প্রবাসে ছাপার অক্ষরে বাংলা

দেশে থাকতে একটা মাত্র স্মরণিকার কাজের সাথে একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জড়িত ছিলাম। সেটা ছিলো আমাদের বুনিয়াদী প্রশিক্ষণের অংশ। ত্রিশতম বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে নন-ক্যাডার হিসেবে আমরা সাতজন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে যোগদান করলাম সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে।

মো. ইয়াকুব আলী, সিডনি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 August 2019, 02:53 AM
Updated : 3 August 2019, 02:54 AM

প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তাদের চাকরিতে যোগদানের কিছুদিনের মাথায় বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ নিতে হ,  যেখানে সরকারি নিয়মকানুন থেকে শুরু করে আচরণবিধিগুলো হাতেকলমে শেখানো হয়। আবার সরকারি চাকরি স্থায়ী করণের তিনটা শর্তের একটি হলো বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ শেষ করতে হবে। আমি, রকিব, মামুন, আমিনুল, কবির, দেবাশিষ আর জুনায়েত এই সাতজনই প্রথম মানুষ যারা বিসিএস থেকে এলজিইডিতে যোগদান করেছিলাম। তাই আমাদের মনের মধ্যে এক ধরণের অহংবোধও কাজ করতো কিছুটা। 

চাকরিতে যোগদানের পর আমাদের বিভিন্ন জনের বিভিন্ন জেলায় পোস্টিং দেয়া হলো। তাই আমাদের নিজেদের মধ্যে সেইভাবে সখ্যতা আর গড়ে উঠেনি। বুনিয়াদী প্রশিক্ষণের সময় একসাথে দুইটা মাস কাটানোর ফলে আমাদের মধ্যে এমন একটা সম্পর্ক তৈরি হলো যেটা বন্ধুত্বের চেয়েও বেশি কিছু। বয়সে আমি সবার বড় তাই অবধারিতভাবেই ওদেরকে পরিচালনা করার ভার পড়লো আমার উপর। বুনিয়াদী প্রশিক্ষণে আমাদের সাতজনকে ডাকা হতো ‘সপ্ত পাণ্ডব’ হিসেবে। আমাদের প্রশিক্ষণের জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিলো কুমিল্লার বার্ড। আমরা সেখানে রীতিমতো নিজেদের রাজত্ব কায়েম করে বসলাম। রাত বিরেতে আনারস আর কাঁঠাল চুরি, কারো জন্মদিন পালন থেকে শুরু করে মাঝরাত্রে ক্ষুধা পেলে অন্যদের কক্ষে হামলা করা থেকে শুরু করে সবই করেছিলাম আমরা।

পাশাপাশি আমরা সাতজন সব ধরণের কমিটিতে ঢুকে পড়লাম। কারণ অন্যরা কেউই এগিয়ে আসছিলো না। স্মরণিকা কমিটি, সাংস্কৃতিক কমিটি, দেয়াল পত্রিকা কমিটি সবগুলোতেই আমরা কাজ শুরু করে দিলাম। অবশ্য যেখানে টাকা পয়সা লেনদেনের ব্যাপার আছে আমরা সেগুলো সাবধানে এড়িয়ে গেলাম। আর এই কমিটিগুলোরও আমরা শুধু সদস্য হিসেবেই থাকলাম। অন্য কেউ একজন সভাপতি ছিলো, কিন্তু পুরো কাজটা করতাম আমরা। আমাদের নীতি ছিলো আমরা কাজ করার দরকার করবো আমাদের নাম লোকে জানুক বা না জানুক। রকিব আর আমার দুজনেরই আদর্শের ব্যক্তিত্ব হলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন  আহমদ। উনার একটা কথা আমাদের মগজে ঢুকে গিয়েছিলো। তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, “আমি দেশের জন্য এমনভাবে কাজ করবো। যেন দেশের ইতিহাস লেখার সময় সবাই এদেশটাকেই খুঁজে পায়; কিন্তু আমাকে হারিয়ে ফেলে।”

স্মরণিকার কাজগুলো আমরা কয়েকটা ধাপে ভাগ করে দায়িত্ব নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নিয়েছিলাম। আর প্রতি সপ্তাহান্তে আমরা একবার করে বসে নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে নিতাম। মোট চল্লিশজন মানুষ ছিলেন আমাদের ব্যাচে। পুরোনো স্মরণিকাগুলো ঘেঁটে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম প্রত্যেকের আত্মজীবনীটা লেখা হবে গল্পের আদলে, যাতে যদি কেউ পড়তে বসেন তাহলে যেনো বিরক্তবোধ না করেন। প্রায় সবারটাই নির্দিষ্ট সময়ে হাতে পেয়ে গেলেও অনেকেই সেটা দিতে পারলেন না নিজেদের লেখালেখির অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে। তখন আমরা তার কক্ষে যেয়ে তার কাছ থেকে শুনে নিয়ে নিজেরা লিখে দাঁড় করিয়ে ফেললাম।

