সিডনিতে ‘আপা ভাবিদের পিঠা উৎসব’

পিঠা বাংলাদেশের শ্বাশত ঐতিহ্যের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। স্বাদ ও পুষ্টি মানে অনন্য এই পিঠা আমাদের শেকড় এবং অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে নিবিড়ভাবে।

মো. ইয়াকুব আলী, অস্ট্রেলিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 July 2019, 05:04 AM
Updated : 14 July 2019, 05:04 AM

বাঙালির উৎসবে, আয়োজনে আর আপ্যায়নে পিঠাপুলির উপস্থিতি অবিচ্ছেদ্য। দেশ ছেড়ে এসে এই সুদূর প্রবাসে পিঠার স্বাদ থেকে আমরা বঞ্চিত থাকি। সেই অপূর্ণতাকে পরিপূর্ণতা দিতেই প্রবাসে বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন পিঠা উৎসবের আয়োজন করে থাকে। কখনও সেটা গোষ্ঠী পর্যায়ে, আবার কখনও সেটা সংগঠনের পর্যায়ে।

আমরা যারা বুয়েটে একই ব্যাচে পড়াশোনা করেছি তারাও প্রতি বছর শীতকালে পিঠা উৎসবের আয়োজন করে থাকি। অবশ্য কথাটা হবে আমাদের বন্ধুদের স্ত্রীরা এটার আয়োজন করে থাকেন। শুরুতেই তারা মেসেঞ্জারে একটা গ্রুপ তৈরি করে নেন। তারপর তারা নিজেদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিয়ে সেই মোতাবেক প্রস্তুতি নিতে থাকেন।

আপা-ভাবিরা পিঠা উৎসবের প্রস্তুতি নিতে থাকুক, এই ফাঁকে আমরা একটু সময়ের গাড়িতে চড়ে ১৯৯৯ সাল থেকে ঘুরে আসি। ১৯৯৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে তারপর ভর্তির সুযোগ পেয়ে আমরা সবাই দ্রুতই ভর্তি হয়ে গেলাম। কিন্তু ক্লাস আর শুরু হয় না। অন্যান্য ক্যাম্পাসে ভর্তি হওয়া বন্ধুরা ইতোমধ্যে ক্লাস শুরু করে দিয়ে এক দুই টার্ম শেষও করে ফেললো।

এরপর আমাদের ক্লাশ শুরু হলো ১৯৯৯ সালের ২৪ অক্টোবর। এরপর থেকে এই তারিখটা আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় মাইলফলক হয়ে আছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্কুল কলেজ পাশ করে এসে আমরা একইসাথে প্রায় পাঁচটি বছর একত্রে কাটালাম বুয়েটের ক্যাম্পাসে। দিনে দিনে একে অপরকে বুঝতে শিখলাম আমরা। বন্ধুত্বের প্রকৃত রূপ সম্মন্ধে ধারণা তৈরি হলো। পাশ করে প্রত্যেকে নিজ নিজ কর্মজীবনে ব্যস্ত হয়ে গেলেও বন্ধুদের বেলায় সময় বের করাটা কোনভাবেই আটকে থাকে না।

এরপর আমাদের প্রত্যেকেরই আলাদা সংসার হয়েছে। সেই সংসার আলো করে এসেছে এক দঙ্গল বাচ্চাকাচ্চা। আমরা যখন নিজেরা একত্রিত হয়ে নিজেদের মধ্যে আড্ডা দিই তখন আমাদের সহধর্মিণীরাও আমাদের সাথে যোগ দেন। বাইরে থেকে দেখে মনে হবে যেন এরা সবাই একই ক্যাম্পাসের বহুদিনের পুরনো বন্ধু। আমাদের সবকিছুরই সমান ভাগিদার আমাদের অর্ধাঙ্গিনীরা। তাদের সহযোগিতা না পেলে কখনই আমাদের একত্রিত হওয়া সম্ভব ছিলো না।

আর আমাদের বাচ্চাকাচ্চাগুলোকে একসাথে দেখলে মনে হয় যেন তারা সবাই একটা একান্নবর্তী পরিবারের সদস্য। নিজেদের মধ্যে কেমন করে জানি তারা একটা বোঝাপড়া তৈরি করে নিয়েছে। ওরা যখন আড্ডা দেয় তখন আমি মাঝে মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখে অবাক হয়ে যাই। বছরে হয়তোবা মাত্র দু তিন দিন তাদের মধ্যে দেখা হয়, কিন্তু তারা ঠিকই একে অপরকে মনে রাখে।

