দেশি ভূতের হাহাকার জাগানো এক রাত

সেদিন ছিল নিউ ইয়র্ক সিটির রাস্তায় রাস্তায় শুধু ভূত-পেত্নীর ছড়াছড়ি! না ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই, এই ভূত পেত্নী, সুপারহিরো, সুপারভিলেন আর কমিক্স সিনেমার চরিত্ররা বাস্তব নয় তাদের মুখোশে সাধারণ মানুষ, উপলক্ষ ভূত সেজে ভূত তাড়ানোর উৎসব 'হ্যালোউইন'।

গৌরব দাশ নয়ন, নিউ ইয়র্ক থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Nov 2019, 10:24 AM
Updated : 3 Nov 2019, 10:26 AM

শতাব্দী প্রাচীন কেল্টিক উৎসব হ্যালোউইন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে প্রথম এ দিনটি পালন শুরু হয়, পরে খ্রিস্টান জাতির সাথে সাথে এটি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। অন্যান্য অনেক পাশ্চাত্য উৎসবের মত সম্ভবত হ্যালোউইনেরও সবচেয়ে বড় মাপের উদযাপন হয় নিউ ইয়র্ক সিটিতে। সিটির প্রাণকেন্দ্র ম্যানহাটনে প্রতিবছর হ্যালোউইনের সন্ধ্যায় বড় রকমের প্যারেড হয়, সেখানে ছেলে বুড়ো, একা, দম্পতি, সবান্ধব সমাগম হয় হাজারো মানুষের। প্যারেডে অংশ নিতে নেই কোন টিকেট, শর্ত শুধু একটাই সাজতে হবে একটা কিছু, নিজের স্বাভাবিক চেহারায় থাকলে হবে না!

আমেরিকা ইউরোপে বড়দিনের পরই সবচেয়ে বেশি উদযাপিত অনুষ্ঠান হ্যালোউইন।  প্রাচীন ইউরোপে এটি পালন হত ‘অল হ্যালোস ইভ’ বা 'শুদ্ধ' আত্মার অর্চনায় পরলোকগত আত্মীয় স্বজনদের জন্য প্রার্থনা করে কারণ ক্যাথলিক বিশ্বাস অনুযায়ী এই দিনে স্বর্গ থেকে আত্মারা নিচে নেমে আসে। অন্য এক কিংবদন্তি অনুযায়ী এদিন দুষ্ট আত্মারা মর্ত্যে নেমে এসে ফসলের ক্ষতি করে, তাই প্রাচীন ইউরোপে চাষীরা নানা রকম সেজে রাতে ফসল পাহারা দিত। এই তত্ত্বটিরই বর্তমান রূপ হ্যালোউইনের দিনে 'যেমন খুশি তেমন সাজো' আর নিউ ইয়র্ক সিটির প্যারেড।

এ সাজসজ্জা আর বাচ্চাদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে চকলেট বা ক্যান্ডি সংগ্রহ, যা ট্রিক অর ট্রিট নামে পরিচিত (হ্যালোউইনের আরেক আকর্ষণ)। আজ শুধু মার্কিন বা শ্বেতাঙ্গদের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই তা ছড়িয়ে গেছে এখানে বসবাসকারী সবার মাঝে, বাঙালিরাও বাদ যায়নি। বাচ্চাদের বায়নায় বাংলাদেশি অনেক বাড়ির অন্দরও হ্যালোউইনের সাজে সাজতে দেখা যায়।

যাই হোক এই বছরের হ্যালোউইন প্যারেডের কথায় আসা যাক। হ্যালোউইনে আনন্দ উদ্যম চরমে থাকলেও এদিন সরকারি ছুটি থাকেনা। সবাই তাই স্কুল-কলেজ আর অফিসের পরেই উদযাপনে বের হয়। ম্যানহাটনের উদ্দেশ্যে সাবওয়ে ট্রেনে উঠতে না উঠতেই বোঝা গেল আজ হ্যালোউইন! বেশির ভাগ মানুষই কোন না কোন ছদ্মবেশে আছে, প্রতিবছরই হলিউডের সাম্প্রতিক সিনেমার চরিত্রদের আধিক্য থাকে হ্যালোউইনের সাজে, এবার যেমন ছিল জোকার আর পেনিওয়াইজের।

হান্টার কলেজের নার্সিংয়ের শিক্ষার্থী পিয়া দাশপুরকায়স্থও এবার জোকার সেজে চকলেট সংগ্রহ করেছে। এই চরিত্র বাছাইয়ের কারণ জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, জোকারের প্রতি সহানুভূতিই তার কারণ।

ম্যানহাটনের প্যারেডে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্যারেড শুরু হয়ে গিয়েছিল। ক্যানাল স্ট্রিট থেকে শুরু হওয়া প্যারেড শেষ হয় থার্টিফোর স্ট্রিট পেন্সিলভেনিয়া স্টেশনে, পুরো এলাকায় নিউ ইয়র্ক পুলিশের সতর্ক অবস্থান। আছে সব নামীদামী টিভি চ্যানেলের ক্যামেরাও। সদ্যমুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার চরিত্র থেকে শুরু করে পুরনো ভিডিও গেমের চরিত্র- যে যার মত সেজেছে দামী কমদামী বিভিন্ন সজ্জায়, আছে গা শিউরে ওঠা ভূত আর রাক্ষসের ছদ্মবেশধারীরাও!
এই ভূতের মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে জানতে পারলাম, অনেকে অন্য অঙ্গরাজ্য থেকেও এসেছে শুধু এই প্যারেড দেখবে বলে। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকেও নাকি অনেকে আসে এই ভূতুড়ে মিলনমেলায়।

তবে নিছক বিনোদন নয় এখানে অনেক সচেতনতামূলক কার্যকলাপও দেখলাম। যুদ্ধ নয় শান্তি চাই- এমন বার্তাময় পোস্টার হাতে ঘুরছে অনেকে। হংকংয়ে চীনা শোষণের প্রতিবাদ ও হংকংয়ের স্বাধীনতার সপক্ষে এক বড় র‍্যালীও চলছে সমানতালে। ফ্রি ইন্টারনেট ফর অল মুভমেন্টেরও এখানে আছে সরব উপস্থিতি।

হ্যালোউইনের রাতটা সাধারণত সবাই হরর মুভি দেখে কাটায়। আমিও ট্রেনে করে ঘরে ফেরার সময় সেটাই ভাবছিলাম। এক বৃদ্ধ ভদ্রমহিলা আমাকে দেখে জানতে চাইলেন আমি প্যারেড থেকে আসছি কিনা। আমি বললাম, 'হ্যাঁ, আপনি?'

উনি বললেন, 'না বাবা ওসব প্যারেডে সত্যি ভূতরা মিশে থাকে ছদ্মবেশীদের সাথে!'

আমি হরর মুভির চিন্তা বাদ দিলাম। না ভদ্রমহিলার কথায় ভয় পাইনি। বরং আমাদের দেশি ভূত, যেমন- শাকচুন্নি, মেছোভূত, গেছোভূত, ব্রহ্মদৈত্য এদের কেউ মনে রাখেনা। সেই দু:খেই এই সিদ্ধান্ত!

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!