অবরুদ্ধ কাশ্মীরে ছয় দিন: পর্ব ৫

[বাংলাদেশের শিক্ষার্থী ফাতিমা জাহান ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস এর ওপর পিএইচডি করেছেন ভারতের ব্যাঙ্গালুরু ইউনিভার্সিটিতে। ভারতের সংবিধান থেকে বিশেষ মর্যাদা রদ করায় ‘ভূস্বর্গ’ যখন নিরাপত্তার বেড়াজালে অবরুদ্ধ, ওই সময় ছয় দিন ঘটনাচক্রে কাশ্মীর ঘুরে এসেছেন তিনি। থমথমে কাশ্মীরে সেই ছয় দিনের অভিজ্ঞতা তিনি ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জন্য।]

ফাতিমা জাহানফাতিমা জাহানভারতের ব্যাঙ্গালুরু থেকে
Published : 24 Sept 2019, 04:05 AM
Updated : 24 Sept 2019, 04:29 AM

পঞ্চম দিন: শ্রীনগর থেকে পেহেলগামের পথে পথে চেকপয়েন্ট

২৪ অগাস্ট ২০১৯

ভোর পাঁচটার আগেই ঘুম থেকে উঠে বসে আছি পেহেলগাম যাবো বলে। আমি আলাদা একটা হাউসবোটে থাকি। সদর দরজা ভেতর থেকে আটকে দেই। কাশ্মীরের কোথাও চুরি, ডাকাতি, খুন, ধর্ষণের রেকর্ড নেই। মিলিট্যান্টরা সাধারণ মানুষের বাড়িতে হামলা করে না। অবশ্য গ্রাম-গঞ্জের মানুষ তাদের সব রকমের সহায়তা করে, মানে যতটুকু পারে।

হাউসবোটের বারান্দায় বসে সূর্যোদয় দেখলাম। এখন রাতের তাপমাত্রা ১০/১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে, আমাদের দেশের ডিসেম্বর মাসে যেমন। লেকের স্থির জল দেখে ছোটবেলায় শীতকালে দাদাবাড়ির কথা মনে পড়ল, দাদাবাড়ির পুকুরের জলও এমনই স্থির ছিল।

হুসেন আঙ্কেল চলে এসেছেন ফজরের নামাজ পড়ে। গতকাল রাতে ট্যাক্সিচালক ইরফান ভাই এসে কথা বলে গিয়েছেন। বলেছিল ক্যামেরা সঙ্গে না নিতে, শুধু মোবাইল সঙ্গে নিতে। এবার ক্যামেরায় কোনো ছবি তোলা হয়নি।

হুসেন আঙ্কেল নৌকা করে আমাকে দিয়ে আসলেন বোলভার্ড রোড অবধি। সেখানে ইরফান ভাই অপেক্ষা করছিলেন। হুসেন আঙ্কেল চলে গেলেন। গাড়িতে বসামাত্র ইরফান ভাই বললেন, আপনি আইডি কার্ড নিশ্চয়ই এনেছেন। আমি হ্যাঁ বললাম। আবার বললেন দেখা যাক কতোদূর যাওয়া যায়।

পেহেলগাম যাবার পথে

আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছে বোধহয় এখন। বললাম, যাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। শ্রীনগর থেকে পেহেলগামের দূরত্ব প্রায় নব্বই কিলোমিটার। পাহাড়ি পথ, তাই যে কোনো গাড়িকে পাহাড়ের গা বেয়ে ঘুরে ঘুরে যেতে হয়। এ কারণে সময় একটু বেশি লাগে।

ভোরের শ্রীনগর দেখেছি, কিন্তু এবার মনে হচ্ছে এ শহরটা সম্পূর্ণ ঘুমে তলিয়ে গিয়েছে। কোনো পথচারী নেই, কোনো দোকান খোলা নেই, নেই কোনো যানবাহন। পথে সেনাবাহিনী আটকালে কী বলবো তাও গতকাল থেকে মনে মনে আওড়াচ্ছি। মিথ্যা বলতে পারি না। ধরা পড়লেও পড়তে পারি। সাংবাদিকদের চলাচলে বাধা নেই, তবে গুটিকয়েক সাংবাদিক অবাধ চলাচলের অনুমতি পেয়েছেন। আমি তো সাধারণ মানুষ। আটকে দিলে আর আমার কথাবার্তায় সন্দেহ হলে কোথায় যে পাঠাবে কে জানে!

