অবরুদ্ধ কাশ্মীরে ছয় দিন: পর্ব ২

ফাতিমা জাহানফাতিমা জাহানভারতের ব্যাঙ্গালুরু থেকে
Published : 21 Sept 2019, 05:37 AM
Updated : 22 Sept 2019, 04:12 AM

[বাংলাদেশের শিক্ষার্থী ফাতিমা জাহান ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস এর ওপর পিএইচডি করেছেন ভারতের ব্যাঙ্গালুরু ইউনিভার্সিটিতে। ভারতের সংবিধান থেকে বিশেষ মর্যাদা রদ করায় ‘ভূস্বর্গ’ যখন নিরাপত্তার বেড়াজালে অবরুদ্ধ, ওই সময় ছয় দিন ঘটনাচক্রে কাশ্মীর ঘুরে এসেছেন তিনি। থমথমে কাশ্মীরে সেই ছয় দিনের অভিজ্ঞতা তিনি ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জন্য।]

দ্বিতীয় দিন: ২১ অগাস্ট ২০১৯

মসজিদে মসজিদে দরুদ পড়া শুরু

ব্যক্তিগত জীবনে আমার কোনো কাজের তাড়া নেই। আর কারফিউয়ের কারণে কোথাও যাবারও পরিকল্পনা নেই। যা বেড়াবার সে তো আগে কয়েকবার এসে বেড়িয়ে নিয়েছি। অখণ্ড অবসর আমার।

হুসেন আঙ্কেলের দুটো হাউসবোটের একটিতে তারা নিজেরা থাকেন, আরেকটি রেখেছেন ট্যুরিস্টদের জন্য। আমি এখন আছি ট্যুরিস্টদের বিশাল হাউসবোটে, একা। কেউ জিজ্ঞেস করলে আঙ্কেল বলেন আমি তাদের আত্মীয়। সব ধরনের ট্যুরিজম বন্ধ এখন কাশ্মীরে। তবে লাদাখের অবস্থা স্বাভাবিক।

নাস্তা করতে করতে হুসেন আঙ্কেলের ছেলে শেহজাদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। গতকাল নাকি শালিমার গার্ডেনের দিকে মিছিল বের হয়েছিল। পরের খবর কেউ জানে না। কতজন গ্রেপ্তার, আহত, নিহতের সংখ্যা জানার উপায় নেই। টেলিফোন, ইন্টারনেট বন্ধ। স্প্লিন্টার, পিপার স্প্রে, টিয়ার গ্যাস আর গ্রেপ্তার হবার ভয়ে ডাল লেকের কেউ মিছিলে যায় না।

‘পাবলিক সেইফটি অ্যাক্ট’ এর কারণে মিছিল বের করার অনুমতি নেই। আগে একবার সরকার অনুমতি দিয়েছিল মিছিল করার, ২০০৮ সালে। তখন সারা শহরের মানুষ পথে নেমে এসেছিল, সাধারণ জনগণকে আয়ত্তে আনা মুশকিল হয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে সরকার আর মিছিলের অনুমতি দেয় না।

কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ চায় আজাদী। সেটা রাজা হরি সিং এর আমল থেকেই চাইছিল তারা। এখনকার লিবারাল আর কনসারভেটিভ মানসিকতার ভারতীয় জনগণ কী চায় সে বিতর্কে নাইবা গেলাম। কাশ্মীর তো কাশ্মীরিদের, তারা কী চায় সেটাই মূল বিষয়।

আজকে নাকি রেশন দিচ্ছে। রেশনের দোকানে বাজারদরের চেয়ে কম দরে চাল, আটা ইত্যাদি কিনতে পাওয়া যায়। সরকারের তরফ থেকে প্রত্যেক ভারতীয়ের জন্য রেশন-কার্ড ইস্যু করার নিয়ম আছে। কাশ্মীরে দেখলাম শুধু পুরুষদের নামেই রেশন-কার্ড আছে। নারীদের নাম পুরুষদের সঙ্গে সিরিয়াল ধরে যুক্ত করা আছে।

কাঁটাতারে ঘেরা অফিস, শ্রীনগর

হুসেন আঙ্কেলের ছোট ছেলে জুনেয়েদ সদরে গিয়ে খবর এনেছে যে আগামীকাল থেকে রেশন দেওয়া শুরু হবে। এখন রেশনে শুধু চাল দেয়। আগে আটা, চিনিও দিত। আটা, চিনি দেওয়া বন্ধ হয়েছে বছর তিনেক ধরে৷ সরকারের হুকুমের বাইরে কিছুই হয় না। এদিকে তো মুখ খোলাও নিষেধ। সোজা ধরে নিয়ে যাবে।

আমি খাবারের সময় বাদ দিয়ে বাকি সময় হাউসবোটের বারান্দায় বসে থাকি। লেক থেকে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। যে যার কাজ করতে নৌকা বেয়ে যাওয়া আসা করছে। সব হাউসবোটেরই নিজস্ব একটা নৌকা আছে। এমনকি মেয়েরাও নৌকা চালিয়ে যাওয়া আসা করে। মাঝে মাঝে এখানকার বাসিন্দারা অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, এই অবরোধের দিনে পরদেশি ট্যুরিস্ট আসলো কিভাবে!

