কানাডায় জাবি সাবেক শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলনী

সবুজের চাদরে মোড়া বিশাল মাঠ। ছোট্ট ঢাল নেমে এসেছে একপাশ দিয়ে। মাঠের এক কোণায় গোল হয়ে আছে বিশাল এক জটলা, সুরেলা আওয়াজ মনে হচ্ছে। সত্যিই তো, একদল তরুণ-তরুণীদের মধ্যে গানে গানে চলছে মিষ্টি মধুর লড়াই।

নাহিদ আশরাফি, কানাডা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 August 2019, 08:25 AM
Updated : 27 August 2019, 08:25 AM

এখানে হার-জিতের কোনো ভাবনা নেই, রয়েছে শুধুই ভালোবাসা। দৃশ্যটাতো খুবই পরিচিত, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল মাঠ। ওপাশে মাঝমাঠে ওরা সব কি করছে? রঙ্গিন ফিতা-বেলুন-বাঁশি নিয়ে চলছে ছোটাছুটি, এটাওতো পরিচিত দৃশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অ্যানুয়াল স্পোর্টস ডে’!

সুন্দরী সব মেয়েরা ট্রেন্ডি পোশাকে, আর তাদের আশপাশে ছায়া হয়ে ঘুরছে হ্যান্ডসাম ছেলেরা। আম ভর্তা, ঝাল-মুড়ি, চা, পান-সুপারি, আলতা, তাসের আসর, ঢং করে ছবি তোলা, এসব নিয়েইতো আমাদের প্রাণের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

কানাডার গ্রেটার টরন্টোর ভনে অবস্থিত ‘বয়েড কনজারভেশন পার্কে’ এভাবেই জমেছিলো জাবির দুই শতাধিক অ্যালামনাই ও তাদের পরিবারের আড্ডা। শীতপ্রধান দেশে বাইরের পিকনিকগুলো জমে মূলত গ্রীষ্মকালেই। চারদিকে শুধু উৎসব আর আনন্দ। জাবি টিমও বসে নেই, এবারের পিকনিকে থাকতে হবে একটু নতুনত্ব। আয়োজকদের ভাবনায় নতুনত্ব, টরোন্টোতেই করা হবে জাবি ক্যাম্পাসের রেপ্লিকা।

সারাদিন যার যার কাজে ব্যস্ত, টানা দুই সপ্তাহ সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত অবধি চলে পিকনিক আয়োজনের পরিকল্পনা। সাধ ও সাধ্যের সমন্বয় করা খুবই কঠিন, তাতে কি হাল ছাড়া যাবে না। নতুন ভাবনা নিয়ে পিকনিকের পস্তুতি শেষ হলো। দেখা যাক কি হয়।

অগাস্টের ১৭ তারিখ পিকনিক, সবার আশায় গুড়েবালি দিয়ে ভোর থেকে শুরু হয়ে গেলো ‘কুত্তা-বিলাই’ বৃষ্টি, মানে মুষলধারে। একেতো মন খারাপ তার উপরে অ্যালামনাইদের একের পর এক ফোনে আয়োজকদের কান ঝালা-পালা। ভাইয়া/আপু পিকনিক হবে? কিভাবে, আহা উহু ইত্যাদি।

রাতদিন এক করে যে পরিশ্রমের পিকনিক, তা শেষে কিনা ‘ডাকওয়ার্থ লুইস’ পদ্ধতিতে শেষ করতে হবে! কিচ্ছু করার নাই, যা হয় কপালে চলো সবাই পিকনিকে। অবাক করা বিষয়, সকাল ১০টার দিকে বৃষ্টিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সূর্যমামা তার প্রখরতা নিয়ে তাণ্ডব শুরু করে দিলো। কানাডার আবহাওয়া আসলে এমনই। আমরাও খুশি।

