প্রবাসে শীতের সাঁজাল

আবমান গ্রামবাংলায় শীতকালের স্থায়িত্ব ও সৌন্দর্য আলাদা স্থান নিয়ে আছে। শীতের সকালে কুয়াশার চাদরে প্রকৃতি নিজেকে ঢেকে রাখে। দেখলে মনে হয় মানুষ যেমন শীতের প্রকোপ থেকে রেহায় পাওয়ার জন্য শীতবস্ত্র পরে আছে ঠিক তেমনি প্রকৃতি যেনো কুয়াশার চাদরে নিজেকে মুড়িয়ে রেখেছে।

মো. ইয়াকুব আলী, অস্ট্রেলিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 July 2019, 08:31 AM
Updated : 24 July 2019, 08:32 AM

ঘাসের ডগায় জমে আছে শিশির বিন্দু। বেলা বাড়ার সাথে সাথে সূর্যের আলোয় সেগুলো মুক্তোর মতো জ্বলজ্বল করতে থাকে। শিশু কিশোরের দল ঘুম থেকে উঠে পরে সেই সাত সকালেই। আসলে গ্রামীণ বাংলার ঐতিহ্যই ছিলো এমন। রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর নানা-নানীর বা দাদা-দাদির কাছে রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে সবাই ঘুমিয়ে যেতো। আবার সকাল বেলা উঠে শুরু হয়ে যেতো তাদের লাফঝাঁপ।

শুধু মায়েরা জেগে থাকতেন নানা প্রকারের পিঠা পুলি তৈরি করার জন্য। রাতের বেলা পিঠা পুলি তৈরি করার জন্য দুটো বিষয়কও আমার কাছে কারণ বলে মনে হয়েছে। এক বাচ্চারা সব ঘুমিয়ে যায় তাই নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করা যায়। আর দুই রাত্রে শীতের প্রকোপ বেশি থাকায় সদ্য তৈরি করা পিঠা পুলি নষ্ট হওয়ার সুযোগ কম থাকে। আর শীতকালের গ্রামবাংলার সবচেয়ে বড় ঐতিহ্য কুমড়ো বড়ির দেয়ার প্রস্তুতিও নেয়া হতো রাতের বেলায়, যেটা শেষ হতো একেবারে ভোর বেলায়।

গ্রামবাংলার অনেক এলাকায় এখনও শীতকে ‘জার’ বলে। ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর বাচ্চাদের যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী শীতের পোশাক পরিয়ে দেন বাবা মায়েরা। গ্রাম বাংলায় সোয়েটরকে এখনও ‘জাম্পার’ বলে। যাদের জাম্পার কেনার সামর্থ্য নেই তাদেরকে বাবা মায়ের শাড়ি বা লুঙ্গি দিয়ে শীতের হাত থেকে নিস্তার পেতে হয়। লুঙ্গি বা শাড়িকে ভাঁজ করে সেটাকে গলার চারপাশে পেঁচিয়ে একটা গিট্টু দিয়ে দেয়া হয়। যাতে করে পুরো শরীরটা ঢেকে যায়। ইচ্ছে করলেই হাত বের করে খেলাধুলা করা যায়।

তবে সবচেয়ে পরিচিত ঐতিহ্য হচ্ছে বাড়ির বাইরের খোলা কায়গায় খড়কুটো জোগাড় করে সেটাতে আগুন ধরিয়ে দেয়া। যেটাকে গ্রামের ভাষায় ‘সাঁজাল’ বলে। তারপর তার চারপাশে পাড়ার সব মানুষ মিলে জড়ো হয়ে একটু ওম নেয়ার চেষ্টা। বড়রা এসে হাতে পায়ে একটু ওম নিয়ে লাঙল কাঁধে নিয়ে মাঠের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ছেন। আর ছোটরা তখনও সাঁজাল তাপাতে ব্যস্ত।

দিনশেষে আবারো বাচ্চাদের শীতের পোশাক পরিয়ে দেয়া হয়। আর বাড়ির পোষা গরু ছাগলের জন্য ব্যবস্থা করা হয় চটের ছালার। পাটের চটের পুরোনো বস্তাগুলোর সামনের দিক খোলাই থাকে, শুধু একটা পাশ আর পিছনের দিকে খুলে দিলে সেটা একটা চারকোণা আকৃতি পায়। তারপর সেটার চার কোণায় চারটা পাটের দড়ি পরিয়ে দেয়া হয়। তারপর সেটা গরুর পিঠে দিয়ে দড়িগুলোকে পেটের নিচ দিয়ে অন্য পাশের দড়িটার সাথে বেঁধে দেয়া হয়, যাতে করে গরু নড়াচড়া করলেও সেটা আর পিঠ থেকে পরে যায় না।

