সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে নিউ ইয়র্কে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সংবাদ সম্মেলন

ভোলায় সংগঠিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের সংবাদ জানার সাথে সাথেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ নিয়ে পরিষ্কার বক্তব্য দেওয়ায় ঘটনাটি বেশিদূর আগায়নি বলে মনে করছে নিউ ইয়র্কের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান পরিষদের নিউ ইয়র্ক শাখার নেতৃস্থানীয়রা।

নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Nov 2019, 08:27 AM
Updated : 3 Nov 2019, 08:27 AM

এজন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি সন্ত্রাস সন্ত্রাস, মাদক, জঙ্গিবাদ এবং দুর্নীতির মত সংখ্যালঘু  নির্যাতনেও ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নেওয়া হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তারা।    

স্থানীয় সময় শুক্রবার নিউ ইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটসে ঐক্য পরিষদের এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের যুক্তরাষ্ট্র শাখার পরিচালক শিতাংশু গুহ বলেন, “ভোলায় সংঘটিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনার সংবাদ জানার পরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ নিয়ে কথা বলায় পরিস্থিতি বেশিদূর গড়ায়নি। এ কারণে আমরা শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞ।”

তিনি বলেন, “একইভাবে সন্ত্রাস, মাদক, জঙ্গিবাদ এবং দুর্নীতিকে জিরো টলারেন্স ঘোষণার জন্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আশা করছি, ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধেও জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করা হবে। তাহলেই ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় পরিণত হতে বেশি সময় লাগবে না।”

ভোলার ঘটনার প্রতিবাদ এবং হামলাকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবিতে ওই সংবাদ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়।

ঐক্য পরিষদের সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নোত্তর পর্বে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রগতিশীল সরকার ক্ষমতায়। অথচ তাদের আমলে একের পর এক সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হলে রামু, নাসিরনগর, রংপুর ও ভোলার ঘটনা ঘটতো না।

সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি নব্যেন্দু দত্ত বলেন, “বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে উন্নত এক দেশ হিসাবে পরিচিত। অথচ সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা বাংলাদেশের ইমেজকে নষ্ট করছে। এটা মোটেও কাম্য নয়। আমরা যে যেই ধর্মের হই না কেন, দিনশেষে আমরা বাংলাদেশি।”

ঐক্য পরিষদের আরেক পরিচালক দ্বীজেন ভট্টাচার্য বলেন, “সরকার সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধে উদ্যোগ না নিলে সমাজ এই দায়িত্ব নিতে পারে। এজন্য সমাজের সকল মানুষকে সোচ্চার হতে হবে।”

সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের সেক্রেটারি বিদ্যুৎ দাস।

মঞ্চে নেতাদের মধ্যে আরও ছিলেন রূপকুমার ভৌমিক, টমাস দুলু রায়, সুশীল সাহা, রোজালিন কস্তা, চন্দন সেনগুপ্ত, রিনা সাহা, প্রকাশ গুপ্ত, অবিনাশ আচার্য, গোবিন্দ গোস্বামী, দীনেশ মজুমদার, নিতাই বাগচি প্রমুখ।

লিখিত বক্তব্যে রামু, নাসিরনগর ও রংপুরে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলা হয়, “সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হলেও এর বিচার হচ্ছে না। বাংলাদেশের জন্ম একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে। এতদসত্ত্বেও ১৯৮৮ সালে প্রেসিডেন্ট জেনারেল এরশাদ কর্তৃক ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হচ্ছে।”

সংবাদ সম্মেলনে ‘৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ ১১ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন দ্বীজেন ভট্টাচার্য।

লিখিত বক্তব্যে অভিযোগ করা হয়, “ভোলায় সংখ্যালঘু নির্যাতন এবারই প্রথম নয়, আগেও ঘটেছে।  আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে কি ঘটেছিলো সেই এলাকায় ২০০১ সালে।  মোহাম্মদ বদরুল আহসান তার ‘নাঁকফুল হারানোর রাত’ নিবন্ধে লিখেছিলেন, ভোলার চরফ্যাশনে একরাতে একই জায়গায় প্রায় দু’শ হিন্দু মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়। এরমধ্যে ৮ বছরের শিশু, মধ্যবয়স্ক বিকলাঙ্গ মহিলা বা ৭০ বছরের বৃদ্ধা, কেউ রেহাই পাননি। বিএনপি-জামাত নির্বাচনে জিতে বিজয় উৎসব করেছিলো হিন্দু’র ওপর অত্যাচার করে। হিন্দু মেয়েরা ধর্ষিতা হয়েছিল আওয়ামী লীগ বলে নয়, হিন্দু বলে।  সেই সময় মোট ধর্ষিতার ৯৮ শতাংশ ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের।’ 

“কক্সবাজারের রামু’র বৌদ্ধপল্লীতে হামলা ঘটেছিল ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১২। উত্তম বড়ুয়া’র ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ইসলাম, কোরান ও নবীকে অবমাননা করা হয়। কট্টর মৌলবাদী ও উগ্রপন্থীদের নেতৃত্বে ২৫ হাজার মানুষ মিছিল-সমাবেশ করে বৌদ্ধপল্লীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রামু-র বৌদ্ধপল্লী, তার পর উখিয়া ও টেকনাফে। ওই অঞ্চলে ১৯টি প্যাগোডা, মূর্তি ভাঙ্গা হয়, অসংখ্য বাড়িঘরে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ১৮টি মামলা হয়, কিন্তু কোনও অগ্রগতি নেই!

