পাতালপুরীর রহস্যময় শহর ডেরিনকুয়্যু

মাটির নিচে আস্ত একটা শহর, যে শহরে সব সুযোগ-সুবিধা আছে। মাসের পর মাস যে শহর থেকে বের হয়ে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে দেখা না করলেও চলে শহরবাসীর। সেরকম একটা শহরের নাম ডেরিনকুয়্যু আন্ডারগ্রাউন্ড সিটি।

ফাতিমা জাহানফাতিমা জাহানতুরস্ক থেকে
Published : 14 August 2019, 05:27 AM
Updated : 14 August 2019, 05:49 AM

তুরস্কের কাপাদোকিয়া রাজ্যে অবস্থিত এ শহরটি তুরস্কের সবচেয়ে বড় ভূগর্ভস্থ শহর। তুরস্কে আরো কয়েকটি ভূগর্ভস্থ শহর রয়েছে। তবে ডেরিনকুয়্যু আকারে সবচেয়ে বড়।

ইস্তাম্বুলের পর পামুক্কালে ও কাপাদোকিয়া হলো তুরস্কের আকর্ষণীয় ট্যুরিস্ট স্পট।

কাপাদোকিয়া বিখ্যাত এর সারিবদ্ধ কোন আকারের ধূসর পর্বতমালার জন্য। পর্বতের ভেতরে গুহা ও গুহায় মানুষ বসবাস করে। আজকাল গুহায় হোটেলও খোলা হয়েছে, গুহায় বসবাসের অভিজ্ঞতার জন্য। আমি নিজেও এমন একটা গুহা হোটেলে উঠেছি।

কাপাদোকিয়া প্রদেশের দর্শনীয় স্থানগুলো একটা আরেকটার চেয়ে বেশ দূরে অবস্থিত আর যাবার জন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্টের তেমিন সুবিধা নেই। অগত্যা আমি একটা প্যাকেজ ট্যুর নিলাম।

সাধারণত আমি একাই এসব জায়গা নিজের মতো এক্সপ্লোর করি। গ্রুপের সঙ্গে গেলে তাড়া লাগাতে থাকে গাইড বা অন্যরা তাই ভ্রমনে আনন্দ থাকে না। সকালে নাস্তা সারতেই হোটেলের সামনে গাড়ি চলে এলো ট্যুর এজেন্টের অফিস থেকে। গন্তব্য ডেরিনকুয়্যু আন্ডারগ্রাউন্ড সিটি।

ভেন্টিলেটর

মিনিবাসের মতো গাড়িতে সহযাত্রী সামনের সিটে দুজন তুর্কি দম্পতি, আমার পাশের সিটে ভারতীয় বৃদ্ধ দম্পতি, পেছনের সিটে দুজন ভারতীয় নারী, তাদের পাশে দুজন আমেরিকান নারী। একদম পেছনের সিটে দুজন মেসেডোনিয়ান নারী ও পুরুষ। এদের সঙ্গে আমি বেখাপ্পা সোলো ট্রাভেলার খ্যাত বাঙাল। ড্রাইভার ইব্রাহীম ও গাইড গুল শাহ।

গোরেমে শহর পার হতেই দুপাশে অবারিত সবুজ গম খেত। গম খেতের আরেকটু পেছনে সবুজ পাহাড়। পাহাড়ের চূড়ায় বসন্তের জানান দিয়ে রয়ে গিয়েছে কিছু গত হয়ে যাওয়া শীতের বরফ। আর পাহাড়ের গায়ে আঁকিবুঁকি কেটেছে বরফের অল্প অল্প নকশা। এত মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে দেখতে আমি ভুলেই গেলাম যে গাড়িতে বসে আছি। আমি চলে গিয়েছিলাম পাহাড়ের গা বেয়ে আরো ওপরে, পাহাড় চড়া শখ আমার, পাহাড় হাতছানি দিয়ে ডাকে সবসময়।

পাহাড় আর গম খেতকে আরো কাছ থেকে দেখার জন্য ভেবে নিয়েছিলাম পাহাড়ের পথ ধরে চলে গিয়েছি ওপরের রাজ্যে। পথে পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নাম না জানা বুনো ফুলের ঝোপঝাড়। কেউ বুনে দিয়ে যায়নি, এমনিই জন্মে হলুদ, লাল, নীলে শোভা বাড়াচ্ছে সবুজ খেতের।

