অবরুদ্ধ কাশ্মীরে ছয় দিন: পর্ব ৩

ফাতিমা জাহানফাতিমা জাহানভারতের ব্যাঙ্গালুরু থেকে
Published : 22 Sept 2019, 06:10 AM
Updated : 22 Sept 2019, 06:10 AM

[বাংলাদেশের শিক্ষার্থী ফাতিমা জাহান ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস এর ওপর পিএইচডি করেছেন ভারতের ব্যাঙ্গালুরু ইউনিভার্সিটিতে। ভারতের সংবিধান থেকে বিশেষ মর্যাদা রদ করায় ‘ভূস্বর্গ’ যখন নিরাপত্তার বেড়াজালে অবরুদ্ধ, ওই সময় ছয় দিন ঘটনাচক্রে কাশ্মীর ঘুরে এসেছেন তিনি। থমথমে কাশ্মীরে সেই ছয় দিনের অভিজ্ঞতা তিনি ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জন্য।] 

তৃতীয় দিন: পত্রিকায় কেবল ভারতের উন্নয়নের খবর

২২ অগাস্ট ২০১৯

‘জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট’ (জেকেএলএফ) এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে, ১৯৭৭ সালে। প্রতিষ্ঠাতা কাশ্মীরি বংশদ্ভূত আমানুল্লা খান আর মকবুল ভাট স্বপ্ন দেখেছিলেন অখণ্ড কাশ্মীরের।

রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও মূল উদ্দেশ্য ছিল মিলিট্যান্ট তৈরি করা। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে জেকেএলএফ এর শাখা বিস্তৃত হয় অল্প কিছু সময়ের মধ্যে। কয়েক বছরের মধ্যে দলটির সশস্ত্র শাখার ঘোষণা দেওয়া হয়। ভারতে প্লেন হাইজ্যাক বা ক্রিকেট খেলার মাঠে বোমা বিস্ফোরণসহ কয়েকটি ঘটনা ঘটায় এ দলটি।

১৯৮৪ সালে আমানুল্লাহ খান ও মকবুল ভাটকে যুক্তরাজ্য সরকার সে দেশ থেকে বের করে দিলে তারা পাকিস্তানে আশ্রয় নেন। ওই সময়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ জিয়া-উল-হক তাদের সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন। ইতোমধ্যে ভারত অধ্যুষিত কাশ্মীরের অসন্তুষ্ট যুবকেরা সীমানা পেরিয়ে পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মীরে এসে জেকেএলএফ-এ যোগ দেয় ও অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেয়।

প্রশিক্ষণ শেষে তারা অস্ত্র নিয়ে ভারত অধ্যুষিত কাশ্মীরে চলে যায়। ইয়াসিন মালিক, হামিদ শেখ, আশফাক ওয়ানী ও জাভেদ আহমেদ মীর পাকিস্তান থেকে ফিরে গিয়ে ভারতে একটি দল গঠন করে। কাশ্মীরের আপমর জনসাধারণের কাছ থেকে আশাতীত রকমের সমর্থন পায় এ দলটি। জনতা ভাবতে থাকে এরাই বুঝি কাশ্মীরকে স্বাধীন করবে এবার।

১৯৯০ সাল পর্যন্ত দলটি যেমন সংখ্যায় ভারি হতে থাকে তেমনি ভারত অধ্যুষিত কাশ্মীরের বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমন চালায় এবং সফল হয়। দলের সব সদস্যকে বেনামে চলাফেরা করতে হয় অথবা গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হয়। ১৯৯২ সালের মধ্যে ভারত সরকার বেশিরভাগ মিলিট্যান্টকে আয়ত্তে আনতে সক্ষম হয়। ইয়াসিন মালিক ছাড়া অন্য নেতারা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় বা জেলের ভেতর মারা যায়।

এক্ষেত্রে পাকিস্তান নীরব ভূমিকা পালন করে, কারণ আজাদ কাশ্মীর পাকিস্তানের উদ্দেশ্য নয়। পাকিস্তান কিছু শর্ত সাপেক্ষে জেকেএলএফ-কে সাহায্য করতে রাজি ছিল, কিন্তু কোনভাবেই সম্পূর্ণ স্বাধীন হতে দিয়ে নয়। পাকিস্তানের কাছ থেকে তাই আর্থিক সাহায্য আসাও বন্ধ হয়ে গেলো। এদিকে ভারতের মুসলমান নেতাদের সমর্থনও পাওয়া গেলো না সেই মুহূর্তে। তাই ইয়াসিন মালিক শান্তিপূর্ণ সমঝোতার পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিলেন। জেকেএলএফ ভাগ হয়ে গেলো ভারত আর পাকিস্তান দুটো আলাদা দল হিসেবে।

২০০৫ সালে ইয়াসিন মালিক প্রথমবারের মতো পাকিস্তান সফরে যান একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে। সেখানে তিনি আমানুল্লাহ খানের সঙ্গে দেখা করেন এবং দু’জনের ভেঙে যাওয়া রাজনৈতিক দল আবার জোড়া লাগে। এতে ভারত অধ্যুষিত কাশ্মীরের যুবক নেতারা নাখোশ হয়ে আরেকটি দল গড়েন। বর্তমানে ইয়াসিন মালিক গৃহবন্দি অবস্থায় রয়েছেন অথবা তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে রাখা হয়েছে।