বেলা ১১টা থেকে শুরু হলো অ্যালামনাইদের আগমন, সত্যিতো সবকিছুতেই নতুনত্ব। পিকনিক ভেন্যুতো দেখতে একেবারেই জাবি ক্যাম্পাসের মতো, সাথে মানানসই করে ভেন্যুর সাজ-সজ্জা। ফানুশ, শলার পাখি, রঙ্গিন কাগজ, বেলুন, আরও কত কি, এক্কেবারে পিকনিক পার্টি। পাশাপাশি চলছে মাইক্রোফোন হাতে আয়োজকদের ক্যাম্পাসের মতো করে খুনশুটি জড়ানো কথামালার ফুলঝুড়ি।

নতুনত্বেরতো শেষ নেই, এতো পুরাই জাবি ক্যাম্পাস!

এক কোণে গাছের নিচে চলছে আলতা সুন্দরীদের জমজমাট আড্ডা, অন্য গাছতলায় রয়েছে পান-সুপারির আসর, অবসর বিনোদনের জন্যও রয়েছে বিশেষ আয়োজন ‘তাসের আড্ডা’। এত্ত আয়োজনে বোর হওয়ার অবসরই পায়নি অতিথী ভাই-বোনেরা।

এতো গেলো বিনোদনের চমক। অ্যালামনাইরা সকালের নাস্তার টেবিলে এসেও পেলেন নতুনত্ব, টেবিলে থরেথরে সাজানো রয়েছে পিঠা-পুলি, পিয়াজু, পাটিসাপটা। এত্ত মজার

পিঠা পেয়ে আমরা সবাই ঝাপিয়ে পড়লাম, নিমেষেই নাস্তা খাওয়া শেষ। আহা কি তৃপ্তি!

এরই মধ্যে মাঝমাঠে বেলুন, রঙ্গিন ফিতা দেখা যাচ্ছে, কে যেনো হুইসেল বাজিয়ে চলছে। তাইতো! স্পোর্টস ইভেন্ট শুরু হয়ে গেছে। অ্যালামনাইদের ছানাপোনাদের দিয়ে চলছে বিভিন্ন খেলা। ছোটোদের চোখে-মুখে কি আনন্দ। মাঠের এক পাশে একটু বড় বাচ্চাদের দিয়ে ফুটবলের শর্ট কোচিং চলছে, কোচিং করাচ্ছেন আমাদেরই এক অ্যালামনাই বড়ভাই যিনি বর্তমানে আন্তর্জাতিক কোচ হিসেবে দেশে দেশে ঘুরে বেশ সুখ্যাতি অর্জন করেছেন।

হয়ে গেলো সুন্দর একটি ফুটবল ম্যাচ। ছোটোদের খেলা শেষ, এবার অ্যালামনাই ভাইদের নিয়ে বেলুন দৌড়, দুই পায়ের মাঝে বেলুন নিয়ে দিলেন সবাই ভোঁ দৌড়। ধপাস ধপাস ধপাস, সে এক দৃশ্য বটে। এবারে নারীদের ইভেন্টে সুন্দরী সব আপুরা গ্লাসে পানি ঢেলে প্লেটে সাজিয়ে দিলেন জোরসে দৌড়। কে যে কার উপর পানিসহ পড়লো তা আর কি বলি!

ছিলো কাপলদের মজার গেম ‘নট দ্য টাই’, সারা মাঠে ছিটিয়ে রাখা লাল-সবুজ সুতা খুজে এনে দিতে হবে গিট্টু, যার গিট্টু বড় সেই হবে বিজয়ী। সে এক অপরূপ দৃশ্য! স্বামীরা একপাশে সুতা ধরে আছেন, স্ত্রীরা রঙ্গিন সুতায় শক্ত করে ভালোবাসা বুনে যাচ্ছেন!