ফিরে আসি এবারের আয়োজনে। অস্ট্রেলিয়ার চার ঋতুর মধ্যে এখন চলছে শীতকাল। বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে সারা বিশ্বের সাথে সাথে অস্ট্রেলিয়ারও আবহাওয়া দিন দিন চরমভাবাপন্ন হয়ে যাচ্ছে। গরমকালে যেমন ভয়ংকর রকমের গরম পরে আবার শীতকালে প্রচণ্ড রকমের ঠাণ্ডা থাকে।

এইবার শীতের শুরু থেকেই পিঠা উৎসবের পরিকল্পনা করেছিলেন আমাদের সহধর্মিণীরা। কুমু ভাবি, জিনাত ভাবি, পিনু ভাবি, বনু ভাবি, শাকিলা ভাবি, ফারিবা ভাবি, লাবণ্য ভাবি, নুসরাত ভাবি আর আমাদের বান্ধবী কাম ভাবি তানজিলা আর আমাদের আরেক বান্ধবী রিফাত সবাই মিলে মেসেঞ্জারে একটা গ্রুপ তৈরি করে ফেললেন। তারপর চললো পিঠা উৎসবের বিস্তারিত পরিকল্পনা এবং সেটাকে সফল করার জন্য আয়োজন।

এইবারের  আয়োজনটার জন্য স্থান নির্ধারিত হয়েছিলো বন্ধু আসাদ আর তার সহধর্মিণী কুমু ভাবিদের বাসা। তাই সিংহভাগ দায়িত্ব তাদের ঘাড়েই বর্তালো। সবাই তাদের নিজেদের দায়িত্ব বুঝে নিয়ে সেই মোতাবেক এক একটা আইটেম তৈরি করে ফেললেন তারপর ১৩ জুলাই দুপুরে সবাই হাজির হয়ে গেলো কুমু ভাবির বাসায়। সবাই আসতে পারলেও বন্ধু পিয়াস, সুজন, দীপ এবং সৌমেনের পরিবার আসতে পারেনি ব্যস্ততার কারণে।

নামে পিঠা উৎসব হলেও এটা আসলে ছিলো আমাদের ব্যাচের একটা পুনর্মিলনীর মতো, তাই দুপুরের খাবারও অন্তর্ভুক্ত ছিলো। সবাই চলে আসার পর শুরু হলো খাবারগুলো সাজিয়ে পরিবেশনের পালা। পদগুলো গুণে দেখলাম সেখানে ভর্তায় আছে দশ রকমের। রান্নাঘর বিষয়ে আমার যতটুকু অভিজ্ঞতা সেখান থেকে জানি খাবার তৈরি করা আসলে একটা শিল্প এবং মসলার সামান্য তারতম্যে স্বাদের আকাশ পাতাল তফাৎ হয়ে যায়, কিন্তু খেতে শুরু করে আমরা বুঝলাম প্রত্যেকটা পদ একটার থেকে অন্যটা সুস্বাদু হয়েছে।

দুপুরের খাবারের শুরুতেই আমরা বাচ্চাদের খাইয়ে দিলাম যাতে তারা তাদের মতো করে বিরামহীন খেলাধুলা করতে পারে। তারপর আমরা সবাই খাবার নিয়ে নিলাম। খাবারের পাশাপাশি চললো আড্ডা। সেখানে বন্ধুরা এবং ভাবিরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিলেন। আমাদের মধ্যে একমাত্র ব্যাচেলর হচ্ছে বন্ধু রায়হান। ব্যাচেলর বলেই হয়তো ওর কণ্ঠস্বর সবসময়ই জোরালো, তাই আড্ডায় আমরা সবাই মিলে বলি অর্ধেক কথা আর ও একাই বলে অর্ধেক কথা।

এভাবে একসময় দুপুরের খাবার শেষ হলে বিকেলে পরিবেশন করা হলো বাহারি স্বাদের এবং নকশার বাংলাদেশের পিঠা। যদিও সেগুলো সাত সমুদ্র তের নদীর এই পারে পরম মমতায় তৈরি করেছেন আমাদের ভাবিরা। আমরা পিঠা সাজিয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। তখন খেয়াল করে দেখি আমাদের বাচ্চারা একে একে এসে তাদের নিজ নিজ পছন্দ অনুযায়ী পিঠা নিয়ে যাচ্ছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছিলো তারা যেন শীতকালে মামার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে পিঠা খাওয়ার জন্য।

