরিয়েই মিশিগানের ডেট্রয়েটে ইমিগ্রেশন। এক মিনিটে পাসপোর্ট চেক করে অফিসার বললেন 'এনজয় দ্য হলিডেজ ইন আমেরিকা'। সূর্য ডুবে ততক্ষণে বেশ আঁধার নেমেছে। রাতের এ অন্ধকারে চারদিকে লাখো লাখো বাতির আলোক ঝলকানিগুলোকে মিশিগানে আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা বলেই মনে হলো।

হাইওয়ে ৭৫ দিয়ে এগিয়ে আরো পঁচিশ মিনিট পর রিভারভিউ শহরে গন্তব্যে পোঁছতেই বন্ধু আশরাফের কণ্ঠ। 'আইছস তোরা, আয় আয়'। সে তো বটে, তাঁর কয়েক জেনারেশন ঢাকায়। ঢাকাইয়া পোলা। আভিজাত্য আর সুশিক্ষায় শিক্ষিত পরিবারে বড় হয়েছে। রিভারভিউতে এ আবাসিক এলাকায় বাড়িগুলো অনেক বড়। তার বিশাল বাড়ির সামনে বিশেষ লাইটিংগুলো ভাবির পরামর্শে আমাদের জন্যই সেট করা হয়েছে হয়ত।

খাবারের বিশাল আয়োজন। মা ও শাশুড়িকে নিয়ে ভাবির বিরামহীন কষ্টের ফসল সেগুলো। খাওয়া আর আড্ডা শেষে বেরিয়ে পড়লাম রাতের ডাউনটাউন ডেট্রয়েট দেখব বলে। দুই গাড়িতে দুই পরিবারের সবাই। মধ্যরাতের কাছাকাছি হলেও রেনাইসান্স সেন্টারে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। ক্রিসমাসের জন্য বাড়তি এই ভিড়। যে দিকে তাকাই দেখি ভিন্ন ভিন্ন সব আলোকসজ্জা।

রেনাইসান্স সেন্টারের সব আকাশচুম্বী বিল্ডিংগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত গাড়ি কোম্পানি ‘জেনারেল মটরস’ এর। অনেকগুলো রাস্তার মিলনমেলার আইল্যান্ডে বড় আইসরিংকটা প্রধান আকর্ষণ। সব বয়সের ছেলেমেয়েরা সেখানে স্কেটিং করছে। সবার মাঝে আনন্দ।

সীমাহীন আনন্দ সঙ্গে নিয়ে বাসায় ফিরি। অন্য সবাই ঘুমিয়ে পড়লে বাকি রাতভর দুই বন্ধুর জমিয়ে আড্ডা। আর গল্প। পরদিন স্বভাবতই দেরিতে ঘুম থেকে উঠা। দুই বছর বয়সী আয়াত আর ইহানের সারা বাড়িময় পদচারণা। আর খেলনা নিয়ে ঠুকাঠুকি। টম অ্যান্ড জেরি যেন। রিভারভিউ শহর থেকে বেরিয়ে সকালটায় কাছের ট্রেনটন শহর আর ‘গ্রজ এল আইল্যান্ড’ দেখে এলাম।

ট্রেনটনকে ঝিমিয়ে পড়া মনে হলো। হাজার হাজার কর্মজীবী মানুষের কোলাহলে পূর্ণ কাজের জায়গাটায় আজ সুনসান নিরবতা। বিল্ডিংগুলো পড়ে আছে মৃত্প্রায়। বড় একটি হাসপাতালও। মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে মাত্র দুটি ব্রিজ দিয়ে কানেন্টেড গ্রজ এল আইল্যান্ডটায় তিন-আট হাজার বর্গফুটের সব বড় বড় বাড়ি। সবকিছু গোছানো। অতি সুন্দর।