স্পোর্টস ইভেন্টের মজার বিষয়টি ছিলো, প্রথমদের পুরস্কৃত করার পাশাপাশি পরাজিতদের হাতেও ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে একটি করে হারিকেন।

টানটান আয়োজনের মধ্যে আলতা, পান, তাসের আড্ডায় ঘুরতে ঘুরতে দুপুরে খাওয়ার সময় হয়ে গেলো। মজাদার বিরিয়ানি, শেষে পায়েস। পেটপূজার পরে তো একটা পান চা-ই চাই, পান-সুপারির চাহিদা বেড়ে গেলো আরো জোরেসোরে, সে এক বিশাল জমায়েত।

আরেকটি আয়োজনের কথা বলতেই হয়, তা হচ্ছে ফটো বুথ আর ফটো ফ্রেম। অ্যালামনাইদের সারা দিনের আনন্দময় মুহূর্তগুলো ধরে রাখার জন্য সাধ আর সাধ্যের মত্রা বজায় রেখে বানানো হয়েছিলো এই ‘ওপেন ফটো স্টুডিও’। সারা দিনব্যাপী দেখা গেছে ফটোবুথের চাহিদা। ব্যাচ অনুযায়ী প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে দলবেঁধে বন্ধু-বান্ধবীরা সব খুনসুটি করতে করতে ছবি তোলায় ব্যস্ত। সবার চোখে মুখে কি যে আনন্দের ঝিলিক তা শুধু লেখা দিয়ে প্রকাশ করা যাবে না।

এরই মাঝে বিকেলের আয়োজনে ঝাল-মুড়ি, আম ভর্তা, বারবিকিউ আর তরমুজের স্বাদে সবার তৃপ্ত অভিব্যাক্তি দেখেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়।

জাবি ক্যাম্পাস বলে কথা!জোরসে একটা আড্ডাতো দিতেই হবে। সব অ্যালামনাইরা গোল হয়ে বসে পড়লাম গাছের ছায়ায়, মনে হচ্ছে জাবির সেন্ট্রাল মাঠে চলে এসেছি। সবাই যেনো চলে গেলাম সেই বাঁধন ছাড়া ক্যাম্পাসে। মাইক্রোফোন নিয়ে ছেলেরা গাইছে ‘চার বছর আমি ঘুরলাম রে, ঘুরলাম তোমার পিরিতের আশায়’, মেয়ে দলেরও পাল্টা জবাব ‘আমার মনটা নাই খালিরে....’। ‘আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে....’, ‘টিকাটুলির মোড়ে একটা অভিসার সিনেমা হল রয়েছে...’, এমনিভাবে একের পর এক পাল্টাপাল্টি চললো গানের প্যারোডি, সেই সঙ্গে চলল স্মৃতিচারণ, কে কতবার প্রেমে ব্যর্থ হয়েছেন, অনেকে আবার শোনালেন তাদের সফল প্রেমের মিষ্টি স্মৃতি। দুষ্টু ছোটো ভাইরা শোনালো বড় আপুদের প্রতি ক্রাশ হওয়ার মজার ঘটনাও।

গাইতে গাইতে বেলা শেষ, সন্ধ্যা এলো নেমে। মনে পড়ল ক্যাম্পাসে নই, আমরাতো সবাই টরন্টোতে আছি, যাই হোক পুরস্কার বিতরণী, র‍্যাফেল ড্র, শুভেচ্ছা বক্তব্য পর্ব শেষ করে, প্রাণের জাহাঙ্গীরনগরকে ঘিরে একবুক ভালোবাসা নিয়ে ফিরে গেলাম যার যার ঘরে। রাতে ফেইসবুক খুলেই এক বড় আপুর পোস্টের লেখা ‘যারা এবারের জাহাঙ্গীরনগরের পিকনিকে যায়নি, তারা বিশাল কিছু মিস করেছে’। আহা! প্রাণটা ভরে গেলো! ধন্যবাদ আপু। বিশেষ ধন্যবাদ আয়োজকদের।

ঝলমলে চঞ্চল উজ্জ্বল থাকুক জাবি অ্যালামনাই, কানাডা। অনেক ভালোবাসা।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!