ওদিকে গুল শাহ কি যেন বলে যাচ্ছে, সেসব আমার কানে যাচ্ছে না। ঘণ্টাখানেক গাড়ি চলবার পর গাড়ি থামল বোধহয় কোন ট্যুরিস্ট স্পটে, সম্বিৎ ফিরে পেলাম। গাড়ি থেকে নেমে গুল শাহকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় এসেছি আমরা?’ গুল শাহ এক ঝাড়ি দিয়ে বলল, ‘আমি যে আধ ঘণ্টা ধরে বকবক করছি তা শোনোনি?’

গাল ফুলিয়ে বললাম, ‘শুনলে কি আর আবার জিজ্ঞেস করি? বলোনা কোথায় আছি।’     

গাল ফুলালে পাথরও গলে যায় আর গুল শাহ তো ফুলের মতো একটা মানুষ। আমরা পৌঁছে গিয়েছি ডেরিনকুয়্যু আন্ডারগ্রাউন্ড সিটিতে। কয়েকটা স্যুভেনিয়রের দোকান আর রেস্তোরাঁ ঘিরে রেখেছে ভূগর্ভস্থ শহরের প্রবেশপথ।

গুল শাহ জিজ্ঞেস করল কারো শারীরিক সমস্যা আছে কিনা, সারফেসের নিচে যাবার জন্য। ভারতীয় মেয়ে দুটো বলল তারা নিচে যাবে না, বাইরেই থাকবে, শারীরিক সমস্যা নেই, কিন্তু ভয় পাচ্ছে। হায়রে সাহসী কন্যারা, এতদূর এসে এত আকর্ষণীয় স্থান মিস করবে! অবশ্য একেকজনের পছন্দ একেক রকম, কারো ঐতিহাসিক স্থান পছন্দ তো কারো প্রকৃতি, কারো আবার কিছুই পছন্দ না, এমনিই ঘুরে বেড়ানো। বাকিদের নিয়ে মার্চ করতে করতে গুল শাহ চলল মাটির নিচের সেই বিস্ময়কর শহর দেখাতে।   

ডেরিনকুয়্যু আন্ডারগ্রাউন্ড সিটির নির্মাণকাল আনুমানিক কয়েক মিলিয়ন বছর আগে। কোমল আগ্নেয়শিলা থেকে প্রাকৃতিকভাবে গঠিত হয়েছে পর্বমালা ও ভূগর্ভ। এ ধরনের শিলা খোদাই করা ছিল সহজ, তাই বসতি স্থাপনের জন্যও উপযুক্ত।  খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ শতাব্দীর কিছু রেখাচিত্র দেয়ালে পাওয়া যায় যাতে প্রমাণ মেলে এ স্থানে জনবসতির।   ফ্রিজিয়ান গ্রিকরা এ শহর নির্মাণ করেছিল সেসময় শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য আর মাটির নিচে পালিয়ে থাকার জন্য, তাও হবে হাজার দুয়েক বছর আগে।

শত্রুর জন্য ফাঁদ

দালিলিক প্রমান না থাকলেও শহরের দেয়াল লিখন থেকে তাই ধারণা করা হয়। বাইজেন্টাইন সময়ে এ শহরের ব্যবহার লক্ষণীয়, কারণ তখন আরব দেশ থেকে আক্রমন করা হতো বাইজেন্টাইন খ্রিস্টানদের। ৭৮০-১১৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আরব দেশগুলো তুরস্কে ঘন ঘন আক্রমন করতে থাকে। তখন এ শহরটি অন্যান্য ভূগর্ভস্থ শহরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত ভূগর্ভস্থ লম্বা রাস্তা ব্যবহার করে।

প্রায় কুড়ি হাজার মানুষ ধারণক্ষম এ শহরটিতে বায়ু চলাচলের জন্য ভূমিতে অবস্থিত একটি কুয়ার একাংশ ব্যবহার করা হত যার উচ্চতা ছিল ৫৫ মিটার। এ কুয়া থেকে মাটির ওপরে থাকা গ্রামবাসীদের যেমন জলের অভাব মিটত তেমনি নিচে বসবাসকারীদেরও অক্সিজেন মিলত। শহরে আঠারোটি লেভেল বা তলা রয়েছে। অবশ্য দর্শণার্থীদের জন্য খোলা আছে ওপরের আটটি তলা।