শিকারায় ফেরি করে বেড়ানো বিক্রেতা

এ মুহূর্তে ইয়াসিন মালিক বা অন্য কোনো রাজনৈতিক নেতার কোনো ধরনের খবর প্রকাশ করা হচ্ছে না। জেকেএলএফ এর কিছু কিছু ঘটনা শুনলাম নাস্তা খেতে খেতে। আমরা সবাই একসঙ্গে খেতে বসি। সারাদিনই গল্প আলোচনায় কাটে। বাড়ির সদস্যদের এখন কোনো কাজ নেই।

এসময়ে ডাল লেকের সকাল শান্ত আর শীতের আমেজ এনে দেয়া। এখানে বাইরের গাড়িঘোড়ার কোনো শব্দ আসে না। হাউসবোটটা লেকের একদম ভেতরে। বোলভার্ড রোডের অপর পাশের হাউসবোটগুলো হয়তোবা লোকেশনের দিক দিয়ে ভালো। কিন্তু কোলাহলমুক্ত নয়। চার বছর আগে এ হাউসবোটের খোঁজ পেয়েছিলাম অনলাইনে। তখন থেকে হুসেন আঙ্কেলের পরিবার আমার আত্মীয়ের মতো হয়ে গিয়েছে। আমি নির্দ্বিধায় সোজা তাদের অন্দরমহলে ঢুকে যাই। আমাকে তারা ট্যুরিস্টও মনে করে না। দুই বছর আগে একবার এখানে এসে থেকে গেছি।  

নাস্তা সেরে বারান্দায় বসলাম। সারাদিনই হাউসবোটের বারান্দায় বসে থাকি। শিকারা নিয়ে বিক্রেতারা আজ দেখি বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল শুরু করেছেন, মেয়েদের হাল ফ্যাশনের গহনা, শার্ট প্যান্টের কাপড়, সবজি, ফল ইত্যাদি। আমার হাউসবোটের উল্টোদিকের হাউসবোটে একটা ছেলে সুইডিশ মেয়ে বিয়ে করেছে। মেয়েটা এখানেই থাকে এখন, একটা বাচ্চাও আছে তাদের। এতো শান্তির পরিবেশ ছেড়ে যেতে চায়নি বোধ হয়।

আজ কিছুক্ষণ পর পর হেলিকপ্টার যাওয়া আসার আওয়াজ আর পুলিশের গাড়ির সাইরেন শোনা যাচ্ছে। আঙ্কেল আমাকে বললেন, হেলিকপ্টার চলাচল করলে ভেতরে গিয়ে বসতে। কখন কী অবস্থা হয় কেউ বলতে পারে না। আজ হেলিকপ্টার একটু বেশি চলাচল করছে। কারণ হতে পারে দক্ষিণ কাশ্মীরের দিকে খাবার বা অস্ত্র সরবরাহের জন্য অথবা হতাহত সেনাসদস্য হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য। শহর থেকে বোঝা না গেলেও গ্রামের দিকে মিলিট্যান্টরা বেশ তৎপর। মিলিট্যান্টরা সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়লে সরাসরি মেরে ফেলা হয়। আচ্ছা, মিলিট্যান্টদের বাংলায় কি নামে ডাকা যায়! মুক্তিসেনা না শুধু মুক্তি!

সিভিল কারফিউ জারি আছে এখনো শহরে। সরকার কারফিউ তুলে নেবার পর এ অঞ্চলের জনগণ প্রতিবাদ হিসেবে নিজেরাই কারফিউ জারি করেছে। অবশ্য আগামী এক ঘণ্টার মধ্যে আবার কারফিউ জারি হতে পারে সরকারের পক্ষ থেকে। কারফিউ তুলে নেবার পরপরই আবার কারফিউ জারি হবার নজির অনেক।

সিভিল কারফিউ দিলে জনগণের কেউ দোকানপাট খোলে না, কারো বাচ্চাকে স্কুল, কলেজে পাঠায় না। কোনো ব্যবসা চলছে না, নেহাতই সরকারি চাকুরে যাদের চাকরিতে যোগদান না করলেই নয় আর ডাক্তার ছাড়া কেউ অফিসে যাচ্ছে না। যদিও টেলিভিশনের খবরে দেখানো হচ্ছে যে স্কুল, কলেজ, অফিস সব খোলা। কিন্তু কেউ যে যাচ্ছে না তা আর দুনিয়ার সামনে দেখানো হচ্ছে না।

