সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এই পুরো রাস্তার প্রতিটি কোণে কোণে লুকিয়ে আছে অজস্র সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য। যার মোটামুটি একটা অংশ দেখে মেলবোর্নে ফিরে আসতে দুই থেকে তিন দিন লাগে।
এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর টানা পাঁচ-ছয় মাস অফিস-বাড়ি করার পর মনটা আসলে হাঁপিয়ে উঠছে। শিলাকে অর্থাৎ আমার স্ত্রীকে মনের এই গোপন ভাব বলতেই ও বলে উঠল, সামনে একদিনের একটি ছুটি আছে শুক্রবার। সঙ্গে সোমবার ছুটি নিলে মোট চারদিনের লম্বা ছুটি। মেলবোর্নের স্বর্গ খ্যাত গ্রেট ওশেন রোড ঘুরে আসি।
উ হু! ওটা ‘দ্য গ্রেট ওশেন রোড’। সামনে একটি ‘দ্য’ বসবে।
ওকে ওকে। ‘দ্য’-ই সই।
সপ্তাহ দুয়েক পর নির্দিষ্ট দিনে বেরিয়ে পড়লাম দুজনে অজানার উদ্দেশ্যে। এক্ষেত্রে অজানা বলাটা সমীচীন হচ্ছে কিনা জানি না। কারণ আমি ম্যাপ দেখে ও গুগল ঘেঁটে একটি যাত্রাপথের পরিকল্পনা করেছি। সঙ্গে দুই রাত দুই জায়গায় থাকবার জন্য রুমও ভাড়া করে ফেলেছি। অস্ট্রেলিয়াতে অনেক রকম থাকার ব্যবস্থা আছে। ফাইভ স্টার হোটেল থেকে শুরু করে খুব কম ডলার খরচ করে ব্যাগপ্যাকার্স পর্যন্ত সব ব্যবস্থা আছে।
ব্যাগপ্যাকার্স আসলে একটি কম মূল্যের থাকবার জায়গা, যেখানে এক একটা রুমে বেশ কয়েকটা দোতলা বেড থাকে। একটা ছোট হাতব্যাগ নিয়ে রাত্রি কাটানো সুব্যবস্থা। এক্ষেত্রে বাথরুম শেয়ার্ড হয়ে থাকে। তবে আমি ওসব ব্যাগপ্যাকার্স বা ফাইভ স্টার হোটেল কোনটাই বুক করিনি। আমি অন্যের বাসায় একরুম বুক করেছি। অনেকটা আগের দিনের পেয়িং গেস্ট থাকার মতো। এটা একটি অ্যাপসের মাধ্যমে করা যায়।
গাড়ির ড্রাইভিং সিটে যথারীতি আমি উঠে বসে আমার স্ত্রীকে উঠে পড়বার তাগাদা যখন দিচ্ছি হঠাৎ খেয়াল করলাম ও ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে বলল, নেমে এস বলছি। আমি চালাব।
কথা শুনে তো আমি মহাখুশি। কিন্তু মুখের সামনে একটি মৃদু মন খারাপ দেখিয়ে বললাম, তোমার কষ্ট হবে না? কতদূর জার্নি বল তো!