এছাড়াও গরু ঘরে সন্ধ্যার সময় ধূপের ধোঁয়া গুগুল ঘেটে দেখলাম ধূপের ধোঁয়া দিয়ে মশা তাড়ানোর এ প্রক্রিয়াটার নামই না কি সাঁজাল। সে যাই হোক আমরা ঘুমিয়ে পড়লে মায়েদের আসল ব্যস্ততা শুরু হতো। দিনের বেলায় ঢেঁকিতে পার দিয়ে চাল কুটে রাখতেন। চাল কুটতে নেয়ার আগে সেগুলোকে একটা বড় পাত্রে ভিজিয়ে রাখতেন। তাপর ঢেঁকির পারে সেগুলোকে পিষতেন। একজন পার দিতেন অন্যজন ঢেকির মাথায় বসে নেড়ে দিয়ে সব গুড়াগুলোকে সমানভাবে মিহি করার দায়িত্ব পালন করতেন। একজন পার দিতে যেয়ে হাঁপিয়ে গেলে অন্যজন এসে পার দিতেন। আমরা দুভাই একটু বড় হয়ে যাওয়ার পর আমরা মা চাচিদেরকে সাহায্য করতাম ঢেঁকিতে পার দেয়ার ব্যাপারে।

সব মা চাচিরা একসাথে গোল হয়ে রান্নাঘরে বসে পড়তেন পিঠা বানাতে। প্রত্যেকটা পিঠা বানাতেই একসাথে অনেকগুলো ধাপ অনুসরণ করতে হতো। সবাই মিলে একসাথে বসলে সবগুলো কাজই পাশাপাশি একসাথে করা যায়। তাই দ্রুতই বিভিন্ন রকমের পিঠা তৈরি হতে থাকতো। সকালবেলায় উঠে আমরা সেগুলোর স্বাদ নিতাম। ভাপা পিঠার কথা সবারই জানা, তবে আমাদের মায়েদের কখনও ভাপা পিঠার মধ্যে নারিকেল দিতে দেখিনি। আরো ছিলো সরা পিঠা যেটার বইয়ের নাম ভাষায় চিতই পিঠা।

অবশ্য আমাদের এলাকায় দুই ধরণের সরা পিঠা তৈরি হতো। একটা তাওয়ার মধ্যে বেলন আকৃতির চারটা গর্ত থাকতো আর কেন্দ্রে থাকতো একটা গোলাকৃতি গর্ত। এটাকে আমরা বলতাম পাঁচ তাওয়ার সোর পিঠা আর একটা বড় মাটির পাতিলের তলায় বানানোটা হতো এক তাওয়ার সরা পিঠা। সরা পিঠাগুলোকেই আবার আগে থেকে জ্বাল দিয়ে রাখা গুড়ের রস নারিকেলের গুড়াসহ রসের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে বানানো হতো ভিজানো পিঠা। সবচেয়ে সহজ পিঠা ছিলো মুঠো। চালের আটা পানিতে ভিজিয়ে কাদার মতো বানিয়ে সেগুলো হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে চাপ দিয়ে বানানো হতো, তারপর সেটা শুধু ফুটন্ত পানিতে সেদ্ধ করে নেয়া হতো।

কুলসি পিঠা সাধারণত বানানো হতো বাসায় কোন অতিথি এলে, সেই ওছিলায় আমাদেরও খাওয়া হয়ে যেতো। চালের আটা সেদ্ধ করে গোলাকৃতির চাকতি বানানো হতো বেশ পুরু করে। তারপর সেটাতে দেয়া হতো আগে থেকে বানানো নারিকেলের গুড়া আর গুড় জ্বাল দিয়ে তৈরি করা মিশ্রণ। তারপর চাকতির মুখ বন্ধ করে দিলে তৈরি হয়ে যেতো অর্ধ চন্দ্রাকৃতির কুলসি পিঠা। এছাড়াও তাদেরকে আপ্যায়ন করার জন্য বানানো হতো কুলি পিঠা। কুলসি পিঠার মতোই একই প্রক্রিয়ায় বানানো হতো শুধু কোটিংটা দেয়া হতো পাতলা করে। কারণ এগুলোকে ডুবো তেলে ভাজা হবে।