ফ্রানকেনমুথ শহরে হাস্যোজ্জ্বল মানুষেরা

পরে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত অন্যরকম ভালো সময় কাটলো বহুদূরের জার্মান অধ্যুষিত ফ্রানকেনমুথ শহরে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্রিসমাস অন্ডারল্যান্ড সেখানে। দুই ঘণ্টার এই দূরের পথের কথা আগাম উল্লেখ না করে বুদ্ধিমান বন্ধু আমাদেরকে সেখানে নিতে শুধু 'সুন্দর' কথাটা বলেছিল। ফ্রানকেনমুথ শহরে মেধাবী প্রকৌশলীদের গড়া সুন্দর কারুকার্যে ভরা সবকিছুতে তাকিয়ে মন ভরে যায়। যে দিকে তাকাই দেখি পর্যটকদের ভিড়। রাতে নানা রঙের আলোক সজ্জায় কী সুন্দরই না লাগলো এই শহরকে! এত ঠাণ্ডার মাঝে অনেক ঘোড়াগাড়িও সেখানে।

সবার মাঝেই আনন্দ। রাতে আবারো আড্ডা। হোম থিয়েটার আর বিশাল প্রজেক্টরের মাধ্যমে বাসায় বসে গভীর রাত অবধি সিনেমা দেখা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বন্ধুত্ব। আশরাফের অনেক কিছুই তাই আগেই জানা। গল্পে আজ ঢের বেশি জানলাম। যেমনটি মেধাবী তেমনি মিশুক। বাবা ছিলেন ক্যাডেট ছাত্র। পরিবারের কড়া নিয়মে বড় হয়েছে। মনযোগী ছাত্র বরাবরই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত বন্ধুর সংখ্যা নিতান্তই কম। ফলিত রসায়নে বিএসসি ও এমএসসি উভয়টিতে প্রথম শ্রেণি। উচ্চতর শিক্ষার জন্য সুইডেন। সেখানে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ মাস্টার্স করাকালীন তার কষ্টকর জীবনযুদ্ধের কথা শুনে বিস্মিত হলাম। নিজের সঙ্গে তুলনা করতে হঠাৎ আনমনাও।

বাবা-মাকে কষ্ট দিতে চায়নি, তাই সারারাত ম্যাকডোনাল্ডে কাজ করেছে সে। দিনে লেখাপড়া। কোন কাজই তুচ্ছ নয়। অভিজ্ঞতা খুবই কাজে আসে। সমাজে বেঁচে থাকতে মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়। জানা হয় অনেক কিছু। আগামীর জন্য তৈরি হওয়া যায়। কাজের নেশা এ মানুষটিকে আজ তার প্রাপ্য সুখ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করে নামকরা অনেক বড় কোম্পানিতে উচ্চতর পদে কর্মরত। খেলাধুলাতেও অগ্রগামী। মিশিগানে দেশীয় ছাত্র-ছাত্রীদের সহায়তায় ভূমিকা রাখে।

চার.

ভ্রমণে নির্মল আনন্দ আছে। সমাজ, দেশ, বিদেশকে জানা যায়। অতীত ও বর্তমানকে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে মানুষের আগ্রহ আর উন্নয়নের ধারা থেকে ভবিষ্যতটাও বেশ ঠাহর করা যায়। আকাশচুম্বী সব বড় বড় দালানকোঠা, আর অগণিত রঙের আলোক ঝলকানি মানেই উন্নয়ন নয়। সবার আগে শিক্ষা-গবেষণা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়াটাই উন্নয়ন।

বদ্ধ দুয়ার খুলে নিজের গন্ডি থেকে বেরিয়ে প্রকৃতিটাকে দেখা দরকার। শিক্ষা নিতে। প্রকৃতিকে বাঁচাতে। উন্ডজরের পথে খোলা প্রকৃতির মুক্ত বাতাসকে কাজে লাগিয়ে উন্ডমিলের মাধ্যমে বিদ্যুত তৈরি করে বৈশ্বিক-উষ্ণতা কমানোর প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ। ক্রমউন্নতির জন্য দরকার মেধার ব্যবহার। নিজের জন্য, সমাজের জন্য। কোন কাজকেই অবহেলা না করা এক মেধাবী মানুষের নিমন্ত্রণে মিশিগান যাওয়া। মানুষ ও সমাজের সফলতা দেখলাম। অসাধারণ সব অনুভূতি।

লেখক পরিচিতি: রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, টরন্টো, কানাডা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!