মৌমাছিদের সঙ্গে একটা বিকেল

চার ঋতুর দেশ অস্ট্রেলিয়া। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গ্রীষ্মকাল, মার্চ থেকে মে পর্যন্ত শরৎকাল, জুন অগাস্ট পর্যন্ত শীতকাল, আর সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বসন্তকাল। পঞ্জিকা অনুযায়ী ঋতুর বিভাজন এমন হলেও বাস্তবে একই দিনে সব ঋতুর দেখা অহরহ পাওয়া যায়।

মো. ইয়াকুব আলী, সিডনি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Sept 2019, 06:20 AM
Updated : 9 Sept 2019, 06:20 AM

তাই অস্ট্রেলিয়ায় বহুল প্রচলিত একটা কৌতুক হচ্ছে এখানে তিনটা জিনিসকে কখনোই বিশ্বাস করবেন না। সেই তিনটা জিনিস হলো- অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়া, কাজ আর মেয়েমানুষ। আমরা আজ বিস্তারিত সেই আলোচনায় যাবো না, বরং আবহাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবো।

পঞ্জিকা অনুযায়ী এখানে এখন বসন্তকাল। শীতের শেষে সেপ্টেম্বরের প্রথম দিন থেকেই তাপমাত্রা হঠাৎ করে বেড়ে যায়। আর হুমায়ূন আহমেদের ভাষায় বসন্তের লিলুয়া বাতাস বইতে শুরু করে। প্রকৃতিতে যৌবনের স্পন্দন দেখা যায়। গাছগুলো পুরনো পাতা বিসর্জন দিয়ে নতুন পত্রপল্লবে সুশোভিত হয়। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন জায়াগায় চেরি উৎসবের আয়োজন করা হয়। চেরি উৎসব বলতে চেরি ফলের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। অনেকগুলো ফুল এসময় একসাথে ফুটে সেগুলোর সামগ্রিক সৌন্দর্যকে চেরি উৎসব বলা হয়। এছাড়াও গাছে গাছে চোখ জুড়ানো, মন ভুলানো বাহারি রঙের ফুল দেখা যায়।

সারা অস্ট্রেলিয়ায় দীর্ঘ শীতের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে বিভিন্ন রকমের উৎসব আয়োজন করা হতে থাকে, যেমন সিডনির অন্যতম ‘সিগনেচার ফেস্টিভ্যাল’, ‘বন্ডাই উইন্ড উৎসব’ যেখানে রঙ-বেরঙের শতশত ঘুড়ি বন্ডাই সমুদ্র সৈকতের আকাশে ভেসে বেড়ায়। সকাল এগারোটায় শুরু হয়ে সেই উৎসব, চলে বিকেল চারটা পর্যন্ত।

তাহিয়া আর আমি মিলে ঠিক করলাম রোববার বন্ডাই যাবো, কিন্তু সকাল দশটা থেকে শুরু হয়ে বিকেল একটা পর্যন্ত চলা কমিউনিটি বাংলা স্কুলের সেদিন ক্লাস ছিলো। একটায় ক্লাস শেষ করে বন্ডাই যেতে আমাদের আরো প্রায় ঘণ্টাখানেক লাগবে, তাই তাহিয়া বললো বাবা আমরা তাহলে অস্ট্রেলিয়ান বোটানিক গার্ডেনেই যাই যেটা মাউন্ট এনানে অবস্থিত।

গত কদিন ধরেই বন্ধু-পত্নী বিথি ভাবি তাগাদা দিয়ে যাচ্ছিলেন এই রোববার কোন একটা প্রোগ্রাম ঠিক করার জন্য। আমিও উনাকে বন্ডাই ফেস্টিভ্যালের কথাই বলেছিলাম, কিন্তু উনি বললেন গতবছর যেয়ে পার্কিং না পেয়ে ফিরে এসেছি, তাই আর এবার যাবো না। উনার ছেলে-মেয়েও বাংলা স্কুলে আসে। সেখান থেকেই একসাথে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিলো আমাদের। পরবর্তীতে গন্তব্য বদলে ফেলাতে আমরা দুই পরিবার একসাথে বোটানিক গার্ডেনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। বাংলা স্কুলের ক্লাস শেষ করে মিন্টো থেকে বোটানিক গার্ডেনে যেতে কুড়ি মিনিটের ড্রাইভ। অবশ্য আপনি সিডনি সিটি থেকে যেতে গেলে ঘণ্টাখানেকের ড্রাইভ।