একথা বলতে বলতে আমি প্যাসেন্জার সিটে সুরুত করে ট্রান্সফার হয়ে গেলাম।
মনে মনে ভাবি যাক বাঁচা গেল। বসে বসে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দেখব। ‘জয় নারী শক্তির জয়’, ‘জয় বঙ্গ রমণীর জয়’ বলে জয়োধ্বনি তুলে চলতে শুরু করল গাড়ি। মেলবোর্ন শহরটা পার হয়ে গাড়ি ছুটে চলছে মেলবোর্নের পশ্চিম দিক দিয়ে ঘণ্টায় একশ কিলোমিটার বেগে।
মজার কথা হলো যেই না মেলবোর্ন শহর খানিকটা পার হয়েছি চোখ মেলে চেয়ে দেখি চারদিকে শুধু অবারিত সবুজ মাঠ। যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। বিজ্ঞানের ভাষায় ক্লোরফিলের জয়জয়কার। মেলবোর্ন যেহেতু একটু পাহাড়ি অঞ্চল তাই দূরে বা অদূরে ছোটোখাটো টিলা দেখা যাচ্ছে। সবুজ যেন দূরে ঢেউ খেলিয়ে চলছে আমাদের সঙ্গে। শিলাকে ঠায় রাস্তার উপর কড়া দৃষ্টি রেখে স্টিয়ারিং হাতে বসে থাকতে হচ্ছে আর আমি চারদিকের সবুজ চাদরে মোড়া প্রকৃতি দেখে আহা আহা করছি।
আমাদের প্রথম স্টপেজ হলো টরকোয়ে সমুদ্রসৈকত। দুপুর একটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম সেখানে। কিন্তু বিধাতার মনে ছিল অন্য ইচ্ছা। সেখানে আমরা যেন খুব বেশি সময় নষ্ট না করি সেজন্য বোধহয় আমরা পৌঁছানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রবল বাতাস আর তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। আকাশে মেঘমল্লার যেন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সূর্যমামাকে মেঘ তার চাদর দিয়ে ঢেকে দিয়েছে।
এই ক্ষণে একটা কথা বলে রাখি, বাঙালি হওয়ার কারণে আমার মনে একটা চাপা অহংকার চেপে রয়েছে। বাংলাদেশে যে কোন ট্যুরিস্ট স্পটে দেখা যায় রাস্তা-ঘাটে বা পার্কে ময়দানে চিপসের প্যাকেট, না হয় সিগারেটের টুকরো কিংবা টিস্যু পড়ে আছে যত্রতত্র। তার মানে বোঝা যায় বাঙালিরা খুব একটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নয়। অথচ অস্ট্রেলিয়ায় দেখেছি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বাহার। সব যেন ঝকঝকে তকতকে।
অনেকে ভাবছেন, ভাল পাগলের পাল্লায় পড়া গেল। পরিষ্কারের কথায় যদি তুললেন তাহলে অহংবোধের বিষয়ের অবতারণা কেন। এর যথেষ্ঠ কারণ আছে। বিদেশিরা টয়লেট সারার পর শৌচকর্ম করে না, টিস্যু ব্যবহার করে থাকে। বাঙালিরা আর যাই করুক পানি ব্যবহার করে আসল জায়গা পরিষ্কার রাখে। তাই এই অহংকার। মানে বাঙালিদের ‘উপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট’ একথা শত্রুও বলতে পারবে না।
বাথরুম থেকে বের হতেই লক্ষ্য করলাম ওই পার্কে রয়েছে বসার জায়গা, বাচ্চাদের জন্য দোলনা ও একটি সুন্দর কাঠের ভাস্কর্য। প্রতিটি ভাস্কর্যে একটা বক্তব্য থাকে, যেটি বোদ্ধা ও শিল্পীরা ছাড়া আর কেউ ব্যাখ্যা করতে পারে না বলে আমার বিশ্বাস। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ শৈল্পিক সৌন্দর্য দেখে বলবে, বাহ! কী সুন্দর!
এটুকুই ব্যাস।
ভাস্কর্যটিতে চারটি মানুষ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে বোদ্ধা হওয়ার ভান করে আমিও বললাম, কী অপূর্ব!
