অবরুদ্ধ কাশ্মীরে ছয় দিন: শেষ পর্ব

[বাংলাদেশের শিক্ষার্থী ফাতিমা জাহান ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস এর ওপর পিএইচডি করেছেন ভারতের ব্যাঙ্গালুরু ইউনিভার্সিটিতে। ভারতের সংবিধান থেকে বিশেষ মর্যাদা রদ করায় ‘ভূস্বর্গ’ যখন নিরাপত্তার বেড়াজালে অবরুদ্ধ, ওই সময় ছয় দিন ঘটনাচক্রে কাশ্মীর ঘুরে এসেছেন তিনি। থমথমে কাশ্মীরে সেই ছয় দিনের অভিজ্ঞতা তিনি ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জন্য।]

ফাতিমা জাহানফাতিমা জাহানভারতের ব্যাঙ্গালুরু থেকে
Published : 25 Sept 2019, 04:42 AM
Updated : 25 Sept 2019, 04:42 AM

ষষ্ঠ দিন: বাংলাদেশ সম্পর্কে কাশ্মীরিদের ভুল ধারণা

২৫ অগাস্ট ২০১৯

আগামীকাল আমি কাশ্মীর ছেড়ে যাচ্ছি। একটু খারাপ লাগছে, আর আসা হয় কিনা কে জানে, যা অবস্থা দেখছি।  

আমি আর জুনেয়েদ সকাল থেকে কথাবার্তা বলছিলাম। কোরবানির ঈদের দিন নামাজের জন্য মসজিদে গিয়ে নামাজিরা ফিরে এসেছিলেন। মসজিদ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কোরবানি খুব কম মানুষ দিয়েছিল। কারফিউ থাকার কারণে সেদিন কারো ঘরে কোনো আয়োজন হয়নি।

গতকাল বিকেল পাঁচটায় ল্যান্ডলাইন কানেকশন খুলে দেওয়া হয়েছে, তবে আউটগোয়িং নেই। মানে কাশ্মীরের ভেতরে কেউ কাউকে কল করতে পারবে না, শুধু বাইরে থেকে আসা কল রিসিভ করতে পারবে। কী লাভ হলো বুঝলাম না। ইন্টারনেট, মোবাইল এখনো বন্ধ। ল্যান্ডলাইনের একপেশে সংযোগও যেকোন সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে।  

জুনেয়েদ অনেক খবরাখবর রাখে আর বাইরের জগত সম্পর্কে আগ্রহও অনেক। ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে গুগল সার্চ করে অনেক তথ্য জানার পথ বন্ধ এখন বন্ধ। কাশ্মীরে কেউ হিন্দি পড়তে লিখতে পারে না। এখানে স্কুলে ছাত্রদের উর্দু আর ইংরেজি ভাষা পড়ানো হয়। কিন্তু ভারতের অন্যান্য রাজ্যে ইংরেজির সঙ্গে হিন্দি পড়ানো হয়, দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে স্কুলে।

স্থানীয় খবরের কাগজ

আশপাশের হাউসবোট থেকে কয়েকজন ‘হাউসবোট মালিক সমিতির’ সদস্যরা এসেছেন। সবারই ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, এবারের মতো এত কঠোর অবরোধ তারা আগে দেখেননি। আর কাশ্মীরকে হুট করে এভাবে ভারতের রাজ্য হিসেবে সামিল করা ভারতের সংবিধানে নেই। কোনো ধারা বাতিল করার সঙ্গে সঙ্গে তিন মাসের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করতে হয় রাজ্যে। ৩৭০ ধারা বাতিল ঘোষণার কুড়ি দিন পার হয়ে গেছে। এর পক্ষে বিপক্ষে সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবীরা লড়ছেন। তবে নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে।

আরো আশ্চর্য হলাম যখন তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের ধারণা জানালেন। তারা মনে করেন- ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশ হিন্দুদের সহায়তায় (ভারতের সহায়তায়) হিন্দু রাষ্ট্র কায়েম করার জন্য আলাদা হয়ে গিয়েছিল।’ আমি তাদের এই ধারণা যে ভুল তা প্রমাণ করার জন্য ঘণ্টা দুয়েক ধরে বোঝালাম। তারা বুঝতে পেরেছিলেন, কিন্তু কতজন মানলেন তা বোঝা গেলো না। এতদিনের বদ্ধমূল ধারণা টলাতে সময় লাগবে।

ডাল লেক

বেশ কয়েকবার আমি সমালোচনার মুখে পড়েছিলাম কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ব্যাপারে কথা বলে। কাশ্মীর উপত্যকার অধিবাসীদেরকে ‘কাশ্মিরি পণ্ডিত', 'কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ' বা 'হিন্দু' বলা হয়। এখানেও দেখলাম প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। কাশ্মীরের সাধারণ জনগণ মানতে চান না যে কাশ্মীরি পণ্ডিতদেরকে বাধ্য করা হয়েছে চলে যেতে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে পণ্ডিতরা নিজেরাই চলে গেছেন।

আমি পাল্টা প্রশ্ন করি, নিজের ভিটামাটি ছেড়ে কেন যাবে প্রতিকূল পরিবেশ না হলে? তারা বলেন, শ্রীনগরে এখনো অনেক কাশ্মীরি পণ্ডিত বসবাস করছেন। কিন্তু সে তো সংখ্যালঘু হিসেবে। বাকি বিপুল জনগোষ্ঠী জম্মু বা ভারতের অন্য এলাকায় চলে যেতে থাকবে কেন ১৯৯০ সালের পর থেকে!