বন্ধু ননির গাড়িতে বিথি ভাবি, উনাদের তিন সন্তান নাজিহা, নাবিহা এবং প্রহর আর আমাদের গাড়িতে আমি তাহিয়া আর রায়ান। গাড়িতে সাধারণত শীতাতপ যন্ত্র চালিয়ে রাখা হয়, কিন্তু আজ আর সেটা করলাম না। কারণ বাইরে বসন্তের নাতিশীতোষ্ণ বাতাস বইছিলো। তাই আমরা বসন্তের বাতাস গায়ে মেখে এগিয়ে চললাম। বোটানিক গার্ডেনে প্রবেশ করার সাথে সাথে গায়ে একটা শীতল বাতাসের ছোঁয়া লাগলো। একটু এগিয়ে যেতেই নাকে মধুর মৌ মৌ গন্ধ এসে লাগলো। আমরা সামনে খেয়াল করে দেখি বোটানিক গার্ডেনের স্প্রিং গার্ডেনে ফুটে আছে অনেক ফুল। এই মৌ মৌ গন্ধ সেখান থেকেই আসছে। আমরা নির্দিষ্ট কার পার্কিঙে গাড়ি রেখে ফুলের বাগানের কাছে গেলাম।

সেখানে অনেক মানুষ ফুলের, ফুলের সাথে নিজের বা নিজেদের পরিবারের ছবি তুলছে। আমরাও বিভিন্ন রকমের ছবি তুলতে শুরু করলাম। আমাদের পাশেই এক নবদম্পত্তি ছবি তুলছিলেন। তাদেরকে ছবি তুলতে দেয়ার জন্য আমরা কিছুক্ষণ আমাদের হাঁটা থামিয়ে দিলাম। উনাদের ছবি তোলা শেষ হলে আমাদের ধন্যবাদ দিলেন নির্বিঘ্নে ছবি তোলার সুযোগ করে দেয়ার জন্য। আমি বললাম ইটস ওকে। এ ধরনের সৌজন্যমূলক কথাবার্তা অস্ট্রেলিয়ার পথেঘাটে হরহামেশাই হয়। আমি বললাম আপনি কি বাতাসের গন্ধটা অনুভব করতে পারছেন। উনি বললেন হ্যাঁ। আমি বললাম এটা মধুর গন্ধ। শুনে উনি বললেন, তাই তো ভাবছিলাম গন্ধটা কেন এতো পরিচিত মনে হচ্ছিলো।

তাহিয়া, নাজিহা ও নাবিহা একদলে, আমি ও রায়ান একদলে। আর ননি, বিথি ভাবি ও প্রহর একদলে ভাগ হয়ে ঘোড়া ঘুড়ি করছিলাম। অস্ট্রেলিয়ান বোটানিক গার্ডেনে অন্য সময়গুলোতেও অনেক মানুষের সমাগম থাকে, কিন্তু বসন্তকালে সংখ্যাটা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়। বোটানিক গার্ডেনের বিশাল এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পরিকল্পনামাফিক লাগানো লাখ লাখ গাছ। পুরো বোটানিক গার্ডেন ঘুরে দেখতে হলে আপনাকে সারাদিন সময় নিয়ে আসতে হবে। গার্ডেনের হ্রদগুলোতে হাঁস, পানকৌড়ি সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। আপনার কপাল ভালো হলে শতবর্ষী কচ্ছপের দেখাও পেয়ে যেতে পারেন।

এছাড়া কপাল যদি আরও একটু ভালো হয় তবে পেয়ে যেতে পারেন ক্যাংগারুর দেখাও। আগের সপ্তাহেই প্রতিবেশী ফাহিমা, সজীব তাদের দুই কন্যা জেইনা এবং জাহিয়াকে নিয়ে ঘুরতে গিয়ে ক্যাংগারুর দেখা পেয়েছিলেন। গার্ডেনের বসন্ত বাগানের পিছনে আর মূল বাগানের মাঝামাঝি ঢালু জায়গায় অনেক বড় করে ইংরেজিতে ‘ত্রিশ’ লেখা আছে। কারণ এই বাগানটা অফিসিয়ালি উদ্বোধন হয়েছিলো ১৯৮৮ সালে, সেই হিসেবে গত বছর এটা ত্রিশ বছর পার করেছে, তারই মাইলফলক হিসেবে এই ত্রিশ লেখা।