এও এক ধরনের অনিশ্চয়তা। শ্রীনগর শহর ছেড়ে একটু একটু পাহাড় আর প্রকৃতির দিকে চলছি। রাস্তার দু’পাশে সেনাসদস্যরা ডিউটিতে আছেন। ইরফান ভাই বললেন কাশ্মীরের কোনো পাহাড়, জঙ্গল বা গ্রাম এখন অরক্ষিত নয়, সেনাসদস্যরা তাতে পাহারা দিয়ে যাচ্ছেন।

শহর ছেড়ে কুড়ি কিলোমিটারের মতো পার হয়েছি। গাড়ি থামানো হলো। ইরফান ভাই গাড়ির কাগজপত্র দেখালেন, বললেন ট্যুরিস্ট নিয়ে যাচ্ছি। গাড়ির উপর নিচে বম্ব ডিটেক্টর দিয়ে চেক করা হলো। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস না করে ছেড়ে দেওয়া হলো। যতই এগোচ্ছি ততই যেন প্রকৃতি তার স্বকীয়তা উজাড় করে দিচ্ছে। চিনার, দেবদারু, পাইন গাছেরাও পরিবেশের চেয়ে আরো শান্ত হয়ে গিয়েছে।

চিনার পাতার রঙ বদলাচ্ছে। একটু লালচে হলুদ রঙ এখন, আমার খুব প্রিয়। কিন্তু আমি বাইরের তেমন কোনো দৃশ্যই দেখছি না। আমার চোখ সামনের রাস্তায়, যাতে ঠিক মতো পথটা পার হতে পারি। ইচ্ছে করছিল গাড়ি থামিয়ে কয়েকটা ঝরে পড়া চিনার পাতা তুলে নেই। গাড়ি থামাতেও চাইছি না, আটকে পড়ি যদি! ছবি তুলছি না। পেহেলগামের অনেক ছবি আগে তোলা আছে। ছবি তুলতে গিয়ে কোনো সেনাসদস্যের আপত্তির মুখে পড়তে পারি।

আরো ৫/৬ কিলোমিটার পথ চলার পর আবার গাড়ি থামানো হলো। এবার আমাকে নিচে নামতে বললেন অফিসার। আমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হলো। ইরফান ভাইকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করে আমাকে শুরু করলেন-

কোথায় যাচ্ছেন?

পেহেলগাম।

কেন যাচ্ছেন?

আমার এক বন্ধুর বাড়িতে।

জানেন তো এখন কারফিউ চলছে, তাও কেন যাচ্ছেন?

কারফিউ যেদিন তুলে নেওয়া হয়েছিল তার দু'দিন পর রওনা হয়েছি আমার শহর থেকে। জানতাম না যে পরে আবার কারফিউ জারি হবে।

আইডি কার্ড দেখান।

আইডি কার্ড নেড়েচেড়ে এমনভাবে দেখলেন যেন আইডি কার্ডের ভেতরে কোনো কোড ওয়ার্ড লুকিয়ে রেখেছি।

ব্যাঙ্গালুরু থাকেন?

হ্যাঁ।

মুসলমান?

হ্যাঁ, মুসলমান পরিবারে জন্ম।

একা কেন সফর করছেন?

কেউ আসতে চাইছিলো না তাই।

আপনি বিবাহিত?

আমি সিঙ্গল।

পেহেলগামে কি আপনার বয়ফ্রেন্ড থাকে?

জ্বি না।

আপনি কি সাংবাদিক?

না।

তাহলে কেন যাচ্ছেন?

বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। শুনেছি সে অসুস্থ। এখন কেমন আছে জানি না। কুড়ি দিন ধরে ফোন লাইন বন্ধ। আমাকে যেতে দিলে কৃতজ্ঞ থাকব।

বন্ধুর বাড়ির ঠিকানা দিন।

ডাল লেক

ঠিকানা দিলাম এক পরিচিত হোটেল মালিকের। ধরা পড়লে কী অবস্থা হবে এই মুহূর্তে চিন্তা করতে চাইছি না। এবার আমি ভালোভাবে অফিসারকে দেখলাম। হিন্দি উচ্চারণ শুনে আর চেহারা দেখে মনে হলো তিনি দক্ষিণ ভারতীয়। এবার আমি জিজ্ঞেস করলাম-

আপনি কি দক্ষিণ ভারতীয়?