প্রত্যেকটা পিঠায় ছিলো অনেক সুস্বাদু। কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে গেলো। এরপর শুরু হলো শীতকালের সিগনেচার ভাপা পিঠা তৈরি। সেখানে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করলেন বন্ধু রনির মা এবং স্ত্রী। এখানে উল্লেখ্য আমাদের এই পিঠা উৎসবের অংশ হয়ে এসেছিলেন দুজন গুরুজন বন্ধু রনি এবং বান্ধবী তানজিনার মা। উনারা থাকাতে আমার এই উৎসব যেন একেবারে পূর্ণমাত্রা পেয়েছিলো। আসলেই আমাদের জীবনে গুরুজনদের প্রয়োজন কখনো ফুরিয়ে যায় না, সেটা আজও আবার উনারা প্রমাণ করে দিলেন আমাদের গরম গরম ভাপা পিঠা বানিয়ে খাইয়ে।

ভাপা পিঠা আগে থেকেই উনারা তৈরি করে রাখেন নাই, কারণ শক্ত হয়ে গেলে আর খাওয়া যাবে না। বন্ধু আসাদ বাংলা দোকান থেকে কিনে আনা প্যাকেটজাত খেজুরের পাটালিগুড় কেটে দিয়ে ভাবিদের সহযোগিতা করলো। তারপর গরম গরম ভাপা পিঠা তৈরি হচ্ছিলো আর সবাইকে গরম গরম পরিবেশণ করা হচ্ছিলো। ভাপা পিঠা খেয়ে সবাই একবাক্যে স্বীকার করলো এটা সুস্বাদু হয়েছে।

পিঠা খাওয়া চলতে থাকলো। ইতোমধ্যে বন্ধু আলম তার গাড়ি থেকে তাস নিয়ে আসলো। তখন গালিব, রায়হান, ইউসুফ আর সাব্বির বসে গেলো তাস নিয়ে। ওরা টোয়েন্টি নাইন খেলছিলো আর আশিক, মুকি, সাইফ, রনি বিভিন্নভাবে ওদের উৎসাহ দিয়ে চলছিলো। আমাদের ব্যাচের একমাত্র দুলাভাই জাহিদ, বান্ধবী রিফাতের স্বামী আমাদের একই ব্যাচের হওয়াতে আমাদের বন্ধু হয়ে গেছে এতোদিনে। সেও আমাদের আড্ডায় অংশ নিচ্ছিলো সমান তালে।

তাস খেলাটা বুয়েটের ছাত্রদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমার ধারণা তারা বুয়েট জীবনের যে পরিমাণ সময় তাস খেলার পিছনে নষ্ট করেছে তার চার ভাগের এক ভাগ বুয়েটের পড়াশোনার প্রতি দিলে তারা সবাই বুয়েটের শিক্ষক হবার মতো ফল করতে পারতো। অবশ্য তাস খেলাটা ছিলো শুধুই একটা সুন্দর সময় অতিবাহিত করার উপকরণ আর টোয়েন্টি নাইন হচ্ছে সবচেয়ে প্রচলিত খেলা। অনেকেই অবশ্য কল ব্রিজ খেলতো আর যারা একটু বেশি ম্যাচিউর ছিলো তারা খেলতো ইন্টারন্যাশনাল ব্রিজ।

যাই হোক, এইভাবে চলতে চলতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল আর বিকেল গড়িয়ে রাত হয়ে গেছে আমরা খেয়ালই করিনি। কিন্তু তবুও সবাইকে উঠতে হলো কারণ আসাদের লুমিয়ার বাসা থেকে অনেককেই প্রায় ঘণ্টাখানিক ড্রাইভ করে ফিরতে হবে। ফেরার সময় সবাই আসাদ আর কুমু ভাবিকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিলো এমন একটা আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য।

আসলে প্রবাস জীবনের যান্ত্রিকতায় এমন উপলক্ষ্যগুলো হচ্ছে একটু স্বাধীনভাবে নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ। তাই সবাই খুবই উপভোগ করে। আমাদের ক্ষেত্রে সেই মাত্রাটা একটু বেশি। কারণ আমাদের এই পরিচয় প্রায় বিশ বছরের পুরনো।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!