এ প্রশ্নের উত্তর অনেকের জানা নেই বা জানা থাকলেও বলতে চাইছেন না। তবে সাধারণ জনগণ বলেন তারা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মিলেমিশে আছেন।        

আজ বিকেলে একজন বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে। আমাদের হাউসবোটের পরের হাউসবোটে থাকতেন তিনি। মৃতদেহ নিয়ে আসা হলো নৌকা করে। বড় নৌকা, সঙ্গে তার ছেলেমেয়েরা ছিল। মহিলারা চিৎকার করে কাঁদছিলেন। একটু বাদেই মাঝারি সাইজের একটা হাউসবোট এলো লেকে ভাসতে ভাসতে যারা মরদেহ দেখতে এসেছে তাদের বসানোর জন্য। একটার পর একটা নৌকা ভরে মানুষজন আসছেন মৃতদেহ দেখতে, আগরবাতির সুগন্ধে সন্ধ্যাটা অচেনা অচেনা লাগছে। বাদ এশা দাফন হবে কাছের একটি কবরস্থানে।

ডাল লেক

অবরোধের মাঝেই অনেক শিশু জন্ম নিয়েছে, বেড়ে উঠছে। কারফিউ চলাকালীন বিয়ের অনুষ্ঠান স্থগিত রাখা হয়েছে। কয়েকজনের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে, তবে ক্ষুদ্র পরিসরে। এসময় বাজারে সব জিনিস পাওয়া যায় না আর অনুষ্ঠানের সময় হঠাৎ কারফিউ জারি হলে অতিথিরা কে কোথায় যাবে! গতকাল খুলে দেওয়া ল্যান্ডলাইন কানেকশন আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।  

২৬ অগাস্ট ২০১৯। আজ সকাল দশটায় আমার ফ্লাইট শ্রীনগর এয়ারপোর্ট থেকে। ছয় দিন খুব দ্রুত পার হয়ে গেলো। কারফিউ অবস্থা জারি থাকলে আর আসার সম্ভাবনা নেই কাশ্মীরে। বোলভার্ড রোড পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসতে আমার সঙ্গে আসলো আঙ্কেল, শেহজাদ আর জুনেয়েদ। সেখানে যথাসময়ে গাড়ি নিয়ে হাজির ইরফান ভাই।

আমি শেহজাদ আর জুনেয়েদকে বললাম, আশা করছি পরেরবার আসলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার কাশ্মীর দেখব। তারা দুজনই নিশ্চুপ রইল। পথে যথারীতি মানুষজনের চিহ্ন নেই। এরকম সকাল এবার বেশ কয়েকবার দেখা হলো।

এয়ারপোর্টে ঢোকার এক কিলোমিটার আগে একবার গাড়ি চেক করা হলো, সঙ্গে আমার লাগেজ স্ক্যান হলো। এয়ারপোর্টে ঢুকে আবার লাগেজ, হ্যান্ড লাগেজ স্ক্যান হলো। এরপর আরেকবার লাগেজ স্ক্যান করল এয়ারলাইন কোম্পানি। সবশেষে সিকিউরিটি চেকের সময় আমার হ্যান্ড লাগেজ খুলে সব জিনিস বের করে খুঁটে খুঁটে দেখা হলো।

শ্রীনগর, প্লেনের জানালা থেকে

আমার হ্যান্ড লাগেজের ব্যাকপ্যাকে কী কী থাকে নিজেরই মনে থাকে না, অল্প দিন ট্রাভেল করলে এই ব্যাকপ্যাকই আমার সংসার হয়ে যায়। কাঠের চপস্টিক যে বহু আগে রাখা মনে নেই। ফেলে দেওয়া হলো। ক্যামেরা অন করে দেখাতে হলো এবং এরপর মুক্তি মিলল।

ফ্লাইটে বসার আগেই দেখি জানালা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বুঝলাম যাবার পথেও নিরাপত্তা রক্ষার খাতিরে প্লেনের জানালা বন্ধ রাখতে হবে। ফ্লাইট টেইক অব করার পাঁচ মিনিট পর আমি খটাস করে জানালা খুলে দিলাম, উঁকি দিলাম আমার প্রিয় ভূমিকে দেখার জন্য। এক পরম মমতায় বিদায় জানালাম এ অসম্ভব সৌন্দর্যমণ্ডিত ক্ষত-বিক্ষত ভূমিকে।

ফিরে আসার পর রোজই চেষ্টা করেছি ল্যান্ডলাইন নম্বরে কাশ্মীরে কথা বলার। পহেলা সেপ্টেম্বর কথা হয়েছিল হুসেন আঙ্কেলের সঙ্গে। তিনি বললেন অবস্থা আগের মতোই আছে। এরপর ল্যান্ডলাইন নম্বরটি আবার নীরব হয়ে গিয়েছে। আমার এ লেখাটি কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষণ বা সাংবাদিকের প্রতিবেদন নয়, নেহাতই একজন ভ্রমণার্থীর ডায়েরি।

আগের পর্ব

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!