টরকোয়ে সমুদ্রসৈকতে খাবার জন্য বেশ ভালো ভালো কিছু রেস্টুরেন্ট আছে দেখলাম। কিন্তু আমাদের যেতে হবে অনেক দূর। তাই বৃষ্টির মধ্যে আর সময় নষ্ট না করে ছুটে চললাম পরের স্টপেজ ‘অ্যাঙ্গেল সি’র দিকে।
রাস্তায় আসবার সময় সেই সবুজের সমারোহ এখন চোখে সয়ে গেছে। তার উপর শুরু হয়েছে বৃষ্টি। কি একটা মন খারাপ অবস্থা! আগেই বলেছি শহরের একদিকে আছে সমুদ্র। তার মানে একটি সুন্দর সমুদ্র-সৈকতও আছে। সমুদ্রের বোধহয় চুম্বকের মতো এক প্রকার আকর্ষণ শক্তি আছে। সেই আকর্ষণের কারণেই বৃষ্টি থামতেই আমরা সৈকতে একটু হেঁটে এলাম আর সাথে দু’একটা ক্লিক। ক্যামেরায় একটা ক্লিক দিতেই আমার স্ত্রীর তাড়া। চল তাড়াতাড়ি। একেবারে স্কুলের কড়া দিদিমনিদের মতো।
গাড়িতে ওঠামাত্র আমার পেটের মধ্যে কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। বুঝলাম যে, প্রকৃতির সৌন্দর্য খেয়ে আর পেট চলছে না। এখন কিছু উদরপূর্তি না করলে উদরে বাদর দৌড়াবে। ওদিকে শিলারও একই অবস্থা। বেচারি এত এত ড্রাইভ করে একটু যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। তাই আমরা কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্টে গাড়ি দাঁড় করলাম। খুব একটা দামি বা পরিচিত রেস্টুরেন্ট নয়। বাইরে থেকে দেখে বুঝলাম যে ভেতরে মোটামুটি বার্গার, চিপস বা মুরগি ভাজি পাওয়া যাবে। যেহেতু আশপাশে তেমন কোন ভাল রেস্টুরেন্ট নেই, তাই আমরা ওই রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম।
একজন বেশ সুন্দরী তরুণী এগিয়ে এলেন খাবারের মেন্যু নিয়ে। আমরা চিকেন ফ্রাই ও বার্গারের অর্ডার দিলাম। খাবার আসার পর আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম। খুব খেয়াল করে আমি অনুসন্ধিৎসু চোখে চারদিকে খুঁজতে লাগলাম যে কোথাও কোন বাঙালি চোখে পড়ে কিনা। আমার চারপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখা দেখে শিলা বলে উঠল, কী ব্যাপার তোমার। ঘুরে ঘুরে কি সুন্দরী ললনা দেখ নাকি।
আরে নাহ। দেখতো কোন বাঙালি পাও কিনা।
কেন হঠাৎ করে তোমার বাঙালি খুঁজতে হবে কেন। কী সমস্যা!
মুরগি ভাজি দেখেছ? চারপাশে কেমন লাল হলুদের সংমিশ্রণ। মনে হচ্ছে চকবাজারে কাবাব। চরম স্পাইসি। অসিরা তো এত স্পাইসি খায় না জানি। তাই ভাবলাম দোকানের মালিক বা বাবুর্চি বাঙালি হবে হয়ত।
হুম। বুঝেছি। বহু হয়েছে। এখন খাও তাড়াতাড়ি। যেতে হবে বহুদূর। তারপর থাকার জায়গা।
আমি একটু অভয় দিয়ে বললাম, আরে আর বেশি দূরে নয় সুন্দরী।
অ্যাঙ্গেল সি থেকে খেয়ে দেয়ে রওনা দিলাম পরবর্তি গন্তব্যের দিকে।
যদিও আমাদের পরবর্তি গন্তব্য ‘লোর্ন’ নামের একটি জায়গা। কিন্তু খানিক দূর আসার পর অবাক হয়ে দেখলাম, রাস্তার উপর একটি প্রকাণ্ড সাইজের কাঠের তোরণ। তোরণের উপরে লেখা ‘গ্রেট ওশেন রোড’। আর সেই তোরণের বামপাশে দু’জন মানুষের মূর্তি ও একটুখানি গাড়ি রাখবার জায়গা। শিলা ইতিমধ্যে বুঝে নিয়েছে যে এটি একটি দেখবার জায়গা অর্থাৎ কিনা ট্যুরিস্ট স্পট। তাই সুন্দর করে গাড়ি পার্ক করে ফেলল।
