বাড়ি থেকে পালিয়ে সালমান শাহ’র সিনেমা দেখার স্মৃতি

ইউটিউব, নেটফ্লিক্স আসার আগে একসময় সিডিতে সিনেমা দেখা হতো। তারও আগে সিনেমা দেখা হতো ভিসিপি এবং ভিসিআরে। তবে ভিসিআরে সাধারণত বিদেশি সিনেমাগুলো দেখা হতো। আমরা সেই প্রজন্ম যারা ভিসিআরে সিনেমা দেখে বড় হয়েছি।

মো. ইয়াকুব আলী, সিডনি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Sept 2019, 06:36 AM
Updated : 20 Sept 2019, 06:36 AM

ভিসিআরে সিনেমা দেখার ছিলো অনেক ঝক্কি। এলাকার কোন নির্দিষ্ট দোকান থেকে ভিসিআর ভাড়া করে আনতে হতো কিছু টাকা অগ্রিম দিয়ে। তারপর যাদের বাসায় টেলিভিশন আছে তাদের বাসায় সেটা সেট করা হতো আর অপেক্ষা করা হতো কখন রাত হবে এবং ভিসিআর চালানো হবে।

আমাদের সবচেয়ে বেশি ভিসিআর দেখা হতো প্রতিবেশী সালামদের বাড়িতে। সালামদের উঠোনের এক কোণে টিভির উপর ভিসিআরের বাক্সটা রাখা হতো। তারপর সাধারণত ভারতীয় বাংলা ছবির ক্যাসেট ছেড়ে দেয়া হতো। কারণ আমাদের বাবা-মায়েরা সেটা দেখে ঘুমিয়ে যাবেন। এরপর রাত বাড়ার পর একটা সময় ভিসিআর এবং টিভিকে ঘরের মধ্যে নিয়ে আসা হতো এবং তখন শুরু হতো ভারতীয় হিন্দি সিনেমা।

হাতেগোনা দু’একটা বাংলাদেশি বাংলা সিনেমা আনা হতো। তবে সেগুলোর ব্যাপারে দর্শকদের তেমন আগ্রহ দেখা যেতো না। কারণ তখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সিনেমাগুলো হলে গিয়ে সপরিবারে দেখার চল ছিলো। তাই সেগুলোকে অবশ্য ভিসিআরে পাওয়াও যেতো না। তবে দোকানিরা কিভাবে যেন দু’একটা বাংলা সিনেমার ক্যাসেট জোগাড় করতেন এবং সেগুলো লুকিয়ে রাখতেন। কেউ চাইলেই শুধু বের করে দিতেন।

‘বেদের মেয়ে জোসনার’ প্রভাব তখন কাটতে শুরু করেছে, কারণ ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছিলো তখন পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যবসাসফল বাংলা সিনেমা। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত ছিলো। যশোর মনিহার সিনেমা হলে এক সন্তানসম্ভবা ভদ্রমহিলা সিনেমা দেখতে গিয়ে হলের মধ্যেই মেয়ে সন্তানের মা হয়েছেন এবং মেয়ের নাম রেখেছেন ‘জোসনা’। ইলিয়াস কাঞ্চন এবং অঞ্জু ঘোষ সেই মেয়েকে দেখতে এসে উপহার দিয়ে গেছেন। তখনকার আড্ডার বিষয়বস্তু ছিলো ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ কে কতবার দেখেছে।

অনেককে বলতে শুনতাম তিনি একশ-দেড়শবার দেখেছেন। সেটাও আসলে খুবই সম্ভব ছিলো। এরপর হঠাৎ করে একদিন কুষ্টিয়ার বনানী সিনেমা হলে আসলো নতুন এক সিনেমা। নাম তার ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’। দেশের আবাল বৃদ্ধ বণিতা সেই সিনেমা দেখতে হলগুলোতে ভিড় করতে শুরু করলো। মাসের পর মাস সেই সিনেমা চললো। আমাদের আর সেই সিনেমা দেখার সৌভাগ্য হলো না। আমরা ছোটরা হলে গিয়ে সেই সিনেমা দেখার সুযোগ পেলাম না। কিন্তু যতবারই কোথাও সেই সিনেমার পোস্টার দেখেছি দাঁড়িয়ে পরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সিনেমার নায়কটাতে দেখতাম। একজন ছোটখাটো মানুষ। নতুনভাবে আঁচড়ানো চুলের স্টাইল। মুখের মধ্যে একটা অদ্ভুত হাসি। সব মিলিয়ে দারুণ একটা ভালো লাগা কাজ করতো।