দুপুরে কিছুক্ষণ পর পর হেলিকপ্টার দেখা যাচ্ছে, মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। আন্টি খুব ভালো রান্না করেন। প্রায় সময়ই আমি রান্নাঘরে বসে বসে আন্টি আর তার মেয়ে রাজিয়ার সঙ্গে গল্প করি। হাউসবোটের সহকারী ছেলেটি কারফিউ তুলে নেবার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি চলে গিয়েছে এই ভেবে যে পরিবারের অন্যান্যরা চিন্তায় আছে।

শেহজাদ ও জুনেয়েদ সবে ইউনিভার্সিটি শেষ করেছে। রাজিয়া স্কুল শেষ করে ঘরে বসে আছে। শহরের অস্থির অবস্থার জন্য আঙ্কেল মেয়েকে কলেজে পাঠানোর ভরসা পাননি। কারফিউয়ের সময় এখানকার নারীদের করার কিছুই থাকে না। এবার তো ইন্টারনেটও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। টেলিভিশন দেখা ছাড়া মনোরঞ্জনের কোনো মাধ্যম এখন নেই।

বিকেলে আমি বের হলাম, আঙ্কেল জুনেয়েদকে আমার সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন। না পাঠিয়েও উপায় নেই, নৌকায় চেপে স্থলে যেতে হবে, নৌকা বেয়ে নিয়ে গেলেও রাখার জায়গা কোথায় তা তো জানি না।

তীরে নেমে হাঁটলাম শহর পর্যন্ত। শহর থমথমে। বোলভার্ড রোড মানে ডাল লেক ঘেঁষা রাস্তাটায় শুধু অল্প কয়েকজন আর্মি দেখলাম। এরপর প্রতি ১০ মিটার পর পর একজন সেনাসদস্য দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় সব সরকারি অফিসের সামনে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া। আজ দেখি পথে বেশ কিছু গাড়ি, মোটরবাইক চলছে। বোলভার্ড রোডে স্থানীয় মানুষজন এসেছে ঘুরেফিরে বেড়াতে। সাধারণত বিকেলে শ্রীনগর শহর উপচে পড়ে এখানে। এখন দোকানপাট সব বন্ধ, অল্প মানুষজনের আনাগোনা, তাও সন্ধ্যা ছয়টার পর।

শ্রীনগরের একটি পাড়ার গলি

অলিগলির দু’একটা মুদি দোকান খোলা, তবে যেকোন সময় ঝাঁপি নামিয়ে দিতে পারে। গলিতে কিছু মানুষজন চলাফেরা করছে, বড় রাস্তায় কেউ হেঁটে চলাচল করছে না। হাঁটতে হাঁটতে ইউনাইটেড নেশন অফিসের সামনে গেলাম। বার্বড ওয়্যার বা কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা এখন। আমি বাইরের লোক, সন্দেহ করার আগেই আবার হাঁটতে শুরু করলাম। সেনাসদস্যরা আমাকে কিছু না বললেও জুনেয়েদকে প্রশ্ন করতে পারে। আমাকেও আলাদা নিয়ে প্রশ্ন করতে পারে। জুনেয়েদকে ধরে রেখেও দিতে পারে, তাই সামনে এগোলাম।

পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সব বন্ধ। শুধু জম্মু যাবার জন্য বাসস্ট্যান্ডে একটা শেয়ার ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখন জম্মু বাদে অন্য সব রুটের রাস্তা বন্ধ। রাস্তাঘাটে ছবি তোলা নিষেধ, সেনাসদস্যদের তো একেবারেই না। শুধু অল্প কয়েকজন সাংবাদিক ছবি তোলার অনুমতি পেয়েছেন। আমি একজন ভ্রামণিক। কারফিউ চলাকালীন ভ্রমণ করতে এসেছি শুনলে সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দেবে বা উগ্রবাদী সন্দেহে গ্রেপ্তার করবে। গ্রেপ্তারের পর সাধারণত সে মানুষের আর কোনো খবর পাওয়া যায় না।

আবার ফেরত আসলাম ডাল গেটের শেষ পর্যন্ত। অনেকটা সময় বাইরে থেকে ফের নৌকা চেপে হাউসবোটে ফিরলাম। ফেরার পর হুসেন আঙ্কেল জানালেন ডাউনটাউনে নাকি টিয়ারগ্যাস ছেড়েছে। আওয়াজ শোনা গেছে। তিনি আমাদের নিয়ে চিন্তিত ছিলেন।

মাগরেবের নামাজের পর মসজিদে মসজিদে সমানে দরুদ পড়া শুরু হয়েছে। দোয়া পড়া ছাড়া আর কিছু করারও নেই। ভালো বা মন্দ যে কোনো শব্দ মসজিদ থেকে বের হলে মসজিদে উপস্থিত সবাইকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়। আর মসজিদের ভেতর কী হচ্ছে তা জানার জন্যও সেনাবাহিনীর গুপ্তচর আছে। সব বড় মসজিদ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে কারফিউ ঘোষণা দেবার সঙ্গে সঙ্গে।

চলবে...

আগের পর্ব -

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!