এরপর প্রেসে দিয়ে দিলাম টাইপ করার জন্য। এরপর আলাদাভাবে যারা লেখা জমা দিবে তাদেরকে ধর্ণা দিয়েও আর লেখা আদায় করা সম্ভব হচ্ছিলো না। সব লেখা টাইপ করা হয়ে গেলে আমরা প্রেসের লোককে বার্ডে ডেকে পাঠিয়ে উনাকে মাঝে বসিয়ে আমরা সাতজন উনাকে কেন্দ্র করে বসে যেতাম বানান এবং ব্যাকরণ শুদ্ধিকরণে। আর আমাদের এসব কাজের তদারকি করতেন বার্ডের আমাদের স্মরণিকা কমিটির উপদেষ্টা শেখ মাসুদুর রহমান স্যার। প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে ছবি সিলেকশন এবং ছবির ক্যাপশন দেয়াতে স্যারের ছিলো সামগ্রিক তদারকি। উনার কারণেই আমরা একটা মানসম্মত স্মরণিকা প্রকাশ করতে পেরেছিলাম।

সপ্ত পাণ্ডব

এতো সময় নিয়ে সংশোধন করার পরেও যখন স্মরণিকাটা প্রিন্ট আকারে প্রকাশ পেলো তখন কিছু ভুল আমাদের চোখে পড়লো। তখনই প্রথম উপলব্ধি করলাম আসলেই ভুল সংশোধনের কোন সীমা নেই এবং কখনওই শতভাগ নির্ভুল বই প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যেমন একটা ভুলের কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। এক বড়ভাই ১৯৯৭ সালে অনার্সে ভর্তি হয়েছিলেন। কোন কারণে সেটা প্রিন্ট হয়ে যখন আমাদের হাতে আসলো তখন দেখি সেখানে পরিষ্কার করে লেখা উনি ২০৯৭ সালে ভর্তি হয়েছিলেন। ভুলটা দেখে উনি মজা করে বললেন আচ্ছা আমার তো এখনও জন্মই হয়নি।

প্রবাসে এসে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কল্যাণে লেখালেখিটা এখন মোটামুটি নেশায় পরিণত হয়েছে। একটা লেখা বিডিনিউজে পাঠানোর পর সেটা প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত নিজের মধ্যে এক ধরণের ছেলেমানুষি অস্থিরতা কাজ করতে শুরু করে, এমনকি মাঝেমধ্যে প্রকাশ পেতে বেশি দেরি হয়ে গেলে মেজাজ খিটমিটে হয়ে যায়। অকারণে পরিবারের লোকেদের সাথে খারাপ ব্যবহার করি। আর যেদিন লেখাটা প্রকাশ পায় সেদিন আমি পুরোপুরি হাওয়ায় ভাসতে থাকি। এই লেখালেখি দেখে বুয়েটের এক সিনিয়র রুনু আপু আমাকে ‘বুয়েট অ্যালামনাই অস্ট্রেলিয়া’  প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের দায়িত্বে চাপিয়ে দিলেন। একেতো নতুন এসেছি, উপরন্তু আমরা একটু গ্রামের দিকে থাকি, তাই বুয়েট অ্যালামনাইয়ের কোন অনুষ্ঠানেই আমার যাওয়া হয় না।

অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলে বান্ধবী রিফাত ফোন দিয়ে আমাকে বর্ণনা দিয়ে যায় আর আমি সেই মোতাবেক রিপোর্ট লিখে বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠাই। এভাবে জোড়াতালি দিয়ে দুটো বছর পার করে দিলাম। দুই বছরের মাথায় কমিটি সিদ্ধান্ত নিলো একটি স্মরণিকা প্রকাশ করবে আর নিয়মমাফিক তার দায়িত্ব আমার ঘাড়েই বর্তায়। আমিও মোটামুটি রাজি হয়ে গেলাম। অনলাইনে বুয়েটের বিভিন্ন ফোরাম ঘুরে প্রচ্ছদের জন্য একটা পেইন্টিং সিলেক্ট করে দিলাম। এর ঠিক পরেই আমার গিন্নীর চাকরি হলো আমাদের বাসা থেকে প্রায় দু ঘণ্টার ড্রাইভ দূরে। সে তখনও গাড়ি চালানো শুরু করেনি, আর আমাদের আলাদা গাড়িও নেয় যে সে চালিয়ে যাবে।

