শুনে উনি বললেন, তুমি কয়টার সময় ঘুম থেকে উঠো? আমি বললাম সকাল ছয়টায়। উনি তখন বললেন, আমি কয়টার সময় ঘুম থেকে উঠি জানো? আমি ঔৎসুক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালাম। তখন উনি বললেন, আমি উঠি সকাল চারটায়। আমি আরো অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
তখন উনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কখন ঘুমাতে যাও। আমি বললাম, সবকিছু গুছিয়ে ঘুমাতে যেতে রাত বারোটা তো বেজেই যায়। উনি বললেন, তোমাদের উচিত রাত পৌনে নয়টা বা নয়টার মধ্যে ঘুমিয়ে যাওয়া। তাহলে দেখবে সকালে উঠতে আর সমস্যা হচ্ছে না। আর ঠিক পরিমান ঘুম হওয়ার কারণে দিনের বেলায় কাজেও মনযোগ দিতে পারবে।
আমি সবসময় ভাবতাম মানুষ সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও সময়কে কখনই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া আসার পর আমার সেই ভুল ভেঙে গেছে। সময়কেও মানুষ তার বশে এনেছে। বছরের একটা সময় ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে দেয়া হয়, আবার একটা সময় পিছিয়ে দেয়া হয়। তাই কখনও সূর্যাস্ত হয় রাত আটটার সময় আবার কখনও সূর্যাস্ত হয় বিকাল পাঁচটার সময়। এবং সেই মোতাবেক সারাদেশ পরিচালিত হয়।
প্রতি বছর সেখানে এই আয়োজনটা করা হয়। এই উৎসবটাকে বলা হয় ‘সিনেমা আন্ডার দ্য স্টার’। গত বছর দেখানো হয়েছিলো ‘মোয়ানা’। অস্ট্রেলিয়াতে যে কোনো আয়োজনই করা হয় অনেক সুচারুভাবে। যেমন এই আয়োজনের জন্য যে পরিমাণ বেশি গাড়ি আসবে সেটার জন্য বাড়তি পার্কিঙের ব্যবস্থা করা হয়। আবার পার্কিঙে যেতে যাতে কারো অসুবিধা না হয় সেই জন্য রাস্তায় কিছু দূর পরপর ট্রাফিক দাঁড়িয়ে থাকে লাল লাইটের লাঠি হাতে নিয়ে।
এইবার আমাদের একটু যেতে দেরি হয়ে গিয়েছিলো সংসারের কাজকর্ম সেরে। বোটানিক গার্ডেনে ঢোকার মুখেই তাহিয়া ক্যাঙ্গারু ক্যাঙ্গারু বলে চিৎকার করে উঠলো। এই ক্যাঙ্গারুগুলো বোটানিক গার্ডেনে থাকলেও সারাদিন বের হয় না। বিকেলে পরিবেশ একটু ঠাণ্ডা হয়ে আসলে বাইরে বের হয়ে আসে তখন আপনার ভাগ্য ভালো হলে দেখেও ফেলতে পারেন।
এরপর ট্রাফিকের দেখানো রাস্তা অনুযায়ী পার্কিঙের দিকে এগিয়ে গেলাম। পার্কিঙে ঢোকার মুখেই একজন ট্রাফিক জিজ্ঞেস করলো তোমার সঙ্গে কি বাচ্চাকাচ্চা আছে। আমি উত্তর করলাম জি আছে। তখন উনি আমাদেরকে কাছাকাছি একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন তোমরা ভাগ্যবান এইমাত্র একটা গাড়ি বেড়িয়ে গেলো। সেখানে যেয়ে গাড়ি রাখতে পারো। আমরা সেখানে গাড়ি পার্কিং করে রওয়ানা দিলাম।
রায়ান স্টলারে বসা, তাহিয়ার কাঁধে বসার জন্য দুটো ফোল্ডিং চেয়ার আর গিন্নির হাতে স্ন্যাকসের ব্যাগ। আমরা সিনেমার স্পটের দিকে যাওয়ার সময় সেই ট্রাফিক ভদ্রলোককে আবারো ধন্যবাদ দিলাম। উনি খুশি যে তোমাদের সাহায্য করতে পেরেছে।