আমরা নেমে এলাম। ওহ মাই গড! সত্যিই একটি বিশাল সিংহ দরজা। মনে হলো যেন আমাদের স্বাগতম জানাচ্ছে ‘গ্রেট ওশেন রোডে’ ঢোকার জন্য। তোরণের পাশে একটি পাথরের স্তম্ভের উপর ‘গ্রেট ওশেন রোড’ এর ইতিহাস লেখা রয়েছে আর বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পট সম্বলিত একটি ছোট্ট ম্যাপ রয়েছে। আমি খুব ভালো করে ইতিহাস পড়তে লাগলাম। ‘গ্রেট ওশেন রোড’ এ ঢুকব, আর তার ইতিহাস জানবো না, সেটা তো হতে পারে না।
খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর অস্ট্রেলিয়ার সৈন্যদের নিহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমান অনেক বেশি ছিল। যার কারণে যে সব বীরযোদ্ধারা সুস্থ অবস্থায় ফিরে এসেছিল তারাও একপ্রকার যুদ্ধ পরবর্তি মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিল। যুদ্ধের বিভৎসতা তাদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল। তখন তৎকালীন সরকার এই রোড নির্মাণের দায়িত্ব দেন সেই সব অকুতোভয় বীর সেনানীদের। দীর্ঘ ১৪ বছরের প্রচেষ্টায় তৈরি হয় পৃথিবীর মধ্যে অত্যন্ত সুন্দর এই মেরিন ড্রাইভ।
এই সিংহ তোরণ পার হওয়া মানে এবার আমরা অফিসিয়ালি ‘গ্রেট ওশেন রোডে’ প্রবেশ করলাম। আর আনন্দের বিষয় হচ্ছে, ড্রাইভিং সিটে আমি। কারণ শিলা এখন বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। যদিও ড্রাইভিং না পেয়ে মুখ ভার করে বসে আছে প্যাসেন্জার সিটে। আমি এখন অবশ্য বেশ পুলকিত। দুপুর গড়িয়ে এবার বিকেলের দিকে। আরও চার ঘণ্টার মতো আলো থাকবে। আমরা এরপর লোর্ন-এ থামব।
আমি যাব ওখানে।
আমি বুঝেও না বোঝার ভান করে বললাম, কোথায়?
কোথায় আবার? ওই যে দেখ বাতিঘর দেখা যাচ্ছে। ওইখানে যাব।
আমি কিছু না বলে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলাম। আসলে আমি তো নিজেই ঠিক করেছি যে ওখানে যাব।
মূল যে প্রধান সড়ক দিয়ে আমরা চলছি, বাতিঘরে যাবার রাস্তা তার পাশে একটি সরু গলির মতো। আমি ভুস করে ঢুকে গেলাম সেই সরু রাস্তায়। গাড়ি চলছিল এতক্ষণ ঘণ্টায় একশ কিলোমিটার বেগে। এখন এই সরু রাস্তায় ৪০ কিলোমিটার। মনে হচ্ছে গাড়ি যেন চলছেই না, খুঁড়িয়ে চলছে। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই বাতিঘরের নিচে পৌঁছে গেলাম। কী প্রকাণ্ড এক স্তম্ভ। এর নিচে নিজেদেরকে অনেকটা হাতির সামনে সরিষাদানার মতো নগণ্য মনে হতে লাগল।
সেখান থেকে পড়ন্ত বিকেলে নীল সমুদ্র দেখতে দেখতে মন আমার গুনগুন করে গান গেয়ে উঠল। আমি সাগরের নীল.... গান গাওয়া বেশি দূর বাড়তে দিলাম না।
ঝটপট দেখা শেষ করে, কিছু ছবি তুলে রওনা দিলাম আবার মূল গন্তব্যের দিকে। একটু মুচকি হেসে বললাম, এভাবে কিছু দূর পর পর গাড়ি দাঁড় করলে এ জীবনে আর থাকার জায়গায় পৌঁছানো লাগবে না। গাড়িতেই রাত্রিবাস করতে হবে।
কিন্তু কথায় বলে না, বিধি বাম। অর্থ্যাৎ বিধাতা বোধহয় সবসময় বামপন্থি। মানুষ ভাবে এক আর তিনি করেন আরেক। কিছুদূর যেতে না যেতেই হঠাৎ চোখে পড়ল একটি ‘টেডিস লুক আউট’ নামের সুন্দর একটি দেখবার জায়গা। শিলার দিকে তাকাতেই ও মুচকি হেসে সম্মতি দিল।