পাকন পিঠাও বানানো হতো সাধারণত বাসায় অতিথি এলে। গুড় আর চালের আটা পানি দিয়ে মিশিয়ে একটা লেই তৈরি করা হতো। তারপর সেই লেই চুলাতে ফুটন্ত তেলের মধ্যে ছেড়ে দেয়া হতো। ফুটন্ত তেলে ভেজে উঠিয়ে নিয়ে পাশে রাখা চালুনির মধ্যে কিছুক্ষণ রেখে দেয়া হতো পিঠা থেকে বাড়তি তেলটা ঝড়ে যাওয়ার জন্য। বড় বড় গোলাকৃতির পাকন ছাড়াও একই উপকরণ দিয়ে ছোট ছোট আকারের কিছু পিঠা বানানো হতো একই প্রক্রিয়ায় সেগুলোকে বলা হতো বড়া।

তালের পিঠা বানানো হতো যদি সেই বছর হাট থেকে তাল নিয়ে আসা হতো। তালের পিঠা বানানোর জন্য অনেক আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হতো। পাকা তালের খোসা ছাড়িয়ে আঁটিগুলোকে আলাদা করে সেগুলোকে টিনের বা বাশের চটার তৈরি চালুনিতে গায়ের জোরে ঘষা হতো। এতে করে তালের রস চুইয়ে চুইয়ে নিচে রাখা পাত্রে জমা হতো। মোটামুটি রস নিংড়ে নেয়া হয়ে গেলে আঁটিগুলো আমাদেরকে দিয়ে দেয়া হতো। আমরা সারাদিন ধরে সেগুলো চেটে খেয়ে বেড়াতাম। তারপর দিন শেষে একটা জায়গায় গাদা করে রাখতাম।

বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন সেগুলো কাটলে তার মধ্যে থেকে সুন্দর তুলতুলে ফোপড়া বের হতো যেগুলো ওই সময় পর্যন্ত আমার খাওয়া সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার ছিলো। অবশ্য নারিকেল বেশি পুরনো হয়ে গেলেও তার মধ্যে ফোপড়া হতো। তালের রস এরপর জাল দিয়ে দিয়ে গাঢ় করা হতো। তারপর একদিন রাত্রে তালের গোলা আর চালের আটা একসাথে পানি দিয়ে মিশিয়ে পাকন পিঠার মতো লেই তৈরি করে তালের বড়া বানানো হতো। তালের অন্য আরেকটা পিঠা বানানো হতো যেটাকে আমরা বলতাম চাপড়া। তালের রসের সাথে চালের আটা পরিমাণ মতে মিশিয়ে থকথকে কাদার মতো একটা মিশ্রণ তৈরি করা হতো। তারপর বাড়ির আশপাশের ক্ষেত থেকে তুলে আনা হলুদের পাতার উপর সেই মিশ্রণটা সমানভাবে দিয়ে অন্য আরেকটা হলুদের পাতা দিয়ে ঢেকে দেয়া হতে। তারপর সেটাকে চুলায় রাখা গরম তাওয়ায় সেকা হতো। হলুদের পাতা পুড়ে গেলেই ধরে নেয়া হতো পিঠা সেদ্ধ হয়ে গেছে।

তবে শীতকালের যে উপকরণটা আমার মনে দাগ কেটে আছে সেটা হচ্ছে কুমড়ো বুড়ি। আমাদের এলাকায় একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে, ‘চোদনের নাম কুমড়ো বড়ি’। এর মানে হচ্ছে পরিশ্রমের নাম কুমড়ো বড়ি। আপনি যদি বুঝতে চান পরিশ্রম কাকে বলে তাহলে আপনাকে কুমড়ো বড়ি দিতে হবে। কুমড়ো বড়ি দেয়ার প্রক্রিয়াটা শুরু হতো অনেকগুলো কাজ একসাথে শুরু করার মধ্যে দিয়ে। দিনের শুরুতে পাকা আস্তো চালকুমড়াগুলো ঝিনুক দিয়ে কুড়ে নেয়া হতো। তারপর সেটা থেকে বীজগুলো আলাদা করে সেটাকে কাপড়ে বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হতো, অনেকটা মিষ্টি তৈরি করার আগে যেভাবে দুধের ছানা ঝুলিয়ে দেয়া হয়।

পাশাপাশি একটা বড় মাটির পাত্রে যেগুলোকে আমরা চাড়ি বলতাম, পরিমাণ মতো কালো কলাই পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখা হতো। খুব ভোরে মায়েরা ঘুম থেকে উঠে পড়ে আবার কাজে লেগে পড়তেন। একজন মাটির চাড়িতে ভিজিয়ে রাখা কলাইগুলোকে চাড়ির গায়ে ঘষে ঘষে খোসা ছাড়াতেন। অন্যজন সেগুলোকে ধুয়ে নিয়ে শিল পাটায় বেটে পেস্ট তৈরি করতেন। একইভাবে অন্য একটা শিল পাটায় চাল কুমড়োর শাসগুলোকে বেটে পেস্ট বানানো হতো।

এই পুরো প্রক্রিয়াটার তদারকি করতেন আমার দাদি। উনি পেস্টগুলো হাতের আঙুলের চাপ দিয়ে বলে দিতেন আর কতটা মিহি করতে হবে। এভাবে চলতে থাকতো পেস্ট তৈরি করার কাজ। দাদি ততক্ষণে আগে থেকে বাজার থেকে কিনে আনা সরু বাঁশের চটার তৈরি অনেকটা চাটাইয়ের মতো জিনিসটা ধুয়ে তৈরি করে ফেলতেন, কারণ তার উপরই দেয়া হবে বড়ি। চাল কুমড়োর পেস্ট আর ডালের পেস্ট পরিমাণ মতো খুব ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে সেটাকে আঙুলের মাধ্যমে বসিয়ে দেয়া হতো চাটাইয়ের উপর। ভালোভাবে বসানোর পর প্রত্যেকটা বড়ি এক একটা বহুবাহু বিশিষ্ট প্রিজমের আকার নিতো।

প্রথম বড়িটা বসানোর পর আমার ডাক পড়তো। আমি অবশ্য মায়েদের কাজের শব্দে ততক্ষণে উঠে পড়তাম। একটা লাল রঙের পাকা মরিচের মাথাটা উপরের দিকে দিয়ে বড়ির শীর্ষে বসিয়ে দিতাম। দাদিকে একসময় জিজ্ঞেস করেছিলাম এটা কেন করা হয় উনি বলেছিলেন যাতে মানুষের চোখ না লাগে।    

জীবনের পথ পরিক্রমায় একসময় অস্ট্রেলিয়ার সিডনি এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলাম। কিন্তু বাংলাদেশের শৈশবের স্মৃতিগুলো সবসময়ই তাড়া করে ফিরে। এখানে বাংলদেশের সব রকমের পিঠাই পাওয়া যায় বাংলা দোকানগুলোতে। এছাড়াও ভাবিরা বাড়িতে বানিয়ে হোম ডেলিভারি দেন। সেগুলোর স্বাদও খারাপ না, তবুও মনটা পরে থাকে সেই চর ভবানীপুর গ্রামের অনাড়ম্বর পিঠার আয়োজনে। ইতোমধ্যে এক চাচি বাংলাদেশ থেকে আসার সময় কুমড়ো বড়ি এনেছিলেন। আমি খুবই পছন্দ করি বলে আমাদের অনেকগুলো দিয়েছিলেন।

স্থানীয় একটা বাংলাদেশি সবজির ফার্ম থেকে লাউ এনে দিয়ে গিন্নিকে বললাম লাউ আলু আর কুমড়ো বড়ি দিয়ে লাবড়া করতে। সেই রান্না অনেক সুস্বাদু হয়েছিলো। কম কম করে আমি প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে সেই তরকারি খেয়েছিলাম। বড়িতে কামড় দেয়ার সময় আমার মায়ের হাতের রান্নার কথা মনে পরে যেতো বারবার। একটা সময় ছিলো যখন ভালো তরকারি বলতে আমাদের বাড়িতে কুমড়ো বাড়ির তরকারিকেই আমরা বুঝতাম।

শীতের পিঠা পুলি খেতে পারলেও বাংলাদেশের শীতকালের আবহ খুঁজে ফিরছিলাম সাত সমুদ্র তেরো নদীর এই পারেও। অবশেষে কাকতালীয়ভাবে পেয়ে গেলাম সেই সুযোগ। শীতকাল আসলেই সারা অস্ট্রেলিয়াজুড়ে চলে ‘উইন্টার নাইট ফেস্টিভ্যাল’ যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘শীতের রাতের মেলা’। আমাদের বাসার কাছাকাছি ক্যাম্বেলটাউনেই কোশিগায়া পার্কে চলছিলো একটা মেলা।