লিখিত বক্তব্যে অভিযোগ করা হয়, “যেই উত্তম বড়ুয়া-কে নিয়ে এ লঙ্কাকাণ্ড, সেই তাকেই এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।”

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করছেন ঐক্য পরিষদের সেক্রেটারি বিদ্যুৎ দাস।

এতে আরো বলা হয়,  “নাসিরনগর ঘটনা একই কায়দায় ঘটে ২০১৬ সালের ৩০ অক্টবর।  হিন্দুদের মন্দির, মূর্তি, বাড়িঘর ভাংচুর করা হয়। ঘটনার দুইদিন আগে নাসিরনগরের হরিপুর গ্রামের রসরাজ দাস এর নামে ফেইসবুকে পোস্টিং  আসে ‘কাবার ওপর শিবলিঙ্গ’।  স্থানীয় লোকজন রসরাজকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে। তাতেও থামেনি। হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করে। প্রথম দিনে ৮টি হিন্দুপাড়ায় ৩০০ বাড়িঘর, মন্দির, দেবদেবীর প্রতিমা ভাংচুর করা হয়। রসরাজের বাড়িঘর আক্রমণ, ভাংচুর হয়। ৫দিনের মাথায় ৪ নভেম্বর আবার একদফা আক্রমণ হয়। আওয়ামী লীগের প্রয়াত মন্ত্রী সায়েদুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে তিনি হিন্দুদের ‘মালাউন’ বলে গালি দিয়েছেন। মন্ত্রী তা অস্বীকার করেন। পত্রিকার খবর, সেদিন রাতে কয়েকশ’ নারী তিতাস নদীতে সারারাত গলা ডুবিয়ে রেখে সম্ভ্রম রক্ষা করেছেন।  সরকার নয়,  তিতাস নদী-  সেদিন তাদের সম্ভ্রম রক্ষা করেছিল।  আড়াই মাস পর রসরাজ জামিনে মুক্তি পান। তিনি জেলে, অশিক্ষিত। ফেইসবুক চালাতে জানেন না, পাসওয়ার্ড কাকে বলে তাও বুঝেন না। এখানে মোট ৮টি মামলা হয়েছিলো,কিন্তু কোনটিরই অগ্রগতি নেই।”

“২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর ঠিক একই ঘটনা ঘটে রংপুরের গঙ্গাচড়ায়। গুলি চলে, একজনের মৃত্যু হয়। টিটু রায়, বাড়ি গঙ্গাচড়া, কিন্তু থাকতেন নারায়ণগঞ্জ। তাঁর ফেইসবুক থেকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ ওঠে। তিনি গ্রেপ্তার হন। গঙ্গাচড়ায় কয়েকদিন ধরে মাইকিং হয়। ঘটনার দিন মানববন্ধনে শতশত মানুষ হিন্দুপাড়া আক্রমণ করে। মোট ৩টি মামলা হয়, কোন অগ্রগতি নেই অন্যসব মামলার মতোই। রংপুরে মসজিদের মাইক থেকে মুসল্লিদের উত্তেজিত করা হয়। যশোরের অভয়নগর, সাতক্ষীরা, নন্দীরহাট সর্বত্র নবী ও ইসলাম অবমাননার অজুহাত।”

“ভোলা থেকে রামুর ঘটনার মধ্যবর্তি  সময়ে একই পদ্ধতিতে ওরা এই বর্বরতা  চালিয়েছে ২০১৩ সালে পাবনায়, ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, ২০১৭ সালে রংপুরে।” 

লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, “সরকার বা প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলে অবশ্য এসব ঘটনা এড়ানো সম্ভব। প্রশ্নটা হচ্ছে সদিচ্ছার। এবার প্রধানমন্ত্রী শুরুতেই কথা বলেছেন, তাকে ধন্যবাদ, এজন্যে ভোলাতে  ‘নাসিরনগর’ বা রামুর বীভৎসতা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী কি চান তা পরিষ্কার হওয়ায়, প্রশাসন সঠিক অবস্থান নিয়েছে। ফলে, কয়েক ঘর হিন্দু’র বাড়িঘর পোড়া, মন্দির-মূর্তি ভাঙ্গা, ও মারধরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে, আরো বড় কিছু ঘটেনি। পুলিশের গুলিতে ৪জন মারা গেছেন। সরকার পরিবার প্রতি ৫ লাখ টাকা দিয়েছেন, ভোলার এমপি’ও তাদের অর্থ সাহায্য করেছেন- আমরা এর প্রশংসা করি এবং  যদিও সরকার বা এমপি মৌলবাদী তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুদের কিছু দিতে ভুলে গেছেন, তবে আমরা আশা করি যে,  ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুদেরও সরকার সাহায্য করবে।”

সংবাদ সম্মেলনে বিশেষভাবে  বলা হয়,  “মূল প্রশ্ন হল ডানপন্থী, মৌলবাদী ও  উগ্রপন্থীরা সম্মিলিতভাবে যুগের পর যুগ ধরে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন করছে কেন?  ডানপন্থীরা করছে, কারণ তারা ধর্ষণ করার জন্য নারী পাবে, বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে বাড়িঘর-জমিজমা পাবে, আর ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা বলেছে, ‘একটি ইসলামি দেশে কোন কাফেরের স্থান নেই, এদেশে থাকতে হলে, ভোট দিতে চাইলে ইসলামে  ধর্মান্তরিত হতে হবে বা চলে যেতে হবে।”

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!