সে প্রতি সপ্তাহের রোববার রাত্রে কাজে চলে যায় আর ফিরে আসে শুক্রবার গভীর রাতে। পুরো সপ্তাহটা আমাকে চাকরি করার পাশাপাশি বাচ্চাদর সামলাতে হ,  তাই ইচ্ছে না থাকলেও আমি স্মরণিকা প্রকাশের দায়িত্ব থেকে সরে আসলাম। এরপর রিপা আপু একাই সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত অনেক সুন্দর একটি স্মরণিকা উনারা প্রকাশ করছিলেন। সেখানে বুয়েট অ্যালামনাই অস্ট্রেলিয়া নিয়ে আমার একটি লেখাও ছাপা হয়েছিলো, কিন্তু আমার লেখাতে যে বানানগুলো ভুল ছিলো স্মরণিকার লেখার মধ্যেও সেই ভুলগুলো রয়ে গিয়েছিলো। তখনও বুঝিনি কেন ভুলগুলো সংশোধন করা সম্ভব হয়নি।

এছাড়া লেখালেখির সুবাদে এখানে বেশকিছু সংগঠনের সাথে পরিচয় হয়েছে। তন্মধ্যে আগমণী অস্ট্রেলিয়া, চট্টগ্রাম ক্লাব অস্ট্রেলিয়া অন্যতম। উনাদেরও স্মরণিকায় আমার লেখা ছাপা হয়েছিলো, কিন্তু সেখানেও দেখি আমার লেখার বানান ভুলগুলো রয়ে গেছে। আমার যেহেতু কোন লেখায় রিভিশন দেয়ার অভ্যাস নেই তাই ভুলগুলো আমার চোখে পড়ে ন।  কিন্তু প্রিন্ট আকারে প্রকাশ করার পর যখন পড়তে যায় তখন দেখি অনেক ভুল বের হচ্ছে। কিন্তু তখনও আমার মাথাতেই আসেনি কেন সম্পাদক বানানগুলো ঠিক করে দেননি। পরবর্তিতে ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুল তাদের স্মরণিকা প্রকাশ করার দায়িত্ব দিলে বুঝতে পারলাম কেন ছাপার অক্ষরের বাংলা ভাষাতে ভুলগুলো সংশোধন করা সম্ভব হয় না।

শুরুতেই সবার কাছ থেকে লেখা সংগ্রহ করে নিলাম। অনেকেই বাংলা টাইপ করা লেখা দিলেন, আবার অনেকেই হাতে লিখে স্ক্যান করে মেইল করে দিলেন। যেগুলো হাতে লেখা সেগুলো আমি অফিসের কাজের ফাঁকে গুগুল ইনপুট টুলস দিয়ে টাইপ করে নিলাম, কারণ আমি ধারণা পেতে চাইছিলাম স্মরণিকাটার কলেবর কেমন হতে পারে। অবশেষে সব লেখা টাইপ করা হয়ে গেলে মোট চব্বিশ পাতার একটা স্মরণিকার লেআউট দাঁড় করিয়ে ফেললাম। এরপর বাচ্চাদের আরো কিছু কার্যকলাপের ছবি দিতে যেয়ে মোট আটাশ পাতার একটা লেআউট দাঁড় করিয়ে প্রেসে পাঠিয়ে দিলাম। আমার ধারণা ছিলো প্রেসের লোকজন বাকি কাজটা নিজেরা করে নিবে যেভাবে বাংলাদেশের স্মরণিকার সময় করেছিলাম।

আমি যে কতটা ভুল ছিলাম সেটা টের পেলাম দুই সপ্তাহের মাথায়। সব লেখা এবং ছবি দিয়ে যেহেতু লেআউট দাঁড় করানো হয়ে গেছে তাই সবাই জিজ্ঞেস করছিলো স্মরণিকা প্রকাশের কতদূর। আমি তাদের আশ্বস্ত করছিলাম যে আমাদের শতকরা নব্বই ভাগ কাজ শেষ করে প্রেসে দিয়েছি, উনারা বাকিটা করে নিবেন। আমরা শুধু সময়ে সময়ে বানানগুলো শুধরে দিবো। কিন্তু এক সপ্তাহের মাথায়ও প্রেস থেকে কোন ইমেইল না পেয়ে সরাসরি ফোন দিলাম। আমার ফোন পেয়ে আমাকে একটা পিডিএফ ফাইল পাঠিয়ে দিলেন। দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ। এটাতো আমার লেআউটেরই শুধু পিডিএফ ফরম্যাট।