কারফিউয়ের সময় হাসপাতাল খোলা আছে, তবে নেহাতই প্রয়োজন ছাড়া কেউ যাচ্ছে না। পুরো কাশ্মীরে হাসপাতাল আছে হাতে গোনা কয়েকটি। বাংলাদেশের বেশকিছু মেডিক্যাল কলেজে কাশ্মীরের অনেক ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও আছেন কাশ্মীরি ছাত্র। যারা ধনী তারা সন্তানকে কাশ্মীরের বাইরে পাঠিয়ে দেন পড়াশোনা করার জন্য, পড়া শেষে চাকরিও করে সেখানে, যাতে ফিরে আসতে না হয়। ব্যাঙ্গালুরুতে আমার সহপাঠী, সিনিয়র, জুনিয়র কয়েকজন কাশ্মীরি ছাত্র ছিল।

দুপুরের খাবার খেতে খেতে হুসেন আঙ্কেলের কাছে মিলিট্যান্টদের কিছু গল্প শুনলাম। ১৯৯৪ সালে আঙ্কেল কিছু বিদেশি ভ্রমণার্থী নিয়ে যাঁন্সকার হয়ে লাদাখ ট্রেকে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে চারটা ঘোড়া, খাবার আর মালপত্র বহন করার জন্য। পথিমধ্যে কয়েকজন মিলিট্যান্ট পথ রোধ করে। দেখা তো এমনিতে হয় না, এরা হুটহাট করে নিজেদের প্রয়োজনে দেখা দেয়। বিদেশি বা দেশি ভ্রমণার্থীদের কাছ থেকে টাকাপয়সা আদায় করে।

মিলিট্যান্টরা ঘোড়াওয়ালাকে দেখে দিলো লম্বা এক স্যালুট। ভ্রমণার্থীরা তো অবাক। এই লোক নাকি গুজ্জুর এলাকার মিলিট্যান্ট চিফ কমান্ডার, পাকিস্তানে দুইবার গিয়েছিল ট্রেনিং নিতে। অল্প কিছুক্ষণ বাতচিত করে ছেড়ে দেওয়া হয় ট্রেকিং দলটিকে। এদের উদ্দেশ্য ছিল দলটির কাছ থেকে মোটা অংকের চাঁদা আদায় করা। চাঁদা তুলতে দেয়নি ঘোড়াওয়ালা।

মাগরেবের পর মসজিদে দোয়া দরুদ পড়া শুরু হয়েছে যথারীতি। আগামীকাল শুক্রবার, জুম্মা নামাজের দিন। অবস্থা বেগতিক হলে শুক্রবার রাজ্যে কারফিউয়ের সঙ্গে সঙ্গে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। টিয়ার গ্যাস, পিপার স্প্রে, সাউন্ড বম্ব ছোড়া হয় কিছু হলে বা না হলেও। কত শত যে গ্রেপ্তার হয় তার ইয়ত্তা নেই। ১৯৯৪ সালে মিলিট্যান্ট সংখ্যায় বেড়ে গিয়ে সরাসরি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে নামে। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। 

কোনো এলাকায় মিলিট্যান্ট আছে সন্দেহ করলে, যেকোন একটা বা দুটো বাড়িতে মিলিট্যান্ট খুঁজে না পেলে সেনাবাহিনী পুরো গ্রাম মর্টার দিয়ে ধ্বংস করে দেয়। কোনো গ্রামে মিলিট্যান্ট আশ্রয় নিলে সেনাবাহিনীকেও  গ্রামবাসী পরোয়া করে না। সেনাবাহিনী মিলিট্যান্ট গ্রেপ্তার করতে আসলে যে বাড়িতে মিলিট্যান্ট আছে সে বাড়ির চারপাশ পুরো গ্রামবাসী ঘিরে রাখে আর আর্মি তখন সবাইকে সুদ্ধ মর্টার চালায়। ফলাফল অনেক মানুষের মৃত্যু। মিলিট্যান্টরা কাশ্মীরবাসীর কাছে এক ভালোবাসার নাম। কোনো মিলিট্যান্ট কোনো কাশ্মীরির বাড়ি গিয়ে খালি হাতে ফিরে আসে না।

ইয়াসিন মালিক, শাবির শাহ প্রমুখ নেতাদের ‘পাকিস্তানি দালাল’ অপবাদ দিয়ে ভারত সরকার বহুবার গ্রেপ্তার করেছে। এখন তারা গ্রেপ্তার হয়ে জেলে আছেন না গৃহবন্দি অবস্থায় আছেন তা কেউ জানে না। এরা প্রথমে মিলিট্যান্ট ছিলেন, পরে প্রকাশ্যে শান্তিপূর্ণভাবে রাজনীতি করার ঘোষণা দেন। কিন্তু কাশ্মীরের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। ফারুক আব্দুল্লাহ প্রমুখের মতো ভারত সরকারের পক্ষে থাকা নেতাদের কাশ্মীরের ইতিহাসে এই প্রথম গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে ইসলামি দলের নেতা জিলানী গত ১০ বছর ধরেই গৃহবন্দি আছেন।

স্থানীয় খবরের কাগজ পাওয়া যাচ্ছে, তবে তা ১৬/১৮ পাতার জায়গায় এখন ৪/৬ পাতার করে দেওয়া হয়েছে, সেখানে ভারতের উন্নয়ন ছাড়া আর কোনো খবর নেই।

চলবে....

আগের পর্ব

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!