এরপর সময় দ্রুতই গড়িয়ে যেতে থাকে। সালমান শাহ’র প্রথম সিনেমা মুক্তি পায় আমরা যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। একেবারে উঠতি বয়সী টিনএজার। চোখে নতুন নতুন স্বপ্নেরা ভিড় করা শুরু করেছে। আর আমরা গ্রামের ছেলেমেয়ে তখনও অমিতাভ বচ্চন, মিঠুন চক্রবর্তী, প্রসেনজিৎ, চিরঞ্জীব আর ভিক্টর ব্যানার্জির বাইরে কাউকে তেমন চিনিও না। হঠাৎ সালমান শাহ এসে আমাদের পুরোটা সত্ত্বা জুড়ে জায়গা করে নিলো। উঠতে বসতে চলতে ফিরতে উনার হাসি কান্না কথা বলার স্টাইল পর্যন্ত নকল করতে শুরু করলাম।

সেই বয়সে প্রথম প্রেম নিবেদনের ক্ষেত্রেও সবাই উনাকেই অনুসরণ করতে শুরু করলো। আমাদের সঙ্গে একজন অতীব সুন্দরী মেয়ে পড়তো। সেই মেয়েকে ভালোবাসতেন আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র এক বড় ভাই। বিভিন্নভাবে সেই মেয়েকে পথেঘাটে উত্ত্যক্ত করতেন এবং উনার ভালোবাসা কতটা গভীর সেই প্রমাণ দিয়ে বেড়াতেন। একবার উনি আমাদের সেই সহপাঠিনীর নাম উনার বুকে খোদাই করে ঘুরে বেড়াতেন। আমি একবার সামনাসামনি উনার বুকটা দেখে ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। উনার এমন কর্মকাণ্ডের কারণ সালমান শাহ কোন একটা সিনেমাতে তার প্রেমিকার নাম সেইভাবে বুকে খোদাই করেছিলেন।

উনার উপর আমাদের কিঞ্চিৎ রাগ হতো, কারণ আমাদের সমবয়সী সহপাঠিনীরা তখন আমাদের ভাবনা না ভেবে সারাক্ষণই উনার ভাবনাতে মশগুল থাকতো। উনার কোন ছবিতে কার কোন অভিনয় বা কোন ডায়লগ ভালো লেগেছে সেটা নিয়ে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আলোচনা করতো। আমরা যে পাশে বসে আছি সেদিকে কারো খেয়ালই ছিলো না। সহপাঠিনীদের কিঞ্চিৎ মনযোগ পাওয়ার আশায় উনার পোশাক-পরিচ্ছদের হুবহু নকল করতে শুরু করলাম আমরা। এমনকি কোন প্রেমিক তার প্রেমিকাকে মনের কথা প্রকাশ করার জন্য দোকান থেকে দু’টাকা দিয়ে উনার কোন ভিউকার্ড কিনে তার পেছনে মনের কথা লিখে প্রেয়সীর কাছে পাঠিয়ে দিতেন। এভাবেই একটা প্রজন্মের আইডলে পরিণত হয়েছিলেন সালমান শাহ নামের সেই পরশ পাথর যার ছোঁয়ায় বাংলাদেশি সিনেমার জগতে বিপ্লব ঘটে গিয়েছিলো।

ব্যক্তিগতভাবে আমি উনার যতগুলো ছবি দেখেছি তার মধ্যে ‘আশা ভালোবাসা’ ছবিটার কথা এখনও মনে আছে। সেই সিনেমার একটা গান ‘গান আমি গেয়ে যাবো এই আসরে’ আমার খুবই ভালো লাগতো। এমনকি এখনও আমি ইউটিউবে ঘুরেফিরে এই গানটা বাজাই। এছাড়াও ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ সিনেমার টাইটেল গানটা এখনো অনেক প্রিয়। এছাড়া ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ ছবির ‘চিঠি এলো জেলখানাতে অনেক দিনের পর’ শিরোনামের গানটা মনে দাগ কেটেছিলো। এই গানগুলো এতোটা ভালো লাগার কারণ এই গানের কথা বা সুর নয়, এই গানের সঙ্গে যিনি ঠোঁট মিলিয়েছিলেন সেই মানুষটার অকৃত্রিম অভিনয়।

উনার অভিনয় দেখলে আমার কখনই মনে হতো না আমি কোন সিনেমা দেখছি। আমার মনে হতো বাস্তব জীবনে আমার চোখের সামনে এই ঘটনাগুলো ঘটছে। উনার প্রত্যেকটা ছোটখাটো অভিনয় ছিলো একেবারে নিখুঁত। এতদিন পর এসেও আমরা পুরো পরিবার মিলে বসে উনার সিনেমাগুলো উপভোগ করি। পাড়ায় কোথাও ভিসিআর ভাড়া এনেছে শুনলেই আমরা খোঁজ নিতাম সালমান শাহ’র কোন সিনেমার ক্যাসেট এনেছে কিনা? যেই শুনতাম সালমান শাহ’র সিনেমার ক্যাসেট এনেছে আমরা দু’ভাই যেভাবেই হোক বাড়ি থেকে টাকা চুরি করে যত রাতই হোক চলে যেতাম সিনেমা দেখতে। এই ব্যাপারে আমাদের দু’ভাইকে আশপাশের পাড়ার সবাই চিনতো সালমান শাহ’র ভক্ত হিসেবে।

বাংলাদেশের সিনেমাতে এমন এক সময়ে সালমান শাহ’র আগমন যখন বাংলা সিনেমাতে চরিত্রের শূন্যতা দেখা দিয়েছিলো। সিনেমাতে বিভিন্ন অজুহাতে একটু একটু করে অশ্লীলতা ঢোকা শুরু করেছে। তখন সালমান শাহ এসে পুরো সিনেমা জগতটাকে খোলনলচে বদলে দিলেন। প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেলো এমন সিনেমা বানানোর যেটা মানুষ সপরিবারে হলে গিয়ে দেখতে পারবে। সালমান শাহ এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি একক ব্যক্তি হিসেবে অভিনয় শুরু করে পুরো বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনের চেহারা বদলে দিয়েছিলেন রাতারাতি।

তাই সালমান শাহ’র হঠাৎ মৃত্যু যেমন একদিকে আমাদের প্রজন্মকে শোকে ভাসিয়েছিলো তেমনই বাংলাদেশের সিনেমাতে শুরু হয়েছিলো একটা কালো অধ্যায়ের। এরপর বাংলাদেশের সিনেমা প্রায় দুই যুগ ধরে ধুকতে ধুকতে আজকের এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। উনার মৃত্যুর পর চলচ্চিত্রের ভাষায় পুরোপুরি বদলে গেলো। শুরু হয়ে গেলো নানা খিস্তি-খেউর। আর অভিনয়ের নামে শুরু হলো শরীরের প্রদর্শনী। তাই স্বাভাবিকভাবেই হলমুখী মধ্যবিত্ত সিনেমা হলগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। এরপর একে একে বহু সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেলো। আমার মনে হয় উনার মৃত্যু বাংলাদেশের সিনেমা জগতকে বিশ বছর পিছিয়ে দিয়েছিলো এবং সেই ধাক্কা বাংলা সিনেমা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি।   

সালমান শাহদের কখনই মৃত্যু হয় না, কারণ তারা বেঁচে থাকেন মানুষের হৃদয়ে হাজার বছর ধরে। উনার মৃত্যুর এতোদিন পর এসেও উনার অভিনীত সিনেমা বা গানের চাহিদা এতটুকু কমেনি। আমি এখনও অবসরে উনার অভিনীত সিনেমার গান শুনি। এমনকি আরো একটু সময় পেলে পুরো পরিবার নিয়ে বসে যাই উনার সিনেমা দেখতে। উনি বাংলাদেশের সিনেমা জগতের একজন ধ্রুবতারা, যিনি আকাশে অবস্থান করেও আলোকিত করেন মানুষের মনকে। উনার মৃত্য দিন আসলে তাই স্বভাবতই আমাদের প্রজন্মের ছেলেমেয়ে এমনকি অভিভাবকদের মন খারাপ হয়ে যায়।

আবার তার কিছুদিন পরই আসে উনার জন্মদিন। তখন আবার এই ভেবে ভালো লাগে যে উনি স্বল্পায়ু হলেও এই বাংলাদেশেই অন্তত জন্মেছিলেন সেটাই আমাদের সৌভাগ্য। জন্মদিনে স্বল্পায়ু এই মানুষটিকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে ভালোবাসা এবং শুভেচ্ছা। যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন হে বাংলাদেশের সিনেমা জগতের ধ্রুবতারা।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!