আমি আবারো প্রেসে ফোন দিলে মালিক বললেন ভাইয়া আমার এখানে বাঙালি যে ছেলেটা কাজ করতো সে ছুটিতে যাচ্ছে। তাই কোন ধরণের সংশোধন সম্ভব হয়নি। আমি বললাম তাহলে উপায়? উনি বললনে তাহলে আমি একটা প্রেসের নম্বর দিচ্ছি আপনি কথা বলে দেখতে পারেন। এরপর উনিও ভুলে গেলেন আর আমারও অফিসে কাজের চাপ অনেক বেশি থাকাতে আর ফলোআপ করা সম্ভব হলো না। আমি মোটামুটি হাল ছেড়ে দিলাম। সবাইকে বললাম প্রেসের জন্য খোঁজাখুঁজি করতে কিন্তু তেমন কোন প্রেসের খোঁজ পেলাম না।

পরের সপ্তাহে প্রেসের মালিক ফোন দিয়ে বললেন ইয়াকুব ভাই একভাবে কাজটা করা যায়। সেটা হচ্ছে আপনি যদি সমস্ত বানান সংশোধন করে আমাকে পিডিএফ ফাইল পাঠান তাহলে আমি সেখান থেকে প্রিন্ট নিতে পারি। হালে কিছুটা পানি পেলাম। তখন আমি আশফাক ভাই আর মিথুন ভাই মিলে পরিকল্পনা করলাম আমরা একরাত্রে বসে সমস্ত বানান সংশোধন করে ফেলবো। কিন্তু তিনজনের সময় আর মিলছিলো না, কারণ ইদানিং আমার গিন্নির প্রায়শই নাইট ডিউটি থাকে হাসপাতালে।

তবুও এক শনিবার রাতে আমরা ঠিক করলাম বসবো। মিথুন ভাই চাইছিলেন একেবারে সন্ধ্যা থেকে বসতে, কারণ উনি জানতেন অনেক বেশি সংশোধনী আছে। আমি ভাবলাম কি আর এমন সংশোধনী রাত দশটার পরে বসলেই হবে। ততক্ষণে বাচ্চাদের খাওয়া-দাওয়াও শেষ হয়ে যাবে, তাহলে একটানা কাজ করা যাবে। অবশেষে আমরা রাত দশটার পর আমাদের বাসায় বসলাম বানান সংশোধন করতে। বানান সংশোধন করতে যেয়ে বুঝতে পারলাম কেন মিথুন ভাই সন্ধ্যা থেকে বসার জন্য পীড়াপীড়ি করছিলেন। একটানা কাজ করে আমাদের কাজ শেষ হলো রাত সাড়ে তিনটায়। মাঝখানে আমি শুধু একবার উঠে গিয়ে চায়ের পানি বসিয়ে এসেছিলাম।

এরপর শুরু হলো প্রেসের সাথে আমার টেবিল টেনিস খেলা। আমি সংশোধন করে পাঠাই,  উনারা সেটা প্রিন্ট করার নির্দিষ্ট ফর্মে ফেলে আমাকে পিডিএফ করে ফেরত দেন। আমি সেটা আবার আশফাক ভাই আর মিথুন ভাইকে পাঠাই। উনারা কোন সংশোধনী দিলে আমি আবার সেটা আমার ওয়ার্ড ফাইলে হালনাগাদ করে সেটাকে পিডিএফ করে প্রেসে পাঠাই। আর ভুল সংশোধনের যেহেতু কোন সীমা নেই তাই একটার পর একটা পরিবর্ধন পরিমার্জন চলতে থাকলো। আমি যেহেতু একটু লাজুক প্রকৃতির তাই প্রেসের লোকজনকেও বেশি চাপ দিতে পারি না আবার মিথুন ভাইয়ের সংশোধনীগুলো হালনাগাদ করার দরকার সেটাও ভাবি।

যাই হোক, মোটামুটি প্রায় বিশবারেরও অধিক সময় টেবিল টেনিসের বলের মতো স্মরণিকতা আমাদের মধ্যে আদান প্রদান হলো। এরপর মোটামুটি একটা মানসম্পন্ন স্মরণিকা প্রেস থেকে আমাকে পাঠানো হলো। তখন শুরু হলো আমার নিজের চোখে ধরা পড়া ভুলগুলোর সংশোধন। যেমন কোথাও শিরোনামের ফন্ট ছোট আবার কোথাও বড়, কোথাও ফন্ট বোল্ড আবার কোথাও সাধারণ। এইভাবে আরো প্রায় পাঁচবার শুধু প্রেসের সাথে আমার স্মরণিকাটা আদান প্রদান হলো। সবকিছু যখন গুছিয়ে এনেছি পরেরদিন প্রিন্ট নিবো তার আগের দিন প্রেসে যেয়ে দুই কপি রাফ প্রিন্ট নিয়ে আসলাম কেমন হয়েছে সেটা দেখার জন্য।

তখনই নতুন একটা ভুল চোখে পড়লো। এতদিন প্রেসে একটা শ্রীলংকান ছেলে ফাইলটা নিয়ে কাজ করেছিলো, কিন্তু সেদিন এক বাংলাদেশি ভদ্রলোক কাজ করতে যেয়ে একটা পাতায় ছবি উলটপালট করে ফেললেন। পরের দিন আবার সেটার সংশোধন নিয়ে ভাইয়াদেরকে পাঠানো হলে উনারা বললেন সবই ঠিক আছে শুধু একটা শব্দের বানানে একটা অক্ষর বেশি আছে। আমি আবারো আমার ওয়ার্ড ফাইলে সেটা সংশোধন করে প্রেসে পাঠিয়ে তাদেরকে ফোন দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে সেটাকে হালনাগাদ করতে বললাম। তারপর আমরা প্রিন্ট করার নির্দেশ দিলাম। এই পুরো কাজটা আমাদেরকে করতে হয়েছে আমাদের অফিসের কাজ, বাসার কাজ সামলে তারপর সময় বের করে।

যে কেউই যখন আমাদের এই গল্পটা শুনবে তখন হয়তোবা মনেমনে হাসবে। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য ছিলো আমাদের যেহেতু এটা বাংলা স্কুল তাই যতদূর সম্ভব আমরা বাংলাটাকে বানানগত এবং ব্যাকরণগত দিক থেকে নির্ভুল করার চেষ্টা করবো। 

প্রবাসে সেই দেশের ভাষা শিখেই আমাদের প্রজন্ম বেড়ে উঠবে, কারণ তারা রাস্তাঘাটে, দোকানে পাটে, স্কুল কলেজে সেই ভাষাতেই ভাব বিনিময় করবে। এর বাইরে যেয়ে বাংলা ভাষার শিক্ষা দেয়াটাকে অনেকেই বিলাসিতা হিসেবে দেখে।  কিন্তু আমরা মনে করি মাতৃভাষার শিক্ষাটা দেয়া জরুরি। কারণ তা না হলে তারা একটা সময় যেয়ে শেকড়ের পরিচয়টা হারিয়ে ফেলবে।

ইংরেজি ভাষাভাষির দেশ অস্ট্রেলিয়াতেও আমাদের বাচ্চারা যারা ছোট বয়সে এই দেশে এসেছে বা এখানে জন্ম নিয়েছে তারা ইংরেজিতেই কথা বলে। এমনকি অনেক বাবা মা গর্ব করে বলেন তাদের বাচ্চারা কত দ্রুত অস্ট্রেলিয়ান উচ্চারণে ইংরেজি বলা শিখে গেছে। যেটা নিয়ে আমাদের অভিযোগ নেই, কারণ এখন বাংলাদেশেই অনেক পরিবারে বাংলাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বহু ভাষাভাষী এবং সংস্কৃতির দেশ অস্ট্রেলিয়া সবসময়ই তাদের ভাষাগত এবং সংস্কৃতিগত বৈচিত্র সংরক্ষণের ব্যাপারে সচেষ্ট।

সেই চেষ্টারই অংশ হিসেবে বিভিন্ন ভাষাভাষীর কমিউনিটি স্কুলগুলোর কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে বোর্ড অব এডুকেশনের অধীনে। ঠিক তেমনই একটা স্কুল ‘ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুল’ যেটা গত প্রায় ১৮ বছর ধরে তার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এখানে বাচ্চারা বাংলা ভাষাটাকে পড়ার এবং লেখার পাঠ নিচ্ছে প্রতি রোববার সকাল দশটা থেকে বারোটা। আর বারোটা থেকে একটা পর্যন্ত চলে বাঙালি সংস্কৃতি শিক্ষা কার্যক্রম। আশা করি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এখান থেকে শেখা বাংলা ভাষাটাকে তাদের ব্যবহারিক জীবনেও কাজে লাগাবে, তখন আর এই প্রবাসেও ছাপার অক্ষরে শুদ্ধ বাংলা ভাষাটাকে দেখতে আমাদের বেগ পোহাতে হবে না।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!