হ্যাঁ।

কোথায় বাড়ি আপনার?

গুলবারগা (কর্ণাটকের একটি জেলা)।  

আমি গিয়েছি সেখানে। খুব সুন্দর জায়গা। অনেক শিক্ষিত মানুষের বসবাস।

আমি হিন্দি ছেড়ে চট করে কন্নড় ভাষায় বললাম, কতদিন ধরে কাশ্মীরে ডিউটিতে আছেন স্যার?

অফিসার অবাক হলেন একটু আর এর মাঝে আমি আশপাশে চোখ বুলিয়ে নিলাম। কয়েকজন অফিসার গোল করে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন, বুঝেশোনে আলোচনা চালাতে হবে।

অফিসার কন্নড় ভাষায় জবাব দিলেন, দু’মাস ধরে এখানে আছি।

আমাদের ছেড়ে দিন স্যার। আজকের মধ্যেই ফেরত আসব। আগামীকাল আমি ব্যাঙ্গালুরু চলে যাচ্ছি। এবারের পর আবার কবে আসতে পারবো তার ঠিক নেই।

দক্ষিণ ভারতে আমি তাদের ভাষা বলতে জানি বলে অনেক ভালোবাসা, সুবিধা পেয়েছি।   

যখন আমাদের ছেড়ে দেওয়া হলো তার বেশ কিছুক্ষণ পরও আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না যে আমরা পেহেলগামের দিকে এগুচ্ছি। অফিসারকে আমি কনভিন্স করার জন্য আরো অনেক কিছু বলেছিলাম, কিন্তু টেনশনে তার কিছুই এখন মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে বলেছিলাম যে- সব মুসলিম নামধারী যে সন্ত্রাসী হবে তা তো নয়, কাশ্মীরের সবাই কি সন্ত্রাসী?      

গাড়ি এগুচ্ছিল, কিন্তু বাইরের কোনো দৃশ্যে আমার মনোযোগ নেই। এবার একটু ভয় পেয়েছিলাম। আটকে রেখে দিলে আমাকে ছাড়ানোর জন্য কাউকে পাওয়া যাবে না। পরিচিতরা জানে না আমি কাশ্মীর এসেছি। জানলে কেউ আসতে দিতো না। গাড়ি চলছে পুলওয়ামা পার হয়ে আনান্তনাগ এলাকার দিকে। আনান্তনাগকে বলা হয়ে থাকে কাশ্মীরের ‘ডেঞ্জার জোন’। এ এলাকায় সবচেয়ে বেশি মিলিট্যান্ট হামলা হয়। গত মে মাসে মিলিট্যান্ট আর সেনাবাহিনীর ক্রসফায়ারের ঘটনা পড়েছি খবরে।

খুব বেশি হলে আরো আট কিলোমিটার পথ চলেছি, আবার গাড়ি থামানো হলো। আবার প্রশ্নোত্তর পর্ব। এবারের অফিসারের বাড়ি উত্তর প্রদেশ। সেই অফিসার বললেন, আপনাকে আমরা যেতে দিতে পারছি না। আপনি শ্রীনগর ফিরে যান।

আমি অনুরোধ করছিলাম আর বোঝাতে চাইছিলাম পেহেলগাম যাওয়া আমার জন্য জরুরি। কিন্তু এতে অফিসারের মন গললো না। অগত্যা আমরা ফিরে যেতে বাধ্য হলাম।

ফেরার পথেও আরো এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। গন্তব্যের কাছাকাছি গিয়ে ফিরে আসায় এমনিতেই হতাশ হয়েছিলাম। এত এত সওয়াল-জবাবে মন বিষিয়ে যাচ্ছিল, বিরক্তও হচ্ছিলাম। তাও মাথা ঠাণ্ডা রাখা জরুরি ছিল। তাদের পছন্দ না হলে ধরে নিয়ে উগ্রবাদী সন্দেহে জেলে পুরে দেবে এবং এরপর আর খোঁজ পাওয়া যাবে না। ইরফান ভাইয়ের বিবি-বাচ্চা আছে, তাকেও আমার দুঃসাহসিকতার খেসারত দিতে হবে একসঙ্গে।