চৌদ্দশ থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এ শহর লোকে লোকারন্য থাকত যুদ্ধ বিগ্রহ থেকে এড়িয়ে থাকার জন্য। এখন অবশ্য কেউ থাকে না৷ এখন উন্মুক্ত দর্শনার্থীদের জন্য। তবে পুরো শহর নয়, শুধু একটা অংশ।

টিকেট কেটে প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকে সোজা গেলে মিলবে সেই কুয়া যা জলের অভাব মেটাতো আর ভেন্টিলেটর হিসেবে কাজও করত একসময় নিচে বসবাসকারীদের জন্য। খাড়া টানেলের মতো এরকম ভেন্টিলেটর নাকি আরো গোটা পঞ্চাশেক আছে। আর বায়ু চলাচলের জন্য ভেতরে আছে হাজারখানেক জানালা। দরজার সংখ্যা ছয়শ, কিছু আছে গুপ্ত দরজা যা দিয়ে ভূগর্ভস্থ অন্য শহরে পালিয়ে যাওয়া যায় শত্রু আক্রমণ করলে। ঘটনাতো পুরোই থ্রিলার ম্যুভির মতো লাগছে।  

কুয়া পেরিয়ে সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে প্রথম লেভেলে। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দুর্বল চিত্তের মানুষ তো ভয়েই অক্কা পাবে, এক হাত দূরের মানুষ দেখা যাচ্ছে না। মাথার ওপর যদিও বাতি জ্বলছে তার আলো ক্ষীণ মনে হলো। আমার বদ-অভ্যাস আমি কোথাও গেলে এতটাই সম্পৃক্ত হয়ে যাই যে আশপাশে কে আছে কী নেই খেয়াল থাকে না। একে তো অন্ধকার তার ওপর স্থানের হুশ নেই, দিলাম মাড়িয়ে একজনের পা। এ যে দেখছি আমার সহযাত্রী ভারতীয় ভদ্রলোক। সরি বলে পার পেলাম।

এ শহর যেন এক গোলকধাঁধা। একটা পেরোলে আরেকটার রহস্য উন্মোচন করতে হয়। সবই আছে এ শহরে যেমন রান্নাঘর, শোবার ঘর, বাথরুম, শস্য সংরক্ষণের ঘর, তেল ও ওয়াইন প্রোসেস করার ঘর, কুয়া, গবাদিপশু রাখার ঘর, অস্ত্রাগার, বিদ্যালয়, উপাসনালয়, সমাধিস্থান ইত্যাদি যেন মাসের পর মাস বাইরে যাবার প্রয়োজন না পড়ে।

প্রথম তলায় আছে হল বা বৈঠকখানা। নিচে যাবার সিঁড়ির মুখে পাথরের তৈরি গোলাকার ভারি দরজা যা ভেতর থেকে টেনে বন্ধ করা যায় এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকা যায়, দরজা বাইরে থেকে খোলার কোন ব্যবস্থা নেই।

বলা হয়ে থাকে দরজার ফুটো দিয়ে দেখে দরজা খোলার নিয়ম এ শহর থেকেই শুরু হয়েছে। গোলাকার পাথরের ভারি দরজার মাঝখানে ছিদ্র করা। হলের মাঝখানে ম্যানহোল আকারের গোলাকার ফাঁদ পাতা আছে। এখন গ্রিল দিয়ে আবৃত। শত্রু এতে পা দিলে সোজা নিচে লোহার কাঁটাশয্যায় সমাহিত হবে। আরো এক ধাপ নিচে যাবার জন্য সরু সিঁড়ি দিয়ে নামলাম।

প্রতি তলায় সিঁড়ির মুখে নগরবাসীর সুরক্ষার জন্য  দরজা আছে। এ শহরে কোন আসবাব দেখলাম না, সরিয়ে ফেলা হয়েছে, আছে শুধু পাথরের দেয়াল, দরজা, সিঁড়ি।  

দ্বিতীয় তলার বেশিরভাগ স্থান জুড়ে গবাদিপশু রাখা হতো।  আর বাকি জায়গায় তেল ও ওয়াইন প্রোসেস করা হতো। তৃতীয় তলায় রান্নাঘর। চতুর্থ তলায় বিদ্যালয়, উপাসনালয় ইত্যাদি। পঞ্চম তলায় শোবার ঘর।

ষষ্ঠ তলায় ভাড়ার ঘর। শস্য ও সবজি আগে থেকে সংগ্রহ করে শুকিয়ে রাখা হত কয়েক মাস ব্যবহারের জন্য। সাধারণত দুর্গম ও দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় সবজি শুকিয়ে রেখে তা খাবার প্রচলন আছে বহু দেশে এখনো। যতই নিচে নামছি ততই তাপমাত্র কমে আসছে। গুল শাহ বলেছিল এই গ্রীষ্মকালেও অষ্টম তলার তাপমাত্রা ৪/৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকবে যখন বাইরের তাপমাত্র ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাহলে শীতকালে তো জমে যাবার মতো ঠাণ্ডা থাকবে, কারণ বাইরে তখন বরফ পরে। অবশ্য তাদের নিজেদের হিটিং সিস্টেম ছিল শীতকালের জন্য।  

সপ্তম তলায় আরো কিছু বসার ঘর ও শোবার ঘর। অষ্টম তলাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমাধিস্থান। অষ্টম তলায় নামার পর গুল বর্ণনা দিচ্ছিল কিভাবে সমাধিস্থ করা হত মৃত নগরবাসীদের। তবে এখন কোনো মৃতদেহ নেই। ডানদিকের প্যাসেজে ঢুকে গেলেই দেখা মিলবে। আমি ছাড়া অন্য কারো সমাধিস্থলে ঢোকার আগ্রহ নেই। হাঁটা দিলাম ডান দিকে। অন্যান্য কক্ষে আলো থাকলেও এখানে কোনো আলো নেই। মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে হাঁটতে লাগলাম। সমাধি আকারের খোদাই করা কয়েকটি খালি সমাধি দেখলাম। আর কিছুই নেই। ঘুরেফিরে আসার পর গুল জিজ্ঞেস করল 'কী দেখলে ভেতরে?'

আমি বললাম, ‘হাজার বছরের পুরনো দুটো ভুতের সঙ্গে আড্ডা মেরে আসলাম।’

হাসতে হাসতে গুল বলল, ‘এই গ্রুপে আমি তোমাকে সবচেয়ে দুর্বল আর ভীতু ভেবেছিলাম, কিন্তু তুমি সবার আগে সিঁড়ি দিয়ে নামো, সবার আগে দেয়াল টপকাও, সবার অলক্ষ্যে দল থেকে হাওয়া হয়ে যাও আবার সময় মতো দলে এসে জুড়েও যাও।’ 

আমরা যে পথে এসেছিলাম সে পথ ধরেই ফিরে চললাম। মাঝে পঞ্চম তলায় ঘুরেফিরে দেখার জন্য এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে যাচ্ছিলাম। কিছু কিছু কক্ষ এতই নির্জন যে মনে হচ্ছিল এখানে কয়েক দশক মানুষের পা পড়েনি।

অনেক ভেতরে চলে গিয়েছিলাম, ফেরার সময় ভুলভুলাইয়ার মতো পথে ঘুরতে ঘুরতে পথ খুঁজছিলাম। হঠাৎ বায়ে মোড় নিতেই একটা মেয়ের মুখোমুখি হলাম। আমাকে দেখে সে ভুত দেখার মতো এমন চিৎকার দিল যে আমি হো হো করে হেসে দিলাম। মেয়েটির বন্ধু ততক্ষণে এসে গেছে, আর ভয় কাটিয়ে মেয়েটিও হাসতে লাগল।

অতি এক্সপ্লোরের নেশায় এখন আমি আমার দল থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছি। দল খোঁজার ইচ্ছেও নেই। সময়মত বাইরে পার্ক করা গাড়িতে গিয়ে উঠলেই হবে। আপন মনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাকি কক্ষগুলো দেখে বেরিয়ে পড়লাম গুল শাহ এর পরবর্তী ঝাড়ি খাবার জন্য। বাইরে ঝলমলে রোদ, কে বলবে মাটির অনেক নিচের পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি।  

লেখক: ব্যাঙ্গালোর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি শিক্ষার্থী।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!