প্রবাসীর চোখে মালয়েশিয়ার স্বাধীনতা উৎসব

চোখের কোণে জল চলে আসে। যদিও চোখের সেই জল সংবরণ করি, গড়িয়ে পড়তে দিই না। মনটা খুব কোমল হয়ে যায়। বারবার চোখে ভাসে তখন বাংলাদেশের পতাকা।

রফিক আহমদ খান, মালয়েশিয়া প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Sept 2019, 05:43 AM
Updated : 1 Sept 2019, 05:43 AM

মালয়েশিয়ার ছোটো-ছোটো হাজারো পতাকার ভিড়ে আমার চোখে ভাসে লাল-সবুজের প্রিয় পতাকাটা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ত্রিশ লাখ শহীদের ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপণ লড়াইয়ে এনে দেওয়া সেই পতাকা। আহা রে বিনা রক্তপাতে পাওয়া স্বাধীনতা নিয়ে কতো গর্বিত মালয়েশিয়রা। আমাদের তো রক্তে কেনা স্বাধীনতা। নিশ্চয়ই আমরাই বেশি গর্ব করতে পারি স্বাধীনতা নিয়ে।

আমরা তো যুদ্ধে বিজয়ী জাতি। আমাদের যুদ্ধ বিজয়ের সঙ্গে অন্য কোন দেশের স্বাধীনতা লাভের সাথে তুলনা হয় না। সেখানে আমরাই সেরা। এজন্য আমরা চির কৃতজ্ঞ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে, আমরা কৃতজ্ঞ একাত্তরের শহীদদের কাছে, আমরা কৃতজ্ঞ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে, আমরা কৃতজ্ঞ একাত্তরে নির্যাতিত মা-বোনদের কাছে।

যে জন্য চোখের কোণায় জল টলমল করে সে কথায় আসি। মালয়েশিয়ার স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান দেখার সময়ই আমার চোখে জল আসে। কারণ, মালয়েশিয়ার এই জাতীয় অনুষ্ঠানটি ওরা দলমত নির্বিশেষে নারীপুরুষ ছোট-বড় সবাই একসঙ্গে সেলিব্রেট করে। কুয়ালালামপুরে 'দাতারান মারদেকায়’ (স্বাধীনতা স্কয়ার) ও এর আশপাশে  বিশাল জমায়েত হয় থার্টিফার্স্ট অগাস্ট রাতে। হাজার হাজার মানুষের আগমন। বলা যায় লাখো মানুষের সমাগম মারদেকায়।

লাখো মানুষের ভিড়ে সে জমায়েতে কোলের শিশু আছে হাজার হাজার। এমনকি এক সপ্তাহ বয়সী শিশু খোঁজলেও পাওয়া যাবে। দুয়েক মাস বয়সী শিশু তো অগণিত। ঘরের বয়স্করা ঘরে বসে নেই, তারাও আছেন মারদেকার মাঠে মারদেকা সেলিব্রেশনে। ত্রিশ অগাস্ট বিকেল থেকে শুরু করে মধ্যরাত বারটায় মূল অনুষ্ঠান উপভোগ করে বাড়ি ফেরেন তারা।

এতো মানুষের আগমন, এতো বড় জমায়েত, অথচ কোন ধাক্কাধাক্কি নেই, ঠেলাঠেলি নেই, ছোটো নেতা বড় নেতা কোনো নেতাগিরি নেই, ইভটিজিং নেই, ধূমপান নেই, মাঠে ময়লা নেই, ধুলাবালি নেই, শিশুরা হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই। আছে শুধু সম্প্রতি, দেশের প্রতি ভালোবাসা, অন্যের প্রতি সম্মান, দেশের রাজার প্রতি সম্মান, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সম্মান, দেশের পতাকার প্রতি সম্মান। আছে সবার মুখেমুখে দেশাত্মবোধক গানের সঙ্গে সঙ্গে সুর। গানের ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা গল্প। কী দারুণ পরিবেশ! এতো মানুষ, তারপরও যেন নির্মল পরিবেশ। কে ধনী কে গরীব বোঝার উপায় নেই। সবাই যেন একই পরিবারের মানুষ। মালয়েশিয়দের ভিড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষও আছেন, উপভোগ করছেন মালয়েশিয়ার স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান।

আমাদের দেশে মাঠে-ময়দানে এত বড় কোন অনুষ্ঠান হলে সেখানে অযথা কতো ঠেলাঠেলি হয়, ধাক্কাধাক্কি হয়, নেতাগিরি প্রদর্শন হয়, ইভটিজিং হয়- এসব ভেবেই মূলত কোণের চোখে জল আসে। আমরা কেন এমন সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারি না। দেশের সব নাগরিককে সমান মনে করি না। দেশের অনুষ্ঠানে কেন নেতাদের ভিড় থাকবে। কেন সার্বজনীন অনুষ্ঠান করতে পারি না।

মারদেকা অনুষ্ঠানে হাজার হাজার মালয়েশিয় যখন সমস্বরে উচ্চারণ করে 'সায়া আন্নাক মালয়েশিয়া' যার অর্থ 'আমি মালয়েশিয়ার সন্তান', তখন আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে 'আমি বাংলাদেশের সন্তান'।

১৯৫৭ সালের ৩১ অগাস্ট আলোচনার ভিত্তিতে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে মালয়েশিয়া। স্বাধীনতা অর্জনে ব্রিটিশদের সঙ্গে আলোচনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন ফেডারেশন অব মালায়ার মুখ্যমন্ত্রী টুনকু আবদুর রহমান। তিনিই ১৯৫৭ সালের ৩১ অগাস্ট কুয়ালালামপুরের স্টেডিয়াম মারদেকায় মাঠভর্তি জনতার সামনে মালয়েশিয়ার স্বাধীনতা (মারদেকা) ঘোষণা করেন। কুয়ালালামপুরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই ময়দানটি এখন মারদেকা স্কয়ার নামে পরিচিত, মালয় ভাষায় 'দাতারান মারদেকা'।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!