এটা এখানকার খুবই স্বাভাবিক ভদ্রতা। পাশ থেকে একটা চেয়ার নিতে গেলেও পাশের ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করতে হয়। গতবার আমরা একটু পিছনের দিকে বসেছিলাম। সিনেমা দেখতে সমস্যা হয়নি, কারণ জায়গাটা ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে বোটানিক গার্ডেনের শীর্ষের দিকে চলে গেছে। কিন্তু আমরা ডায়লগগুলো মিস করে যাচ্ছিলাম। তাই এইবার মাঝামাঝি বসা। গতবছর এখানে আসার পর বন্ধু হাবিব, বন্ধু পত্নী এনি আর উনাদের দু’ছেলেমেয়ে সারিতা এবং সাফিনের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো। তারপর সবাই মিলে একসঙ্গে বসে এনি ভাবির আনা খাবার সাবাড় করেছিলাম।
সন্ধ্যার পরপরই শীতের তীব্রতা বেড়ে যায়। তখন আমরা কফি খেয়ে নিজেদের চাঙা রাখার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বাচ্চাদের কোন কিছুই আটকাতে পারেনি। বাচ্চারা সেই ঠাণ্ডাতেও আইসক্রিমের বায়না ধরলে অগত্যা তাদেরকে সেটাই কিনে দেয়া হলো। তারা তাদের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই সময়টা পার করেছিলো।
এবার গিন্নিও আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন এবং সিনেমার স্পটে পৌঁছে বললেন, ক্ষুধা পেয়েছে। রায়ানকে উনার সঙ্গে রেখে আমি আর তাহিয়া খাবারের সন্ধানে বেড়িয়ে পড়লাম। খাবারের সবগুলো দোকানের সামনেই তখন কম বেশি ভিড়। তাহিয়া বলছিলো সসেজ খাবে। কিন্তু সেখানে নগদ টাকা লাগবে, তাই পাশের বার্গারের দোকানের সামনে আমি লাইনে দাঁড়ালাম।
বার্গারের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করতে যেয়ে বুঝলাম সেটা পেতে অনেক দেরি হবে। কারণ তখন কেবল সার্ভ করছে একান্ন নম্বর আর আমাদের নম্বর ৭৫। তাহিয়া ইতোমধ্যে খুঁজে বের করে ফেলেছে যে খাবারের দোকানের ফাঁকে একটা এটিএম বুথও আছে। তাই আমাকে তাগাদা দিচ্ছিলো টাকা তুলে তাকে সসেজ কিনে দিতে। এটিএম বুথের সামনে যেতেই সবুজ পোশাক পরা একজন তরুণী বললেন, দুঃখিত এটা কাজ করছে না। ঠিক করার জন্য আমরা লোক ডেকে পাঠিয়েছি কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। আর তোমরা চাইলেই কার্ড দিয়ে যেকোনো দোকান থেকে কেনাকাটা করতে পারো, কারণ সবগুলো দোকানেই ইফটপস আছে এবং পপকর্নগুলো বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে বলে ঠিক পাশের দোকানটা দেখিয়ে দিলেন।
তারপর আবার বার্গারের দোকানের সামনে অপেক্ষা করতে শুরু করলাম। সেখানে অপেক্ষা করতে করতে অনেকের সঙ্গেই আলাপ হচ্ছিলো। এক ভদ্রলোক তার বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে খাবারের অপেক্ষায় রয়েছেন। আমি বললাম, ইতোমধ্যে তুমি বিনামূল্যের পপকর্ন নিয়ে এসে বাচ্চাটাকে দিতে পারো। উনি বললেন, পপকর্ন বিনামূল্যে দিচ্ছেন। আমি বললাম, আমি একটু আগেই নিয়ে এসেছি। উনারা বাপ-বেটি তখন পপকর্ন নিয়ে আসলেন এবং আমাকে ধন্যবাদ দিলেন। আরো এক ভদ্রলোক তার বাচ্চা ছেলেটাকে নিয়ে খাবারের জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি পপকর্নের কথা বলাতে উনার ছেলেটা পপকর্ন আনতে চলে গেলো। সে যেয়ে একেবারে লাইনের সামনে দাঁড়িয়ে পপকর্ন নিয়ে চলে আসলো দেখে আমরা হেসেই খুন। কারণ ও আসলে লাইনটা লক্ষই করেনি, কারণ ওর অনেক ক্ষুধা পেয়েছিলো।