অন্যদিকে মেয়েটার স্কুল হলিডে চলছে। একদিন অফিস থেকে ফিরে তাই সদলবলে চলে গেলাম উইন্টার নাইটে। সেখানে যেয়ে দেখি এই ভয়ংকর ঠাণ্ডার মধ্যেও আবাল বৃদ্ধ বনিতা সবাই এসেছেন মেলায় ঘুরতে। মেলার প্রবেশ পথের সাথে সারি করে লাগিয়ে দেয়া হয়ে রঙ বেরঙের কৃত্রিম ফুলের গাছ। মেলার অবশ্যম্ভাবি উপসঙ্গ হিসেবে রয়েছে বিভিন্ন রকমের রাইড। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন রকমের খেলনা ও খাবারের দোকান। আর উইন্টার নাইটের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে আছে আইস স্কেটিং এবং আইস স্লাইড।

আমরা টুকটাক দু একটা রাইডে চড়ে আইস স্কেটিংয়ের কাছে চলে গেলাম, কারণ আমার মেয়ে তাহিয়ার সবচেয়ে পছন্দের রাইড। আইস স্কেটিংয়ের সাথে আরো বাড়তি কিছু ডলার দিলে ওরা আইস স্লাইডিংয়ের তিনটা টোকেন দিচ্ছিলো। তাহিয়া সেই টোকেন নিয়ে আইস স্কেটিংয়ে চলে গেলো আমি আর রায়ান দাঁড়িয়ে গেলাম আইস স্লাইডিংয়ের লাইনে। সাড়ে তিন বছরের রায়ান রাজি ছিলো না, তবুও জোরাজুরি করে একবার চড়িয়ে দিলাম। আর গিন্নি আইস স্কেটিংয়ের পাশে রাখা স্ট্যান্ডিং হিটারের তাপ পোহাচ্ছিলো। তাহিয়া স্কেটিং শেষ করে এসে হিড়হিড় করে কাঁপা শুরু করে দিলো। তখন মনে মনে ভাবছিলাম বাংলাদেশের মতো সাঁজাল জ্বালানোর ব্যবস্থা থাকলে এখন সবাই মিলে ওম নেয়া যেতো।

ভাবতে ভাবতেই দেখি পাশেই একটা চারকোণা শেডের নিচে সবাই দাঁড়িয়ে সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাঁজাল তাপানোর ভঙ্গিতে। কাছে যেয়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ। সেখানে একটা কড়াইয়ের মতো পাত্রের মধ্যে কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে ঠিক বাংলাদেশের খড়কুটো দিয়ে সাঁজাল জ্বলানোর নিয়মে। আর নিরাপত্তার জন্য চারদিকে এই বেড়া দিয়ে দেয়া হয়েছে যাতে করে সবাই নিরাপদে ওম নিতে পারে। বেড়ার উপরে বাংলাদেশের ঘরের আদলে চার চলার একটা ঘরের মতো ছাদ দেয়া। আর খুঁটিগুলোতে হারিকেন সদৃশ বস্তু ঝুলিয়ে রাখা। তার পাশেই একটা ফায়ার এক্সটিংগুইসারও রাখা আছে যাতে হঠাৎ কোন বিপদ ঘটলে মোকাবিলা করা যায়।

অনেককেই পাশের দোকান থেকে মার্সমেলো কিনে এনে আগুনের পাশে রাখা লোহার নলের সাথে সেটা লাগিয়ে সাঁজালের আগুনে গরম করে খাচ্ছিলো। তাদের দেখাদেখি তাহিয়াও মার্সমেলো কিনে আনলো। তারপর সেটা আগুনে গরম করে খেতে শুরু করলো। ওর আগ্রহ দেখে আমি খেতে যেয়ে দেখি জিনিসটা বাংলাদেশের কদমা মিষ্টির মতো দেখতে হলেও এটার স্বাদ আলাদা।

এরপর আমরা আশপাশে ঘুরে দেখি আরো দু জায়গায় এই সাঁজাল জ্বালানো আছে। তবে সে দুটোর ডিজাইন আলাদা। পৃথিবীর আকারের লোহার গ্লোবের মধ্যে কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়েছে। আমরা সেখানে দাঁড়িয়েও কিছুটা সাঁজাল তাপিয়ে নিলাম। সাত সমুদ্র তেরো নদীর এই পারেও গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য খুঁজে পেয়ে খুবই ভালো লাগছিলো। আসলে প্রাকৃতিক ব্যাপারগুলো সারা পৃথিবীতে একইরকম।

সত্যি কথা বলতে অস্ট্রেলিয়ার গ্রামগুলোকে যতই দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। এ যেনো হুবহু গ্রাম বাংলার প্রতিচ্ছবি। তফাত শুধু শহরগুলোতে, কারণ শহরগুলোর ছবি নির্ধারণ করে দেয় সেই দেশটা তথ্য প্রযুক্তিতে কতটা এগিয়ে গেছে।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!