ঘুরতে ঘুরতে আমাদের ক্ষিধে পেয়ে গেলো। বোটানিক গার্ডেনের মধ্যে রয়েছে বাচ্চাদের জন্য একটা পার্ক, একটা ক্যাফে, টয়লেট আর শেডের তলায় আছে বারবি কিউয়ের ব্যবস্থা। তবে ক্যাফেতে খাবারের দাম আমার কাছে একটু চড়াই মনে হয়েছে। ক্যাফেতে যেয়ে আমরা একটা বড় টেবিল নিয়ে বসে গেলাম। রায়ান আর প্রহর খুশিতে চিৎকার করে পুরো পরিবেশ গরম করে তুলছিলো। আমি পাশের টেবিলের দিকে তাকিয়ে বললাম, টু মাচ নইজ। উনারা বললেন, ব্যাপার না, বাচ্চারা এমন করবেই। এটাও অস্ট্রেলিয়ার সংস্কৃতির অংশ। আপনি যদি আপনার ভুল স্বীকার করে নেন তাহলে সবাই আপনাকে সাধুবাদ জানাবে। ননি খাবারের অর্ডার দিয়ে দিলো। এই ফাঁকে যাদের টয়লেটে যাবার দরকার ছিলো তারা টয়লেট সেরে আসলো।

খাবার আসলে আমরা গাপুসগুপুস করে খেয়ে নিলাম। খাবার শেষে বাচ্চারা পাশের পার্কে খেলতে চলে গেলো। আমরা বড়রা আরো কিছুক্ষণ টেবিলে বসে আমরাও ওদের সাথে যোগ দিলাম। এখানে উল্লেখ্য ক্যাফের কিচেন বন্ধ হয় তিনটায়। এরপর অবশ্য স্ন্যাকস জাতীয় অন্য খাবারগুলো পাওয়া যায়। পার্কে কিছুক্ষণ খেলাধুলার পর আমি বিথি ভাবিকে বললাম এইবার আপনাদেরকে আসল বাগানে নিয়ে যাবো। এতক্ষণ যে ফুলের সমারোহ দেখেছেন সেগুলো শুধু বসন্তকালীন অস্থায়ী ফুলের বেড।

এরপর আমরা মূল বাগানের দিকে যাত্রা করলাম। বাসন্তী বাগানের ফাঁকে কয়েকটা ধাতব মৌমাছির মূর্তি আছে। মূর্তি দুটোর কংকাল ধাতুর তৈরি হলেও শরীরটা মাটির এবং সেই মাটির মধ্যে শরীরের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন রকমের ফুলের গাছ লাগানো। দেখতে অনেক সুন্দর। অন্যান্য সময়ে এতো বেশি সুন্দর না লাগলেও শরীরের বাসন্তী ফুলগাছগুলোতে এই সময়ে ফুল ফুটে মৌমাছিগুলোকে জীবন্ত রূপ দেয়। বাচ্চারা এমন মৌমাছি দেখে খুবই অবাক হলো। অনেকেই মৌমাছির সামনে পিছনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলেন। আমিও এক মা-মেয়েকে ছবি তুলতে সাহায্য করলাম। এরপর বিথি ভাবিকে মৌমাছির পিছনে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলে দিলাম।