খাবার নিয়ে ফিরে এসে দেখি তাহিয়া একটা চেয়ারে আর রায়ান তার মায়ের কোলে চড়ে অন্য চেয়ারটা দখল করে আছে। তাই আমি অগত্যা সঙ্গে আনা মাদুরে বসে পড়লাম। কিন্তু সামনের সারিতে সবাই চেয়ারে বসে দেখছিলো, তাই আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। তখন আমি হাটু ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করছিলাম দেখে আমাদের পাশের ভদ্রলোক আমাকে উনাদের একটা চেয়ার দেখিয়ে সেখানে বসতে বললেন। উনারা চারটা চেয়ার এনেছেন, কারণ দু'ছেলেমেয়েসহ উনারাও চারজন। কিন্তু মেয়েটা তাঁর বাবার কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছে তাই একটা চেয়ার ফাঁকা রয়েছে, সেটাতেই আমাকে বসতে বলেছেন।
আমি অনেক ধন্যবাদ দিয়ে সেখানে বসে সিনেমাটার বাকিটা উপভোগ করলাম। এবছরও গত বছরের মতোই অনেক ঠাণ্ডা পড়ছিলো। গায়ের জামা-কাপড়ে মনে হচ্ছিলো কেউ যেন ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিয়েছে। তবে এইবারের সিনেমা ‘আন্ডার দ্য স্টারের’ সবচেয়ে উপভোগ্য বিষয় ছিলো সেদিনের ভরা পূর্ণিমা। সিনেমা শুরু হওয়ার একটু আগেই পূর্ণিমার চাঁদটা পুব আকাশে দেখা দিলো এবং সেদিন আকাশ মেঘমুক্ত থাকার কারণে রাত বাড়ার সাথে সাথে তার আলোর উজ্জ্বলতা আরো বেড়ে গেলো।
পূর্ণিমার আলোতে সবকিছুই মায়াময় দেখায়, তাই সেদিনও আশপাশের সবকিছু এমনকি সিনেমাটাও অসাধারণ লাগছিলো। আমাদের ‘দ্য ইনক্রেডিবলস’ বেশ কয়েকবার দেখা ছিলো, তাই আমাদের বুঝতে তেমন কোন সমস্যা হচ্ছিলো না। কিন্তু প্রথম সিনেমাটার তুলনায় এটা আসলেই অনেক ধীরগতির ছিলো। যাই হোক, সিনেমা দেখা শেষ হলে আমি উনাদের ফোল্ডিং চেয়ারটা ভাঁজ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেরত দিলাম। ভদ্রলোকের কোলের মধ্যে মেয়েটা ঘুমাচ্ছিলো তাই আমি উনার বসার চেয়ারটাও ফোল্ড করে ব্যাগে ভরে দিলাম। উনারা আমাদের অনেক ধন্যবাদ দিলেন। প্রতিউত্তরে আমরাও উনাদের অনেক ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, আবার হয়তোবা কোথাও দেখা হয়ে যাবে।
এই উৎসবটার নাম ‘সিনেমা আন্ডার দ্য স্টার’ হলেও পূর্ণিমার কারণে সেটা আসলে হয়ে উঠেছিলো ‘সিনেমা আন্ডার দ্য মুন’। আর সিনেমাগুলো সব বয়সী মানুষের কথা মাথায় রেখেই ঠিক করা হয় বলে এই উৎসবগুলো হয় সবার জন্যই উপভোগ্য। তবে আমার কাছে যেকোন উৎসবের সবচেয়ে লক্ষণীয় দিক হচ্ছে মানুষে মানুষে মিথস্ক্রিয়া। যে কোন উৎসবই আসলে মানুষে মানুষে মেলবন্ধন তৈরির একটা উপলক্ষ। একেবারে সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের সঙ্গে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা কত সহজেই আমরা তাদের আপন করে নিতে পারি উৎসবগুলোতে আসলে সেটা আবারো প্রমাণিত হয়। আরও একবার মানুষ এবং মানবতার প্রতি বিশ্বাস ফিরে পায়।
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |