ওভাল ক্রিকেট মাঠে আন্তর্জাতিক রাবার সম্মেলন

সেপ্টেম্বরের দুই তারিখে সস্ত্রীক জার্মানি থেকে সরাসরি লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি৷ সকালে লাইপসিশ বিমানবন্দর থেকে রওনা করে স্টুটগার্টে লম্বা একটা ট্রানজিট বিরতি পেরিয়ে বিকেলে পৌছাই লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে৷

মাহবুব মানিক, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Sept 2019, 08:00 AM
Updated : 8 Sept 2019, 08:00 AM

এরপরেই লন্ডন টিউব ধরে চল্লিশ মিনিট ক্লান্তিকর পথ পাড়ি দিয়ে পৌছাই ক্যানিংটাউন হোটেলে৷ ক্যানিং টাউন হোটেলে উঠলেও প্রকৃতপক্ষে অফিসিয়াল কাজের গন্তব্য ছিল লন্ডনের ওভাল ক্রিকেট গ্রাউন্ডে৷ কাজটা ক্রিকেট গ্রাউন্ডে হলেও কাজের সাথে কোনভাবেই ক্রিকেটের কোন সম্পর্ক বা দুঃসম্পর্ক নেই৷ আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয় এটা আসলে কোন কাজ নয়৷

অনেক বড় একটা বোঝা কাঁধে নিয়ে ওভাল ক্রিকেট গ্রাউন্ডে আসা হয়েছে৷ মার্সেবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাবার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের গবেষকদের প্রতিনিধি হিসেবে এসেছিলাম এই ওভাল ক্রিকেট গ্রাউন্ডে৷ একজন প্রতিনিধি মানে অনেক বড় দায়িত্ব৷ নিজের সম্মান যেমন দেখতে হয় তেমন দেখতে হয় সহকর্মী বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান৷

ব্যাপারটা ‘আন্তর্জাতিক রাবার সম্মেলন’ বলে কথা৷ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রাবার সম্মেলন৷ বড় বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সব বড় বড় সব গবেষক ও অধ্যাপক এই সম্মেলনের আমন্ত্রিত অতিথি৷ এই বছরে তিন থেকে পাঁচ সেপ্টেম্বর মোট তিন দিন ধরে লন্ডনের ওভাল ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত হয় এই বৃহত্তম সম্মেলন৷ উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের নাম করা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় একশত ষাট জন গবেষক অংশগ্রহণ করেন এই বৃহত্তম সম্মেলনে৷

গবেষক ছাড়াও পৃথিবীর বড় বড় সব রাবার পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তাদের তৈরি যুগোপযোগী সব রাবার নির্মিত পণ্য বা মেশিনারিজ নিয়ে হাজির হয় দর্শকদের নজর কাড়তে৷ সব মিলিয়ে ওভাল ক্রিকেট গ্রাউন্ডে প্রায় শ'পাঁচেক মানুষের মিলনমেলা৷

আমার বর্তমান গবেষণার কাজ এই সম্মেলনে প্রদর্শনের জন্য আবেদন করা হলে এই বছরের মার্চের দিকে সেটা প্রদর্শনের জন্য নির্বাচিত হয়৷ আমার কাজের বিষয় ছিল, রাবারকে নমনীয় করতে অনবায়নযোগ্য তেল যেমন- খনিজ তেলের পরিবর্তে নবায়নযোগ্য তেল যেমন- আংশিক পরিবর্তিত ভোজ্যতেল দিয়ে রাবার নমনীয়করণ করে তার গুণগত মান বৃদ্ধি করা৷ পুরো ব্যাপারটাই ছিল পরিবেশবান্ধব তেল, কার্বন ন্যানো আকারের গুড়া ও অন্যান্য উপাদান দিয়ে রাবারকে মিশ্রিত করে সেটা ভুলকানাইজেশন করে সেটা ছিড়ে ফেলার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি বৃদ্ধি করা৷

যেহেতু ব্যাপারটা পরিবেশবান্ধব এবং এই ধরনের কাজ এটাই প্রথম, তাই সম্মেলন কর্তৃপক্ষ এটা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে গবেষণাপত্র উপস্থাপনের জন্য নির্বাচিত করে৷ দিনপঞ্জি অনুযায়ী অনুষ্ঠানের শেষ দিন সকালে ছিল আমার উপস্থাপনা৷ অন্য সবার মতই আমার জন্য নির্ধারিত ছিল পঁচিশ মিনিট৷ সব ভয়ভীতি কাটিয়ে গবেষণার কার্যধারা, ফলাফল ও বিশ্লেষণ উপস্থাপনা শেষে যখন বিজ্ঞ মানুষগুলোর হাততালি পেলাম তখনই অনুধাবন করতে পারলাম যে- কাজের সফলতা ঠিক কতখানি৷ তাদের মতামত ও পরামর্শ ও গ্রহণ করলাম সাদরে৷ ভবিষ্যতের কর্মপরিকল্পনাও সংক্ষেপে জানিয়ে দিলাম৷

মজার বিষয় হচ্ছে যদিও আমি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করিনি তারপরও আমিই একমাত্র বাংলাদেশি যে সেখানে তার গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছে৷ তবে সম্মেলনে ওপার বাংলার দুই থেকে তিনজন গবেষকের দেখা মিলেছে৷ এর মধ্যে একজন আমার মতই ভিনদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছে, বাকি দুই একজন আইআইটি খড়গপুর থেকে এসেছে৷ অনেক খোঁজাখুজি করে বাংলাদেশি কারো দেখা মিলেনি৷

রাবার গবেষণায় বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের গবেষকগণ সম্ভবত অনেক পিছিয়ে বা এই ক্ষেত্রে তারা গবেষণায় খুব একটা আগ্রহী নয়৷ গত বছরে নুরেমবার্গে যখন জার্মান রাবার সম্মেলনে যোগ দিই সেখানেও শত শত গবেষকদের মাঝে  বাংলাদেশি কোন গবেষকের দেখা মিলেনি৷ অন্তত দুই একজন হলেও থাকবে বলে আশা করেছিলাম যদিও নিরাশ হতে হয়েছে৷

আমার অফিসিয়াল পরিচয় জার্মান হলেও আনঅফিসিয়াল পরিচয় ছিল বাংলাদেশি৷ যখনই কেউ জিজ্ঞেস করে কোথা থেকে এসেছি স্বাচ্ছন্দ বলে দিই- বাংলাদেশ থেকে৷ তারপর ছোট্ট একটা ফুলস্টপ টেনে বলি জার্মানিতে পড়াশোনা ও পরবর্তীতে কাজ করছি৷ জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হয়েই এসেছি৷ গবেষণাপত্র উপস্থাপনার আগে সূচনা পর্বে যখন গবেষকদের বায়োডাটা পড়ে শোনানো হয় তখন সব ব্যক্তিগত তথ্যের মধ্যে যখন বাংলাদেশ কথাটা বলে তখন শরীরটা শিহরিত হয়ে যায়৷ যাক বিজ্ঞ এই মানুষগুলো আন্তর্জাতিক রাবার সম্মেলনে অন্যান্যদের সাথে বাংলাদেশকেও তাদের পাশাপাশি দেখতে পাচ্ছে৷

আরো যে ব্যাপারটি রোমাঞ্চিত করেছে সেটি হচ্ছে ঐতিহাসিক ওভাল ক্রিকেট গ্রাউন্ডের ভিতরে বাহিরে অবাধ প্রবেশ৷ এ এক বাঁধভাঙ্গা রোমাঞ্চ৷ গবেষকদের উপস্থাপন শুনে শরীরটা ক্লান্ত হয়ে গেলে কখনো ভিআইপি স্যুটে চুপচাপ বসে থাকি৷ আবার কখনো বিছানার চাদরের মতো নরম সবুজ ঘাষের মাঠে একটু ঘুরে আসি৷ কখনো বা ঝিরঝিরে বাতাসে মগভর্তি কফি নিয়ে গ্যালারির সবুজ-নীল-সাদা চেয়ারে বসে শরীর জুড়াই৷ জার্ডিন কক্ষ, জন মেজর কক্ষ, ইংল্যান্ড কক্ষ, ইন্ডিয়া কক্ষ, পাকিস্তান কক্ষ সবগুলো কক্ষ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পুরাতন ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর ছবি, ঐতিহাসিক পটভূমিতে ব্যবহৃত ব্যাট-বল-হেলমেট সহ ক্রিকেট সামগ্রীর সবকিছুই৷

এক কথায় ক্রিকেটহীন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে তিনটি দিন ধরে রাবার গবেষকদের জয়জয়কার৷ দুই বেলা খানাপিনাসহ গবেষকদের আরাম আয়েশের দায়িত্বে ছিল ওভাল ক্রিকেট স্টেডিয়ামের অফিসিয়াল হোস্ট সারে কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবের একঝাক কর্মচারী৷ প্রায় পঞ্চাশজন মতো কর্মচারী সদা ব্যস্ত ছিল খানাপিনা থেকে শুরু করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ সবকিছু ঠিকঠাকভাবে সম্পাদন করতে৷

গবেষণাপত্র উপস্থাপনা, গ্যালারিতে বসে অনিয়ন্ত্রিত খানাপিনা, গল্প গুজব চলেছে পুরো তিনটি দিন জুড়ে৷ সেখানেই হেঁটেছি যেখানে হেঁটেছে ক্রিকেটের সব বড় বড় কিংবদন্তি৷ ডন ব্রাডম্যান, ডেভিড শেফার্ড, কপিলদেব, ইমরান খান, কোর্টলি ওয়ালশ, মাইক গ্যাটিং, জিওফ্রি বয়কট, ব্রায়ান লারা, শেন ওয়ার্ন এখানেই পদচিহ্ন রেখে গিয়েছে৷ সব মিলিয়ে তিনটি দিন ছিল ক্রিকেটের কিংবদন্তিদের জগতে রাবার গবেষকদের জয়জয়কার৷

লেখক: পিএইচডি গবেষক, রাবার টেস্টিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভিশন, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব  অ্যাপ্লাইড সায়েন্স, হালে, জার্মানি