প্রবাসে বইমেলা বাঙালির শেকড়ের গভীরতা: সেলিনা হোসেন

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটন ডি.সিতে এ বছরের বইমেলায় এসেছিলেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। সে সময়ে নিউ ইয়র্কে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জন্য সেলিনা হোসেনের এ সাক্ষাতকারটি নেন জার্মান প্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক নাজমুন্নেসা পিয়ারি।এখানে তা উপস্থাপন করা হলো।

নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 July 2019, 06:48 AM
Updated : 8 July 2019, 06:48 AM

নাজমুন্নেসা পিয়ারি: ডায়াসপোরা সাহিত্য সম্পর্কে আপনার মনোভাব কি?

সেলিনা হোসেন: ডায়াসপোরা সাহিত্য বাংলা ভাষার ভিন্ন আঙ্গিকে রচিত নতুন মাত্রা। প্রবাসী বাঙালি লেখকরা সাহিত্যের এই জায়গা পূরণ করেন বলে আমি মনে করি। যারা দীর্ঘ বছর ধরে অন্য দেশে বাস করে সে দেশের জনজীবনের সঙ্গে পরিচিত হন। তাদের সংস্কৃতির বিষয় অনুধাবন করেন। সাহিত্য দুই সংস্কৃতির ভেতর থেকে উঠে আসা কাহিনী। ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের অভিজ্ঞতা, মানসিক সংকট, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার চরিত্র। এভাবে পারস্পরিক সংযোগে গড়ে ওঠা সাহিত্যই হচ্ছে ডায়াসপোরা সাহিত্য।

সবচেয়ে বড় আরেকটি দিক আমার কাছে প্রধান হয়ে উঠে যে, ভবিষ্যতে বাংলা ভাষা হারিয়ে যাবার কোন শঙ্কা আমাদের সামনে নেই। প্রজন্ম তৈরি হয়ে ভাষাকে ধরে রাখবে হাজার বছর ধরে। আমাদের শহীদ দিবস একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। বিশ্বের ইতিহাসে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে এ এক অসাধারণ ঘটনা। প্রতিটি জনগোষ্ঠী নিজ মাতৃভাষা রক্ষার প্রতীকী দিন পেয়েছে। বিশ্বজুড়ে আর কোন জনগোষ্ঠীকে মাতৃভাষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। বাঙালি-বাংলা ভাষা-বাংলাদেশ এই প্রতীকের সামনে জ্বলজ্বল করবে।

বাঙালির আয়োজনে ভিন্ন দেশের মানুষের সামনে বাংলা ভাষার বইয়ের মেলা এই প্রতীকী দিনের বাস্তব সত্য। বইমেলা জাতিসত্তার অস্তিত্ত্বের উজ্জ্বল উদ্ধার। বইমেলার মাধ্যমে বিশ্বের মানুষের সামনে বাংলা ভাষার মাধ্যমে রচিত সাহিত্য-গবেষণা-মননের বিকাশ উপলব্ধির প্রতীক হয়ে থাকছে। বইমেলার আয়োজনে দাঁড়িয়ে স্মরণ করি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। দুজন মনীষী বাংলা ভাষাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার কাজটি সম্পন্ন করেছেন। এভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বইমেলা অনুষ্ঠিত হলে বাংলা ভাষা, বাঙালির সংস্কৃতি আন্তর্জাতিক মান অর্জন করবে। ভবিষ্যতের জন্য ধরে রাখবে বাঙালির শেকড়ের গভীরতা।

নাজমুন্নেসা পিয়ারি: যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসীদের সম্পর্কে আপনার বিশেষ পর্যবেক্ষণ আছে কি?

সেলিনা হোসেন : আমেরিকায় আমি প্রথম আসি ১৯৯৬ সালে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গীদের একজন হয়। সে আসার অভিজ্ঞতা ছিল অন্যরকম। সে সময়ে তিনি লেখক সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গী করেছিলেন। ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক, সৈয়দ হাসান ইমাম, লায়লা হাসান ও আমি। হোয়াইট হাউজ, পেন্টাগন অফিস, বিভিন্ন মিউজিয়াম ইত্যাদি দেখার অভিজ্ঞতা এখন আমার স্মৃতির সঞ্চয়।

আমেরিকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এসেছি এটা বলা যাবে না। মুক্তধারা আয়োজিত বইমেলা ও সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানে প্রথমবার আসি ২০১৬ সালে। সেটি ছিল মুক্তধারার বইমেলার রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠান আমাকে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করে। বাংলা ভাষার বইয়ের প্রসার অন্য দেশের মাটিতে। সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা। প্রবাসে বাস করে যারা লিখছেন তাদের বই সম্পর্কে জানা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বইমেলার একটি দিক।

অন্য দিক হলো শিশুদের অনুষ্ঠান। তাদের চমৎকার পরিবেশনা আমাকে মুগ্ধ করে। আমার প্রত্যাশার জায়গা প্রসারিত করে। বাঙালির শেকড়ের জায়গা ধরে এগিয়ে যাবে প্রজন্ম। প্রসারিত হবে বাংলা ভাষার দিগন্ত। ওয়াশিংটন ডি.সিতেও দুই বছর ধরে আয়োজিত হচ্ছে বইমেলা। কানাডার টরন্টো, মন্ট্রিয়লের বইমেলায়ও গিয়েছি। লন্ডনের বইমেলায় গিয়েছি। এগুলো আমাকে অভিভূত করেছে।

নাজমুন্নেসা পিয়ারি: আপনার লেখা কোন বইটিতে আপনার প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করেন?

সেলিনা হোসেন: আমিতো মনে করি আমার সব বইয়ে আমার প্রত্যাশার প্রতিফলন আছে। কেননা বাঙালির জনজীবনের বহমান স্রোত আমার সাহিত্যে। চেষ্টা করেছি আমার সাহিত্যে বিভিন্ন মাত্রায় মাটি ও মানুষের জীবন রূপায়িত করতে। ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ উপন্যাসে বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ এর পটভূমিতে রচিত। সময়কে কনটেমপোরারি প্যারালাল করার জন্য ভাষার ওপর আক্রমন দেখিয়াছি, দেশের স্বপ্ন দেখিয়েছি সবাইকে। যার ভৌগলিক বিবরণ বাংলাদেশের সীমানা।

আমার ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ উপন্যাস রচিত হয়েছে ৪৭ থেকে ৭৫-এর পটভূমিতে। দেশভাগ থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করে শেষ করেছি এই উপন্যাস। আমার ‘পূর্ণ ছবির মুগ্ধতা’ রবীন্দ্রনাথ যে কয় বছর সে সময়ের পূর্ববঙ্গে বাস করেছেন তার আলোকে লেখা।

আমার ‘ভূমি ও কুসুম’ উপন্যাস ৪৭-এর দেশভাগের সময় তৈরি হওয়া ছিটমহলের পটভূমিতে রচিত। এভাবে বর্ণনা করলে আমার সব উপন্যাসে আমার প্রত্যাশার জায়গা দেখাতে পারব। কারণ আমি বিষয় নির্বাচন করেছি প্রত্যাশার চিন্তা দেখেই।

নাজমুন্নেসা পিয়ারি: বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান হিসেবে আপনার ভাবনা চিন্তা কি?

সেলিনা হোসেন: শিশু একাডেমি শিশুদের সৃজনশীলতা বিকাশে কাজ করে। তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে সংস্কৃতিচর্চার ধারাবাহিতকা রক্ষার আয়োজন করা হয়। প্রজন্ম যেন সংস্কৃতিচর্চা থেকে বিচ্যুত না হয়। প্রকাশের মাধ্যমে শিশুসাহিত্য রচয়িতাদের উৎসাহিত করা হয়। শিশুদের হাতে তাদের ভাবনার জায়গা সমৃদ্ধ করে এসব বই। সম্প্রতি শুরু হয়েছে ‘ক্ষুদে লেখকের খোঁজে’ প্রোগ্রাম। শিশুদের লেখালেখির ভুবনে আনার এটি একটি দিক। এভাবে শিশুদের প্রতিভা বিকাশে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। আমার বিশ্বাস দেশের ৭১টি জেলা-উপজেলায় এমন কর্মকাণ্ড শিশুদের সৃজনশীলতার বিকাশের সহায়ক ক্ষেত্র।

নাজমুন্নেসা পিয়ারি: বাংলা একাডেমিতে বহু বছর বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন। পরিচালনা পর্ষদেও ছিলেন। সে সম্পর্কে কিছু বলুন।

সেলিনা হোসেন: বাংলা একাডেমিতে আমি ৩৪ বছর চাকরি করেছি। এই প্রতিষ্ঠানকে আমি নিজেকে তৈরি করার প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখেছি। আমি বলি বাংলা একাডেমি আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। গবেষণা কাজের সুযোগ পেয়েছি। প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করে নিজের মননশীলতার চর্চা করতে পেরেছি। আমার লেখালেখির সবটুকু এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সূত্র শিল্পবোধের জমিন তৈরি করেছে। এই প্রতিষ্ঠান আমার প্রাণের টান।

নাজমুন্নেসা পিয়ারি: আপনি একজন নারী। দেশের প্রধানমন্ত্রীও নারী। তাঁকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?

সেলিনা হোসেন: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার কাছে শুধু একজন নারীমাত্র নন, তিনি মানবিকবোধের চেতনায় একজন প্রদীপ্ত মানুষ। তাঁর সামনে দেশ ও মানুষ, রাষ্ট্রক্ষমতার জায়গা থেকে অবলোকনের সীমিত ক্ষেত্র নয়। তিনি জীবনচর্চায় দেশ ও মানুষকে আপন জ্ঞানের আলোয় পূর্ণতা দেন। মানুষের মর্যাদার প্রশ্নে তিনি দ্বিধাহীন চিত্ত। তাঁর প্রতিটি কর্মকাণ্ডে বাঙালির জীবন-মানের উন্নয়নের বিকাশ ঘটছে। যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, সেই স্বপ্নের পথেই হাঁটছে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!