হাউসবোটে ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে গেল। ফিরে আসার পর দেখি বাড়ির সবাই খুব খুশি। খেয়ে-দেয়ে খবরের কাগজ নিয়ে বসলাম। আজকের স্থানীয় কাগজে অনেক খবর আছে দেখছি। কয়েকটি শিরোনাম- শ্রীনগরে ইউনাইটেড নেশন অফিসের রাস্তা ব্লক করে দেওয়া হয়েছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন তিনি কাশ্মীরের ব্যাপারে যথেষ্ট অবগত এবং ফোকাসড, জি৭ সম্মেলনে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ ভারত ও পাকিস্তানকে সম্মিলিতভাবে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করতে বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন কাশ্মীরে অস্থায়ী আইন সরাতে ৭০ বছর সময় লেগেছে, কংগ্রেসের পি চিদাম্বরমকে গতকাল গ্রেপ্তার করা হয়েছে মানি লন্ডারিং-এ সম্পৃক্ত থাকার জন্য।

কাশ্মীরে হোটেল ব্যবসায় ধস নেমেছে। সব হোটেল বন্ধ করে সিল করে দেওয়া হয়েছে। আজ দেহাবসান হলো বিজ্ঞ নেতা অরুণ জেটলির, তাঁর মৃত্যু ঘটে চিকিৎসারত অবস্থায় দিল্লীর এইমস হাসপাতালে, বিদেশের কোনো হাসপাতালে নয়। রাহুল গান্ধীসহ কয়েকজন বিরোধী দলের নেতার আজ শ্রীনগর আসার কথা। তবে জনগণ বলছে তাদের এয়ারপোর্ট থেকেই নাকি ফেরত পাঠানো হবে।

হলোও তাই,  দুপুর তিনটায় টেলিভিশনে খবরে দেখা গেলো রাহুল গান্ধীর দলকে শ্রীনগর এয়ারপোর্ট থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এদিকে আঙ্কেল জানালেন স্থানীয় সবজির দাম দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। ব্যবসায়ীরা স্টক করা শুরু করে দিয়েছে সবজি। কারণ সামনে কেমন সময় আসে তার ঠিক নেই। বাইরের রাজ্য থেকেও সবজি আসবে কিনা তারও ঠিক নেই।    

নেহরু পার্কে মাছ ধরতে আসা ছেলেটি

বিকেলে শিকারা করে বেড়াতে গেলাম আমি আন্টি আর রাজিয়া। রাজিয়া, যে থাকে অন্তরালেই। অন্দরমহল থেকে বের হয় না তেমন, হাউসবোটে থাকার কারণে স্থলজীবন দেখা হয় না। এখনো কৈশোরের চাপল্য আঁকা আছে তার সারা মুখে, তার চঞ্চলতায়। সে বয়সে আমি পুরোদমে পড়াশোনা, হৈহল্লা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড যখন যা ইচ্ছে করেছি। আমাদের স্বাধীনতার কথা ওদেরকে বলতে সংকোচ হয়। আমি নিজে অপরাধবোধে ভুগি রাজিয়ার সামনে, এত বিভাজনে সমাজ কি এগোয়!

আন্টি নৌকা চালিয়ে নিয়ে গেলেন নেহরু পার্কে। নেহরু পার্কে একটা বাচ্চা ছেলের সঙ্গে দেখা হলো, মাছ ধরছিল, ৯/১০ বছর বয়স হবে। জিজ্ঞেস করলাম স্কুলে যায় কিনা। সে বলল- না।

একসময় কাশ্মীরের অবস্থা এত খারাপ ছিলো না। এখন যুদ্ধ বিগ্রহ, অবরোধে সে অবস্থা আর নেই। বাচ্চাটির নিষ্পাপ হাসি এখনো বলতে অপারগ তার ভবিষ্যতে কী আছে। তারপর গেলাম আন্টির বড় বোনের হাউসবোটে। এদের হাউসবোট কমিউনিটিতে সবারই কাছাকাছি বিয়ে হয়।

সন্ধ্যার পর ফিরে আসলাম। শহরের অবস্থা আগের মতোই। খুব জলদি অবস্থা বদলাবে বলে মনে হয় না।

চলবে...

আগের পর্ব

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!