এরপর বাচ্চারা ইংরেজি ‘ত্রিশ’ লেখার মধ্যে যেয়ে ঝুলে পড়লো। আমি বললাম তোমরা সবাই একসাথে দাঁড়াও ছবি তুলে রাখি। তারা কে কী বুঝলো জানি না, তবে একটা ছবি তুলতে পেরেছিলাম। মূল বাগানটা মূলত একটা পর্বত শিখার চারপাশে, তাই শীর্ষে যেতে গেলে আপনাকে ঢালের রাস্তা দিয়ে ঘুরে ঘুরে যেতে হবে। আর যাওয়ার পথেই দেখা মিলবে অনেক রকমের ফুলের। আমরা ঘুরেফিরে একসময় একেবারে চূড়ায় পৌঁছে গেলাম। সেখানে এক টুকরো সবুজের বিছানা। বাচ্চারা সেখানে যেয়ে শুয়ে পরলো। সেখান থেকে চারপাশে অনেকদূর পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়। সেখানে এক অজি দম্পতি এসে ছব তোলা শুরু করলো। দুটো আফ্রিকান বাওবাব গাছ আছে সেখানে। যেগুলো দেখতে সাধারণ গাছের উল্টো, মনে হয় মাটি থেকে হঠাৎ একটা আস্ত কাণ্ড বের হয়ে গেছে। তারপর কাণ্ডের মাথার শাখাগুলোকে মনে হয় যেন শিকড়। অজি ভদ্রমহিলা একটা বাওবাব গাছকে জড়িয়ে ধরে আছে আর ভদ্রলোক তার ছবি তুলছে দেখে আমি পাশ থেকে বললাম, কেউ একজন গাছের সাথে ভালোবাসা করতেছে। আমার কথা শুনে উনারা দুজনেই হেসে দিলেন।

তারপর ভদ্রলোক বললেন, এটাতো আফ্রিকান বাওবাব গাছ। আমি বললাম, জি এটা বাওবাব গাছ। উত্তর শুনে উনি গাছের ছোট্ট নেমপ্লেট দেখিয়ে বললেন কিন্তু এখানে তো অন্য নাম লেখা। আমি বললাম, এটাকে বলে সায়েন্টফিক নাম। কিন্তু আমি নিশ্চিত এটা বাওবাব গাছ। তারপর উনারা আমাদের বিদায় জানিয়ে এগিয়ে গেলেন অন্য বাওবাব গাছটার দিকে। আমি তখন আবারও বললাম, ডোন্ট লুজ হার উইথ দ্য ট্রিস। আমার কথা শুনে ভদ্রলোক আবারও হাত নেড়ে সায় দিলেন।

এরপর আমরা গাছের ছায়াঢাকা পথ পার করে একটা খোলা জায়গায় এসে পৌঁছলাম। সেই জায়গাটায় বোটনিক গার্ডেনের সবচেয়ে উঁচু জায়গা। পাশেই একটা বিশাল আকারের গোলাকৃতি পানির ট্যাংক। একটা রাস্তা চলে গেছে পানির ট্যাংকের দিকে। সেই রাস্তায় দাঁড়ালে দূর থেকে মনে হবে আপনি শূন্যে দাঁড়িয়ে আছেন, কারণ রাস্তাটার পিছনে পুরোপুরি ফাঁকা। তাহিয়া আর নাজিহা সেখানে এসে দাঁড়ানোমাত্র আমি বললাম তোমাদের ছবি তুলে দিই। আমি আসলে চাইছিলাম ওরা একটু লাফ দিক, তাহলে সত্যি সত্যিই ওদের শূন্যে ভাসার ছবি তোলা যাবে।

কিন্তু সেটা আর বললাম না, কারণ একটু আগে নাবিহা এই ঢাল বেয়ে নামতে যেয়ে তাল রাখতে না পেরে পড়ে যেয়ে হাঁটুর কাছে ছিলে ফেলেছে। ননি আর বিথি ভাবি তখন ওকে নিয়েই ব্যস্ত। রায়ান তার স্বভাবসুলভ ভংগিতে তাহিয়া আর নাজিহার সাথে দুষ্টমিতে মেতে উঠলো। এভাবে চলতে চলতে আমাদের সময় ফুরিয়ে এলো। এখানে উল্লেখ্য বোটানিক গার্ডেন শীতকালে বিকাল পাঁচটা এবং গ্রীষ্মকালে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত খোলা থাকে।

বোটানিক গার্ডেনে এর আগেও আমরা গিয়েছি এবং তার সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হয়েছি। কিন্তু এবারের ভ্রমণটা ছিলো মনে রাখার মতো। কারণ সারাটা সময়ই আমাদের নাকে ফুলের মধুর মৌ মৌ গন্ধটা লেগে ছিলো। তাই এবারের ভ্রমণটাকে আমরা বললাম, ‘মৌমাছিদের সঙ্গে একটা বিকেল’। ফিরে আসার সময় ননি বলল, তোর সঙ্গে এমন আরো কিছু জায়গায় যাওয়া দরকার।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!