অবরুদ্ধ কাশ্মীরে ছয় দিন: পর্ব ১

ফাতিমা জাহানফাতিমা জাহানভারতের ব্যাঙ্গালুরু থেকে
Published : 20 Sept 2019, 04:33 AM
Updated : 22 Sept 2019, 04:11 AM

[বাংলাদেশের শিক্ষার্থী ফাতিমা জাহান ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস এর ওপর পিএইচডি করেছেন ভারতের ব্যাঙ্গালুরু ইউনিভার্সিটিতে। ভারতের সংবিধান থেকে বিশেষ মর্যাদা রদ করায় ‘ভূস্বর্গ’ যখন নিরাপত্তার বেড়াজালে অবরুদ্ধ, ওই সময় ছয় দিন ঘটনাচক্রে কাশ্মীর ঘুরে এসেছেন তিনি। থমথমে কাশ্মীরে সেই ছয় দিনের অভিজ্ঞতা তিনি ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জন্য।] 

প্রথম দিন: ২০ অগাস্ট ২০১৯

শ্রীনগরে নেমেই দেখি পুরো শহর থমথমে

সপ্তমবারের মতো কাশ্মীরে যাচ্ছি। কাশ্মীর খুব প্রিয় জায়গা বলে বারবার যাই। তবে এবার একটু টেনশন হচ্ছে।

টিকেট করার তিনদিন পর জানতে পারলাম, কাশ্মীরে কারফিউ দিয়েছে। এয়ারলাইনস কোম্পানিকে ফোন করে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছি, কোনো ফ্লাইট বাতিল হয়েছে কিনা, যেতে কোনো সমস্যা আছে কিনা।

তারা বরাবরই বলে আসছে, কোনো ফ্লাইট বাতিল হয়নি। এদিকে কাশ্মীরে টেলিফোন, ইন্টারনেট লাইন ৫ অগাস্ট থেকে বন্ধ, তাই ওখানে কারো সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারছি না। আগেই বলে রাখি, আমি নেহাতই একজন ট্যুরিস্ট। রাজনীতি বা সাংবাদিকতার কিছু বুঝি না। ভ্রমণ ছাড়া কাশ্মীরে যাওয়ার আর কোনো উদ্দেশ্য আমার নেই।

জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা রদ করার পর ৫ থেকে ১৮ অগাস্ট কারফিউ জারি ছিল। এরপর শর্তসাপেক্ষে কারফিউ তুলে দেওয়া হয়। আমার ধারণা ছিল ১৫ অগাস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসের পর কারফিউ তুলে দিতে পারে। সেরকমই হয়েছে। আর কারফিউ তুলে দিলে কাশ্মীরে চলাচলে তেমন বাধা থাকবে না, এটুকু নিশ্চিত ছিলাম।

দুজন ট্র্যাভেল এজেন্টের কাছ থেকে কাশ্মীরের খবর জানার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তারাও তেমন কিছু জানাতে পারলেন না। তারপরও চেনা জায়গা বলে সাহস করে রওয়ানা হয়ে গেলাম। তবে এটাও জানি, আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে ফেরত পাঠানো হতে পারে। অথবা শ্রীনগরে পৌঁছানোর পর গুপ্তচর ভেবে গ্রেপ্তার করা হতে পারে।

দিল্লী থেকে রওয়ানা হলাম বড় কোনো ঝামেলা ছাড়াই। তবে ফ্লাইট শ্রীনগরে ল্যান্ড করার আধ ঘণ্টা আগে যাত্রীদের সবাইকে উইন্ডোশিট বন্ধ রাখতে বলা হলো। আমি সেকেন্ডের জন্য খুলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কেবিন ক্রু হৈ হৈ করে বন্ধ করতে বললেন। নিরাপত্তাজনিত কারণে নাকি এ ব্যবস্থা। জানলা থেকে প্রিয় উপত্যকা দেখার সাধ এবার পূরণ হলো না।

প্লেন ল্যান্ড করার পর গৎবাঁধা ঘোষণা দেওয়া হলো, যাত্রীরা এখন তাদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারেন। বেশ কয়েকজন যাত্রী তখন মোবাইল ফোন উঁচু করে দেখিয়ে হেসে উঠলেন। পুরো কাশ্মীরই তো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন!

প্লেন থেকে নেমে দেখি বাইরে সব থমথমে। এয়ারপোর্টের কোনো দোকান খোলা নেই। আমি কোনো পুলিশ অফিসারের দিকে ভয়ে তাকাচ্ছিলাম না। তাকানোর অপরাধে যদি ফেরত পাঠায়! এসেছি এত কৌশল করে! দিল্লি এয়ারপোর্টে গ্রাউন্ড স্টাফ ক্যাজুয়ালি জিজ্ঞেস করেছিল কেন যাচ্ছি। আমি বলেছি আমার আত্মীয়কে দেখতে যাচ্ছি। শ্রীনগর এয়ারপোর্টে প্রশ্ন করলে কী কী বলবো তা মনে মনে কয়েকদিন ধরে আওড়াচ্ছিলাম।

মিথ্যা বলতে হলে ধরা পড়ার ভয় তো আছেই। তার ওপর আবার আমার হ্যান্ড লাগেজে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর চে গেভারার ওপর লেখা কয়েকটা বই আছে। এনেছি পড়ার জন্য। ব্যাঙ্গালুরুতে পড়ার সময় পাই না। এখন ব্যাগ খুলে চেক করলে তো ধরা পড়বো।

পুরো ফ্লাইটে যাত্রীদের মধ্যে আমিই বোধ হয় একমাত্র ট্যুরিস্ট, বাকিরা সবাই কাশ্মীরি। বেল্ট থেকে লাগেজ পাওয়ার পর দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। শ্রীনগর এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে প্রিপেইড ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে ট্যাক্সি নিলাম। বের হয়ে দেখি পুরো শহর থমথমে। এখন বাজে সকাল সাড়ে সাতটা, বাইরের তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

পরশু কারফিউ তুলে দেওয়া হয়েছে। কোনো দোকানপাট খোলা নেই। স্থানীয় মানুষ দু’একজন বেরিয়েছে বাজার করার জন্য। কেউ গাড়ি বের করেননি। হেঁটেই চলাফেরা করছেন, দু’একজন জন মহিলাকে দেখলাম হেঁটে বাজারে যাচ্ছেন।

ট্যাক্সিচালক এজাজ ভাই জানালেন, আমাকে পৌঁছে দিয়ে তিনি বাড়ি চলে যাবেন। দিন চালানোর জন্য একজন প্যাসেঞ্জারই যথেষ্ট এখন। কোনো অভিযোগে আর্মি ধরে নিয়ে যদি জিজ্ঞাসাবাদ করে, এই ভয়ে কেউ ঘরের বাইরে থাকে না। দোকানপাট বন্ধ, তাই খুব হিসাব করে আগের করা বাজার থেকে খরচ করতে হচ্ছে। পরে অবস্থা কী হয়- কিভাবে সংসার চলবে কে জানে!

এজাজ ভাইয়ের সংসারে স্ত্রী ও দুই মেয়ে। একজনের বয়স পাঁচ বছর, আরেকজন আট মাসের। এজাজ ভাই জানালেন এখানকার সব হোটেল পুলিশ সিল করে দিয়েছে। গেস্ট রেজিস্ট্রার বইয়ে ৫ অগাস্ট লিখে দেওয়া হয়েছে- এরপর আর কোনো গেস্ট রেজিস্ট্রার করা হবে না।

রাস্তা ভরে গেছে আর্মিতে। এত আর্মি আগে একসঙ্গে দেখিনি। প্রতি তিন মিটার দূরত্বে একজন সেনাসদস্য দাঁড়িয়ে আছেন পাহারায়। আমি যাবো হুসেন আঙ্কেলের হাউসবোটে, ডাল লেকের একদম ভেতরে। আমাকে ৭ নম্বর ডাল গেইটে নামিয়ে চলে গেলেন এজাজ ভাই।

ফুল বীজ বিক্রেতা আব্দুল আঙ্কেল

শিকারা (এক ধরনের ছোট নৌকা) একটাও নেই। কি করে যে লেক পার হই! মোবাইল, ইন্টারনেট কিছুই কাজ করছে না। কারো সঙ্গে যোগাযোগ করার উপায় নেই। বোলভার্ড রাস্তার ধারে একজন মাত্র সবজি বিক্রেতা কিছু সবজি নিয়ে বসেছেন। ডাল লেক অতিরিক্ত রকমের শান্ত।

শিকারা একটা পেলাম। গতবার যে বীজ বিক্রেতা শিকারা করে এসে আমাকে কয়েকটা পদ্মফুল দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই আব্দুল আঙ্কেলের দেখা পেলাম। তিনি বললেন, ১৫ দিনে কোনো ট্যুরিস্ট দেখেননি, ফুলের বীজও বিক্রি করতে পারেননি। সাধারণত বীজ বিক্রেতার শিকারা থাকে ফুলে আচ্ছাদিত, আজ বেশি ফুল নেই।

জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি কিছু ফুলের বীজ কিনবে?’ খুব খারাপ লাগছিল তাকে দেখে। মুখে হাসি নেই। জীবনে আনন্দ নেই। আব্দুল আঙ্কেলের গতবারের তোলা ছবি কয়েকদিন আগেই আমি ফেইসবুকে কভার পিকচার করে রেখেছি। প্রয়োজন নেই, তাও কিছু বীজ কিনে নিলাম।

শিকারা নিয়ে পৌঁছলাম হাউসবোটে। হুসেন আঙ্কেলের হাউসবোট আর বাড়ি। কাশ্মীরে আরোপিত দুটো ধারার কথা জানিয়ে রাখি-  

১. AFSA, army force special power act

২. PSA, public safety act

AFSA ১৯৯০ সাল থেকে চালু আছে। সেনাবাহিনীর হাতে সব ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। সেনাবাহিনী যে কাউকে তুলে নিয়ে যেতে পারে- সিভিলিয়ান বা মিলিট্যান্ট। আর্মিকে কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। গত ৫ অগাস্ট থেকে অনেক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের কোনো খবর জানা যাচ্ছে না।

পরশু কারফিউ তুলে নেওয়ার পর এখানকার মানুষ নিজেরাই কারফিউ দিয়েছে, যাকে বলে ‘সিভিল কারফিউ’। কেউ দোকান খোলেনি, কেউ কোথাও কাজ করছে না। ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়ার যে সিদ্ধান্ত হয়েছে তার প্রতিবাদে এই ব্যবস্থা।

PSA ১৯৭৮ সাল থেকে কার্যকর রয়েছে। এ আইনের কারণে কোনো ধরনের মিটিং-মিছিল নিষিদ্ধ কাশ্মীরে। তবে নিষেধাজ্ঞার পরও মিছিল বের হয়, ধরপাকড়ও হয়। এবার নাকি সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধের সময় তিন মাস কারফিউ ছিল, কিন্তু টেলিফোন লাইন খোলা ছিল।

নব্বইয়ের দশক থেকেই যে কোনো অজুহাতে কাশ্মীরে কারফিউ দেওয়া হচ্ছে, যে কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে যখন তখন। এবার টেলিফোন ও ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বাইরের জগতের সঙ্গে কারও যোগাযোগ নেই। তবু মিছিল বের হচ্ছে শহরে, সেই মিছিলে শটগান থেকে ছররা ছোড়া হচ্ছে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে। এসব খবর মুখে মুখে ছড়াচ্ছে।    

কাশ্মীরে কোনো সিনেমা হল নেই। এ নিয়ে তরুণ যুবাদের কারো কারো ক্ষোভ আছে। আবার কারো কারো কিছুই যায় আসে না। কারণ জীবন যেখানে বিপন্ন, সেখানে সিনেমা থিয়েটার দিয়ে কী হবে! গান-বাজনার চর্চা এখানে আর কেউ করে না। যা ছিল তা বহু যুগ আগের গল্প। তবে অল্প কিছু খেলার মাঠ এখনও আছে।

শ্রীনগর শহরের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা ডাল লেক। এখানকার অধিবাসীরা কেউ বিদ্রোহী নয়। এখানকার যুবারাও মিছিলে যায় না। মিছিল করতে হলে তো লেক পার হয়ে যেতে হবে। আর্মি, পুলিশ এখানে ধরপাকড় করার জন্য আসে না। তবে ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধের সময় ডাল লেকেও মিলিটারিরা মোটর-বোট টহল দিতো।

এবার কারফিউয়ের আগে পুলিশের কাছ থেকে ক্ষমতা নিয়ে নেওয়া হয়েছে, পুলিশের অস্ত্র জমা রেখে দেওয়া হয়েছে। এয়ারপোর্ট থেকে আসার পথে কোনো পুলিশ দেখলাম না। বেশিরভাগ রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করে দিল্লী ও আগ্রার জেলে পাঠানো হয়েছে। শোনা গেছে কাশ্মীর আর জম্মুর সব জেল নাকি ভরে গেছে। অবশ্য তা শোনা কথা।          

কারফিউ শিথিল করার পর থেকে কেউ গাড়ি বের করছে না, কারণ পেট্রোল পাওয়া যায় না। বাস চলছে না। ডাল লেকে হাউসবোটে যারা থাকেন, তাদের জীবনের চাওয়া-পাওয়া খুব সীমিত। নৌকায় ঘরবাড়ি, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নৌকায় করেই ফেরি করে বিক্রেতারা।

বিকেলে হুসেন আঙ্কেলকে বললাম, লেকপারে যাবো শহরের পরিস্থিতি দেখতে। আঙ্কেল মানা করলেন। বললেন, কাল যেও। আজ শহর মোটেও ঠাণ্ডা নয়।

চলবে...

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!