এটি পাহাড়ের গা বেয়ে বেশ খানিকটা উপরের একটি জায়গা। বনজঙ্গল ঘেরা। গাড়ি নিয়ে আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে, বড় বড় গাছপালার মাঝখান দিয়ে উপরে উঠছি তো উঠছি। সে ওঠার মনে হয় শেষ নেই। পরে যখন একেবারে উপরে উঠে গেলাম তখন দেখি এই জনমানবহীন পাহাড়ের মাথায় গাড়ি পার্কিং এর সুবন্দোবস্ত রয়েছে। অবাকই হলাম পার্কিং এর জায়গা দেখে। একটু আগে গাড়ি চালাতে চালাতে বলছিলাম, কোথায় যে যাচ্ছি, কূল-কিনারা নেই। আর এখন পেয়ে গেলাম এক সুন্দর গাড়ি রাখবার জায়গা। গাড়ি রেখে সামনে একটু হেঁটে গেলেই ‘টেডিস লুক আউট’।
আমরা এখন সমতল ভূমি থেকে বেশ অনেকটা উঁচুতে। সেই উঁচু পাহাড়ের একদম কিনারায় একটি কাঠের প্লাটফর্ম করা হয়েছে, যাতে দর্শনার্থীরা উপর থেকে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে পারেন। আমরাও দু’চোখ মেলে দেখতে লাগলাম সেই সুন্দর দৃশ্য। দূরে দেখা যাচ্ছে আরেকটি পাহাড়ের গা বেয়ে সর্পিলাকৃতি রাস্তা বয়ে চলেছে। আর সেই সবুজ পাহাড়ের নিচে দুধসাদা ফেনা তুলে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের নীল জলরাশি।
আর আমার ক্ষেত্রে ঘটছে অন্য ঘটনা। আমি যেন তখন ছন্দপাগল জীবনানন্দ। সমুদ্রের আছড়ে পড়া জলরাশি আমার রক্তে রক্তে তরঙ্গিত হয়ে উঠছে। শেষ পর্যন্ত আমার সম্বিত ফিরল শিলার ডাকে। ওই লুক আউট থেকে ফেরার সময় হঠাৎ চোখে পড়ল, কিছু পাথরের পৃষ্ঠদেশে চায়ের কাপ সাইজের ছোট ছোট গর্ত এবং তাতে পানি জমে আছে। ব্যাপার কী? বৃষ্টির পানি কী তাহলে এই গর্ত করেছে পাথরের উপর?
পরক্ষণেই মনে হলো বৃষ্টির পানি যদি গর্ত করবে তাহলে কতদিন লেগেছে বা শুধু ওই একটি নির্দিষ্ট জায়গায় করবে কেন? সম্পূর্ণ পাথরের গায়েই তো গর্ত হওয়ার কথা। শিলা মনে হয় আমার চিন্তা বুঝতে পারল। ডেকে বলল, দেখো, ওখানে একটা প্ল্যাকার্ড আছ, এই সম্পর্কে। পড়ে দেখ।
প্ল্যাকার্ড পড়ে যা বুঝলাম তা হলো, বৃষ্টির পানি ও বিভিন্ন কেমিক্যাল মিলে পাললিক শিলার ভেতরে একটি বলের আকৃতির পিণ্ড তৈরি করে। তার নাম ‘কনক্রিশনস’। এটি তৈরি হতে ১০০ থেকে ১২০ মিলিয়ন বছর লাগে। এই পাথরের পৃষ্ঠ থেকে ওই বলসদৃশ পিণ্ডটি বের হয়ে গিয়েছে। পড়ে রয়েছে তার ছাঁচ। আমি চিৎকার দিয়েই উঠছিলাম প্রায়, ১২০ মিলিওওওন বছর! বিস্ময়ে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। তবে এখন বিস্ময়ে বিস্মিত হলে তো হবে না। তাই কোনরকমে বিস্ময়কে পেছনে ফেলে গাড়িতে উঠে পড়লাম।
শুরু হলো আবার পথচলা। এখন গাড়ি চালানোর ব্যাপারে আমার অনুভূতি মিশ্র। কিছুটা ‘এই পথ যেন না শেষ হয়, তবে কেমন হবে...’ জাতীয় অনুভূতি। আবার কখনও কখনও ‘আমি ভয় করব না...ভয় করব না’ রকমের অবস্থা। এর অবশ্য কারণ আছে। গাড়ি ছুটে চলছে পাহাড়ের গা বেয়ে আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে। রাস্তার একেকটি বাঁক প্রায় ইউ-টার্নের মতো। আবার কখনও রাস্তা খাড়া উপরের দিকে উঠে গেছে, আবার কখনও হঠাৎ করেই নিচে নেমে যাচ্ছে। তাই একটু ভয় ভয় করছে।
