পিতা সৈয়দ আহমাদুল্লাহ ও মাতা নাসিমা আরা খাতুনের গর্ভে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ অগাস্ট চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহর এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ৪৯ বছর বয়সে ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিসে মারা যান। ফ্রান্সের মাটিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সেই কবরের সন্ধানে গিয়েছিলাম আমরা কয়েকজন।
গভীর রাতে অধ্যয়নরত অবস্থায় মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের ফলে তার মৃত্যু হয়। প্যারিসের উপকণ্ঠে তারা একটি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন, সেখানেই ঘটনাটি ঘটে এবং ওখানেই সমাহিত করা হয় তাকে। প্যারিসের উপকণ্ঠে ওই জায়গাটার নাম মদোঁ-স্যুর বেল্ভু।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তার জীবদ্দশায় রচনা করেছেন ‘লালসালু’, ‘চাঁদের অমাবস্যা’ ও ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ নামের তিনটি উপন্যাস। তিনি তার রচিত উপন্যাসগুলোতে তৎকালীন গ্রামীণ সামাজ জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন অত্যন্ত নিবিড়ভাবে। সামাজিক বিষয়, রীতি-নীতি, ব্যক্তি মানুষের দ্বন্দ্বম ও আশা আকাঙ্খা প্রাধান্য দিয়েছেন তার লেখনিতে। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর তিনি কলকাতার ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য স্টেটসম্যান’ এর চাকুরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় এসে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের সহকারী বার্তা সম্পাদকের চাকরি নেন।
উপন্যাসটি তৎকালীন গ্রামীণ মুসলমান সমাজের মানসিকতার এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। তিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’তে তৎকালীন সমাজের ধর্মীয় গোঁড়ামির মর্মমূলে কঠোরভাবে আঘাত করেছেন। তার এ উপন্যাসের পটভূমি গ্রামীণ সমাজ; বিষয় সামাজিক রীতি-নীতি ও প্রচলিত ধারণা বিশ্বাস; চরিত্রগুলো একদিকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মভীরু, শোষিত, দরিদ্র, গ্রামবাসী অন্যদিকে শঠ, প্রতারক, ধর্মব্যবসায়ী ও শোষক-ভূস্বামী। তিনি একদিকে যেমন সমাজের মানুষের ভণ্ডামির চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন তেমনি অন্যদিকে গ্রাম বাংলার সহজ সরল মানুষের ধর্মীয় অনুভূতির চিত্রও ফুটিয়ে তুলেছেন অত্যন্ত নিখুঁতভাবে।
এতে মানুষজনের সমাগম যেমন বাড়ে তেমনি টাকা-পয়সাও আসতে থাকে। এভাবে মজিদের জীবনে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে আসে। এ উপন্যাসের আরেকটি অন্যতম প্রধান চরিত্রের নাম রহিমা। রহিমা ধর্মভীরু ও স্বামীভক্ত ছিল। স্বামীর আদেশ উপদেশ সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করে। মজিদ রহিমাকে বিয়ে করে নিয়ে আসার পরও নিঃসন্তান থাকার অজুহাতে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে বিয়ে করে কিশোরী জমিলাকে। কিন্তু জমিলা রহিমার মতো স্বামীভক্ত নয়। তাই জমিলা মজিদকে যথেষ্ট ভাবিয়ে তোলে। জমিলা ঠিকমতো নামাজ পড়ে না। কখনো হি হি করে হাসে আবার কখনোবা গুম মেরে বসে থাকে। তার বিন্দুমাত্র খোদার ভয় নেই। তাই মজিদ তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পৈশাচিক আচরণের আশ্রয় নিতে কুণ্ঠিত হয়নি।
আর রহিমা মজিদের প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছিল পরিষ্কার গলায়। ওয়ালীউল্লাহ্ উপন্যাসে লিখেছেন, ‘ধান দিয়া কি হইব মানুষের জান যদি না থাকে? আপনে ওরে নিয়া আসেন ভিতরে।’ নরনারীর অবচেতন ও সচেতন মনের নানা ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াই এভাবে লেখকের বিষয় হয়ে উঠেছে ‘লালসালু’ উপন্যাসে।
সে দেখতে পায় বাঁশবাগানে একজন নারী খুন হয়েছে এবং সেই বাঁশবাগানের সামনে আশ্রিতবাড়ীর ছোটছেলে কাদেরকে দেখতে পায়। কিন্তু খুনটি কে করেছে সে সম্পর্কে সে নিশ্চিত হতে পারে না। নিজের ভেতর অসংখ্য বিশ্বাস, মমত্ববোধ দিয়ে সেই খুনের নানা কারণ, নানা ব্যাখ্যা সে দাঁড় করাতে চেষ্টা করে। অসংখ্য প্রশ্ন, অসংখ্য যুক্তির মধ্যে ডুবে থেকে যুবক শিক্ষক আরেফ আলী একটা ঘোরলাগা সময়ে চলে যায়। আর সেখানেই নিজের সাথে নিজের নানাবিধ লড়াই চলে এবং এক সময়ে সমস্ত বিশ্বাসকে যুক্তির আঘাতে ভেঙ্গে দিয়ে সে সত্যটি আবিষ্কার করে। এভাবে সমাজের বাস্তব রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ।
মুহাম্মদ মুস্তাফা একজন পিতৃহীন মানুষ। তার বাবা খেদমুতুল্লা একজন শঠ ও গ্রাম্য টাউট প্রকৃতির মানুষ। কেউ একজন তাকে খুন করে। এই ঘটনা বালক মুস্তফার জীবনে গভীর অভিঘাত সৃষ্টি তৈরি করে। কৈশর ও তারুণ্যের স্বাভাবিক উচ্ছ্বাস হারিয়ে সে হয়ে উঠে অন্তর্মুখীন। অন্যদিকে পিতৃহারা খাদিজাকে নিয়ে তার বিধবা মা মুহাম্মদ মুস্তফার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। পারিবারিকভাবে মুস্তফার সঙ্গে বিয়ের কথা অনেকটা চূড়ান্ত হয়।
কিন্তু খাদিজা পুকুরে ডুবে আত্মহত্যা করে। পরবর্তিত সেখানে সবাই কোথাও একটি দূরস্থিত কান্নার ধ্বনি শুনতে পায়। যে কান্না সবাইকে সংক্রামিত করে। এ উপন্যাসে একদিকে মুহাম্মদ মুস্তফার করুণ জীবনোপাখ্যান, অপরদিকে শুকিয়ে যাওয়া বাকাল নদীর প্রভাবতাড়িত কুমুরডাঙ্গার মানুষের ব্যতিব্যস্ত জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে নিবিড়ভাবে।
মূলত এই তিনটি উপন্যাস রচনা করেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বাংলা উপন্যাসের নতুন দিক উন্মোচন করেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ভাষাশৈলী ও আলোচ্য উপন্যাসগুলোর ভিত্তি এতোটাই জোড়ালো যে, তা কেবল বাংলা সাহিত্যে নয় বিশ্ব সাহিত্যেও অনায়াসে স্থান করে নিয়েছে।
অমর কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ চলে গেলেও সমৃদ্ধ করে গেছেন বাংলা সাহিত্যের আধুনিক ধারাকে। কুসংস্কারমুক্ত ও ধর্মীয় গোড়ামীমুক্ত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পরবর্তী প্রজন্মের আলো। হাজার মাইল দূরে ফ্রান্সের এই কবরে ফুল দিয়ে তাকে স্মরণ করলাম আমরা।
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |