সিডনির চিঠি: ব্ল্যাক ক্যাপসদের জন্য ভালোবাসা

সম্প্রতি শেষ হয়ে গেলো বিশ্বকাপ ক্রিকেট। নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে ফাইনালের মঞ্চে মুখোমুখি হয়েছিলো স্বাগতিক ইংল্যান্ড ও এবারের সবচেয়ে লড়াকু দল নিউজিল্যান্ড।

মো. ইয়াকুব আলী, অস্ট্রেলিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 July 2019, 07:32 AM
Updated : 16 July 2019, 07:32 AM

অস্ট্রেলিয়ার লোকাল টিভি চ্যানেলগুলো অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচ ছাড়া অন্যদের খেলা দেখায় না। তাই অন্যান্য ম্যাচ দেখার সুযোগ কম। তবে যেদিনই খেলা থাকে সেদিনই সকাল বেলা অফিসে আমার সহকর্মী শেন ম্যাথিউ আমার ডেস্কে চলে আসেন।

শেন ম্যাথিউ নিউজিল্যান্ডের নাগরিক। অস্ট্রেলিয়ার চল হচ্ছে এখানে কেউ হয়তোবা ফুটবল ক্রিকেটের খবর রাখে না। কিন্তু তারা ঠিকই রাগবির খবর রাখে। রাগবিকে অস্ট্রেলিয়ার ভাষায় বলা হয় ‘ফুটি’। অস্ট্রেলিয়ার ভাষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য তারা সবকিছুরই একটা সংক্ষিপ্ত রূপ তৈরি করে সেইভাবে সেটাকে উচ্চারণ করে। যেমন জাতি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে তারা নিজেদেরকে অস্ট্রেলিয়ান না বলে ‘অজি’ বলে। কারণ উচ্চারণ করা সহজ।

ঠিক একইভাবে নামের ক্ষেত্রেও তারা একই নিয়ম অনুসরণ করে। যেমন আমার সহকর্মীদের মধ্যে মাইকেল মিকেলপ হয়ে গেছে মিক, ক্যামেরন মোরেল হয়ে গেচ্ছে ক্যাম, আমার বস ডেভিড সিম্পসন হয়ে গেছে সিমো আর আমি ইয়াকুব আলী হয়ে গেছি আলী।

ঠিক একইভাবে শেন ম্যাথিউ হয়ে গেছে শোনি। শোনি ফুটির খবরাখবর রাখার পাশাপাশি ক্রিকেটেরও নিয়মিত আপডেট রাখে আর আমার সাথে এসে প্রায় প্রতিদিনই সেটা নিয়ে আড্ডা দেয়। কারণ অন্যদের ক্রিকেটের প্রতি তেমন উৎসাহ নেই। বিশ্বকাপ শুরুর পর থেকেই আড্ডাটা মোটামুটি একটা নিয়মে পরিণত হলো। আগের দিন রাতে একটা ম্যাচ ছিলো আর পরদিন সকালে শোনি আমার ডেস্কে আসছে না তার ব্যাতিক্রম হয়নি। কোন কারণে শোনি না আসলে আমার বস আমার উদ্দেশ্যে মজা করে বলেন আজ তোমার বন্ধু  আসে নাই!

এভাবেই আমাদের আড্ডা চলে। আগেই বলেছি শোনি নিউজিল্যান্ডের নাগরিক। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের প্রায় সবকিছুতেই মিল থাকলেও নিউজিল্যান্ডের লোকজন একটা বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার লোকেদের চেয়ে বহু এগিয়ে। সেটা হচ্ছে তাদের আচার আচরণ বা সোজা কথায় মানবিকতাবোধ। বর্তমানের অস্থির বিশ্বে নিউজিল্যান্ড এখন পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের তকমা একাই বয়ে চলেছে যেখানে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধর্মের নাগরিকেরা সুন্দর সহাবস্থানের মাধ্যমে শান্তিতে বসবাস করছেন।

নিউজিল্যান্ডে যখন মসজিদে হামলা হলো তখন প্রায় প্রতিদিনই শোনি আমার ডেস্কে আসতো একাধিকবার। আমি বুঝতাম সে আসে আমাকে সান্ত্বনা দিতে। কারণ আমিই একমাত্র মুসলিম ও অভিবাসী। শোনি কথায় কথায় বলতো, আমরা আসলেই দুঃখিত এমন একটা ঘটনার জন্য। কিন্তু তুমি বিশ্বাস করো আমরা মোটেও এমন নই। উত্তরে আমি বলতাম, আমি জানি তোমরা আসলেই ভালো। তবুও বারবার একই কথা বলে আমাকে সান্ত্বনা দিতো।

সেই অস্থির সময়টাতে শোনির সঙ্গ আমাকে দ্রুতই শকটা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছিলো কারণ তারপর প্রায় সপ্তাহখানেক আমার মনে হতো এখানকার সবাই বুঝি আড় চোখে আমাকে দেখছে। শোনি আমাকে আরো বলতো, আলী আমরা নিয়ম বলো বা আইন বলো তার প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল। তাই তুমি ভেবো না সেই লোকের উপযুক্ত বিচার হবেই। আসলেই নিউজিল্যান্ডের লোকজনের আইনের প্রতি অনেক বেশি শ্রদ্ধাশীল।

এইবার আসি বিশ্বকাপ প্রসঙ্গে। বিশ্বকাপের প্রতিটা ম্যাচের পর আমাদের আড্ডা চলছিলো নিয়ম করেই। বিশেষ করে বাংলাদেশ বা নিউজিল্যান্ডের ম্যাচ থাকলে তো কথাই নেই। শোনির কাছ থেকে একটা বিষয় শিখলাম সেটা হলো কিভাবে আসলে নিজেদের দলকে সমর্থন করতে হয়। শোনিকে দেখতাম কখনওই দলের বাজে পারফরমেন্স বা বাজে টিম সিলেকশন হয়েছে এ ধরণের কথা বলতে। ও যেটা বলে সেটা হচ্ছে আমরা হয়তো আরো ভালো খেলতে পারতাম। এই এই জায়গাগুলোতে আমাদের আরো উন্নতি করা দরকার। ওই সুযোগটা কাজে লাগালে ম্যাচটার মোড় ঘুরে যেতে পারতো।

আমরা বাংলাদেশিরা সবাই জন্মগতভাবে এক একজন ডাক্তার এবং ইঞ্জিনিয়ার। তাই আমরা সবাই সব পেশার মানুষের ভুল সহজেই ধরতে পারি, শুধু নিজেরটা ছাড়া। আর বর্তমানে আমরা সবাই ক্রিকেটারও বনে গেছি, বাংলাদেশ দল বিশ্বমঞ্চে ক্রিকেট খেলার যোগ্যতা অর্জনের পর থেকে। আমি এমন অনেক মানুষকে চিনি যারা তাদের দীর্ঘ জীবনে এক মুহূর্তের জন্যও ক্রিকেটের ব্যাট বা বল হাতে নেয়নি, কিন্তু এখন ক্রিকেট খেলা নিয়ে চায়ের টেবিল গরম করে রাখেন। চায়ের টেবিল গরম করে রাখেন তাতে সমস্যা ছিলো না। সমস্যাটা হচ্ছে ভার্চুয়াল মাধ্যমে সেই মতামতটা তারা এখন প্রকাশ করতে পারছেন এবং ঘুরেফিরে সেটা খেলোয়াড়দের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। এই ব্যাপারটা খারাপ।

যাই হোক, ক্রিকেটবোদ্ধা হতে গেলে ক্রিকেট খেলতেই হবে এমন কোন কথা নেই। কিন্তু শুধু রিপ্লে দেখে নিজের ক্রিকেটীয় জ্ঞান জাহির করা আসলেই বোকামি। কারণ আমার মতে ক্রিকেটই একমাত্র খেলা যেখানে অনু সেকেন্ডের ব্যবধানে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। প্রায় একশ মাইল বেগের একটা বল মাত্র বাইশ গজের পিচ পার করতে সময় নেয় কয়েক সেকেন্ড। তাই ব্যাটসম্যান যত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন তত দ্রুতই ঠিক শটটা খেলতে পারবেন। আবার বোলারকেও ব্যাটসম্যানের মুভমেন্ট ফলো করে একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে অনেক সময় বল ডেলিভারির ধরণে পরিবর্তন আনতে হয়। আর ফিল্ডিংটা তো অনেক বেশি শ্রমসাধ্য কাজ।

নিউজিল্যান্ড যখন মোটামুটি নিশ্চিত সেমিফাইনালের পথে, তখন একদিন হাসির ছলে শোনি বলল- পাকিস্তান কি সেমিতে যেতে পারবে? আমি বললাম, শোন তুমি এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না। কারণ তাহলে পাকিস্তানকে আমাদের হারাতে হবে ৩১০ রানের ব্যবধানে যেটা অসম্ভব। আর আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমরা পাকিস্তানকে এই ম্যাচে হারিয়ে দেবো।

শুনে শোনি মুচকি হাসি দিলো। এরপর শোনি ছুটিতে অফিসের বাইরে চলে গেলো। নিউজিল্যান্ড সেমিতে দুর্দান্ত অলরাউন্ডার নৈপুণ্যে ভারতকে হারিয়ে ফাইনালের জন্য কোয়ালিফাই করলো। আমি সংগত কারণেই নিউজিল্যান্ডকে সমর্থন দিয়ে গেলাম। শোনির সাথে ক্রিকেট নিয়ে আলাপ হবার এক পর্যায়ে আমি ওকে বলেছিলাম, আমি দুটো দলের ক্রিকেট খেলার অন্ধ ভক্ত বলতে পারো। কারণ তারাই শুধু ক্রিকেটের মূল্যবোধটাকে ধারণ করে। সেই দুটো দেশ হচ্ছে নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা। তাদের খেলা দেখলে মনে হয় আসলেই ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা।

আমি বললাম আমাদের প্রজন্ম হ্যান্সি ক্রনিয়ে ও স্টিফেন ফ্লেমিংকে দেখেছি। দেখেছে শোন পলক আর শেন বন্ডের বোলিং। আর স্টিফেন ফ্লেমিংয়ের কাছ থেকে শিখেছি কিভাবে ক্রিকেট মাঠে নিজেকে শান্ত রাখতে হয়। একটা মানুষ ফিল্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে দাঁত দিয়ে হাতের নখ খুঁটছে। স্টিফেন ফ্লেমিংয়ের ক্ষেত্রে এটা ছিলো চিরপরিচিত দৃশ্য।

ফাইনালের দিন সাপ্তাহিক ছুটি ছিলো। তাই ভাবছিলাম ফাইনালটা দেখবো। কিন্তু ভয়ে ছিলাম অস্ট্রেলিয়ার লোকাল চ্যানেল দেখাবে কি না? একটা দাওয়াত থেকে ফিরে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে নির্দিষ্ট চ্যানেলে যেয়ে দেখি কি যেন একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। মেয়েকে বললাম খুঁজে দেখো তো এরা আজ খেলা দেখাবে কি না? মেয়ে রিমোর্টের কিসব বোতাম টিপে আমাকে দেখিয়ে বলল, হ্যাঁ বাবা এখানে সাতটা থেকে খেলা দেখাবে।

আমি তাড়াতাড়ি দুটো প্যারাসিটামল খেয়ে নিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম। কারণ দুদিনের ব্যস্ততায় প্রচণ্ড মাথা যন্ত্রণা করছিলো। নিউজিল্যান্ড ব্যাটিং নিলো টসে জিতে। কিন্তু ব্যাট শুরু করলো কেমন যেনো ঢিমেতালে। আসলে বলগুলো সব বিপদজনক উচ্চতায় উঠে যাচ্ছিলো। তাই খুবই সাবধানে সেগুলোকে খেলতে হচ্ছিলো। যাই হোক প্রচণ্ড রকমের মাথা যন্ত্রণা নিয়েও নিউজিল্যান্ডের ইনিংস শেষ করে ঘুমাতে চলে গেলাম। কারণ পরদিন আবার ভোর ছয়টার সময় ঘুম থেকে উঠতে হবে।

তবুও ভোর চারটার দিকে একবার ঘুম ভেঙে গেলে একবার স্কোর দেখে বুঝলাম নিউজিল্যান্ডের জেতার সম্ভাবনা আছে। এরপর ভোরে যখন অফিসে যাওয়ার জন্য উঠলাম তখন দেখি ম্যাচটা টাই হয়ে গেছে। তারপর এক ধরণের অস্বস্তি নিয়ে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করলাম। ট্রেনে এসে সব দেখে শুনে বুঝলাম শুধু ভাগ্য আজ নিউজিল্যান্ডের সাথে না থাকায় এতো কাছে এসেও তারা বিশ্বকাপটা ধরতে পারলো না। কিন্তু সারাবিশ্বের ক্রিকেটপ্রেমী দর্শকেরা ইতোমধ্যেই তাদেরকে অভিনন্দিত করা শুরু করে দিয়েছে এমন একটা ফাইনাল উপহার দেয়ার জন্য।

অস্ট্রেলিয়ার বন্ধুবান্ধবেরা ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছিলো যে রাত জেগে খেলা দেখাটা মাটি হয়ে যায়নি। আমি ফেইসবুক ঘুরে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট টিমের একটা ছবি পেলাম যেখানে লেখা রানার আপ। সেটা আমি ফেইসবুকে দিয়ে লিখলাম ‘পিপলস চ্যাম্পিয়ন’। তখন দেখি সেটা সবাই খুবই পছন্দ করেছে। এরপর একটা ছবি দেখলাম কেন তুমি নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটকে ভালোবাসবে। কারণ তারা কখনই কোন সিদ্ধান্তের বাইরে যায়নি।

অবশেষে একটা ছবিতে দেখলাম নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী যাছিন্দা আরডার্ন লিখছেন, ইংল্যান্ডকে অভিনন্দন আর নিউজিল্যান্ড টিমকে নিয়ে একটা কথায় বলতে পারি সেটা হলো আমরা তোমাদের নিয়ে গর্ব করি। ঠিক যেমন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন ক্রিকেটারদের যেনো কেউ গালি না দেয়।       

ইংল্যান্ড এবারের বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হলেও নিউজিল্যান্ড সবার মন জিতে নিয়েছে। সেদিক দিয়ে তারা আসলেই পিপলস চ্যাম্পিয়ন। আর খেলার মাঠে তাদের ভদ্রতা বরাবরই প্রশংসিত।

অবশেষে ছুটি শেষ করে শোনি ফিরে আসলো ১৬ জুলাই। আমার কাছে আসলে আমি বললাম, গিভ মি এ হাগ। ইউ গায়েজ রিয়েলি ডান ওয়েল। ইউ গায়েজ ডান এভরিথিং দ্যাট ইউ কুড। ইটস দ্যা ব্যাড লাক। আমার কথা শুনে শোনি বলল, আলী নো ওরিস। দেয়ার ইজ অলওয়েজ নেক্সট টাইম। এরপর আমি আমার ফেইসবুক পোস্ট এবং কমেন্টগুলো দেখিয়ে তাকে ইংরেজি করে পড়ে শোনালাম।

সে খুবই খুশি হলো এটা জেনে যে সারা বিশ্বের মানুষ নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট টিমের পাশে আছে সবসময়ই। এরপর আমি বললাম তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যার সাথে আমার ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা হয়। কারণ অজিরাতো ক্রিকেট নিয়ে তেমন একটা মাতামাতি করে না, এমনকি তাদের চ্যানেলে খেলাও দেখায় না। তাই তোমার সাথে একটা ছবি তুলে রাখাটা জরুরি। আমাদের আরেক সহকর্মী কেঙ লিম আমাদের ছবি তুলে দিলো। তার আগে আমি আমার ডেস্কের দুটো মনিটরে নিউজিল্যান্ড টিমের ছবি দিয়ে দিলাম ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে।  

বর্তমানের এই অস্থির সময়েও শুদ্ধ ক্রিকেটের প্রতি মানুষের এই ভালোবাসায় আবারো প্রমাণ করে মানুষ সততার পূজারী। মানুষ যুদ্ধ নয় শান্তি প্রিয়। আর ক্রিকেটের মূল বার্তায় হলো শুদ্ধতা এবং শান্তি ছড়িয়ে দেয়া। তাই এইবার ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন হলেও ব্ল্যাক ক্যাপের কুড়িয়েছে পৃথিবীব্যাপী মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!