অন্যদিকে রাস্তার বাম পাশে সুনীল সাগরের হাতছানিতে মনটা ভরে উঠছে। এখন অবশ্য মেঘ বৃষ্টি থেমে ঝলমলে রোদ উঠে গেছে। এই রাস্তার স্পিড লিমিট লেখা আছে ঘণ্টায় ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার। কিন্তু আঁকাবাঁকার কারণে আমি ঘণ্টায় ৪০ থেকে ৬০ কিলোমিটার স্পিডে চালাচ্ছি। আমার পেছনে মাঝে মাঝে প্রচুর গাড়ির সারি জমে যাচ্ছে। কিছুদূর পর পর রাস্তার পাশে একটি বাড়তি লেন রাখা হয়েছে যাতে ‘স্লো ভেহিকল ওভার টেকিং’ লেখা। আমি প্রায়ই ওইসব লেনে চলে যাচ্ছি যাতে আমার পেছনের গাড়িগুলো ওভারটেক করে চলে যেতে পারে।
এভাবে ভুস ভুস করে আমার পেছনের গাড়ির চালকরা জানালার বাইরে হাত নেড়ে ধন্যবাদ দেয়ার ইশারা করে চলে যাচ্ছে। এটা অস্ট্রেলিয়ার একটি ভাল রীতি। কেউ সামান্য একটু ভাল কিছু করলে তার একটা ভাল মূল্যায়ন করা।
কিছুক্ষণ পরেই চোখে পড়ল ‘কেনেট রিভার হলি ডে পার্ক’ নামে একটি জায়গা। সেখানেই গাড়ি থামিয়ে বাথরুমে দৌড়। বাথরুম থেকে ফিরে দেখি শিলা একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকছে। ওই গাছের নিচে অনেক মানুষ ছবি তুলছে। আমি কাছে যেতেই শিলা বলল, দেখ কী সুন্দর প্যরোট! একেবারে হাতের উপর নেমে আসছে, ঠোঁটের সামনে খাবার ধরলে খাবার খাচ্ছে। দেখলাম ঝাঁকে ঝাঁকে কালো রঙের ভারি সুন্দর পাখি, গলা ও মাথা লাল রঙের। লাল ঠোঁট দিয়ে মানুষের হাতে বসে খাবার খাচ্ছে। চমৎকার দৃশ্য! বাংলাদেশে এধরণের দৃশ্য দেখা যায় বললেই চলে।
এখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছে। কথায় আছে পাহাড়ি অঞ্চলে ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসে। হলোও তাই। গাড়িতে উঠতে না উঠতে সন্ধ্যা হয়ে এল। এখন রাস্তার ক্ষীণ আলো ও গাড়ির হেডলাইট সম্বল। সূয্যিমামা নেই। তবে চাঁদ মামা আছে। খুব সাবধানে সতর্ক দৃষ্টি রেখে এখন গাড়ি চালাতে হচ্ছে। এমনিতেই পথ আঁকাবাঁকা। তার উপর বেশ অন্ধকার। ফলে পথ চলতে একটু বেগ পেতে হচ্ছে। কিছুক্ষণ ড্রাইভ করার পর গুগলের সহায়তায় একেবারে সোজা পৌঁছে গেলাম আমাদের ভাড়া করা বাসায়। জায়গাটির নাম ‘এপোলো বে’। এটাই আমাদের প্রথম রাতের থাকবার জায়গা। একটি ছিমছাম সুন্দর এক রুমের অ্যাপার্টমেন্ট।
বাসায় ঢুকে ফ্রেশ হয়ে দেখি ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। বাড়ির মালিক একজন চীনা ভদ্রলোক। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বুঝিয়ে দিলেন যে সামনে একটু দূরে বাজার আছে সেখানে ভালো খাবার পাওয়া যায়। বেরিয়ে পড়লাম দুজনে খাবারের উদ্দেশ্যে।
বাড়ির মালিকের কথা শুনে গিয়ে দেখি সত্যিই ছোট্ট একটি বাজারের মতো এক চিলতে জায়গা। আর সেখানে একটিই মাত্র দোকান খোলা আছে। খুব সম্ভবত ভিয়েতনামি রেস্টুরেন্ট। সেখানে খেয়ে ফিরে এলাম আজকের রাতের মতো নিজেদের ডেরায়।
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |
লেখক পরিচিতি: অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন প্রবাসী প্রকৌশলী
এই লেখকের আরও লেখা