প্রবাসে দিনরাত্রি: দেশে আপনজনের মৃত্যুর খবর

ইদানিং ফোন বাজলেই অস্থির হয়ে পড়ি। টেক্সট মেসেজ দেখতে চাই না। পারলে ফেইসবুক থেকে হাজার মাইল দূরে থাকি। কিন্তু না চাইলেও এগুলো তো আমার কাছ ছাড়ে না।

কাজী হাসান, যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 July 2019, 06:20 AM
Updated : 2 July 2019, 06:29 AM

আর সেখান থেকে আমি যে খবর পাই, সেটা আমি কোনোভাবেই চাই না। একের পর এক দুঃসংবাদ যেন আমার অপেক্ষায় থাকে।

ঠিক তাই। আবার সেই ফোনে আরও একটা দুঃসংবাদ এলো। আমার মায়ের ছোট ভাই মানে আমাদের সালাম মামা কলকাতায় থাকতেন। তিনি মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

বেচারা বেশ ভুগছিলেন। বেশ কয়েক বছর ধরেই ডায়ালাইসিস করে টিকে ছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। তাকে চলে যেতে হলো। অল্প কয়েক বছরের মধ্যে আমার মাসহ তার ভাই বোনেরা এক এক করে সবাই চলে গেলেন। বুঝতেই পারছি Cycle of Life আগের প্রজন্মের সাথে তার দায়িত্ব প্রায় শেষ করে এনেছে। এর পরে Cycle of Life কি আমাদের প্রজন্মের দিকে এগিয়ে আসবে?

আমরা প্রত্যেকেই জানি, মানুষ এ পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তার দেওয়া নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য আসে। তারপর সবাইকে ফিরতে হবে। এর একেবারেই কোনো ব্যতিক্রম নেই। তা সত্ত্বেও এই স্বজনদের মৃত্যু আমাদেরকে ভীষণ কষ্ট দেয়। এর মাত্রা ভাষায় বোঝানো একেবারে অসম্ভব।

তবে তুলনা করতে গেলে আমি বলবো, বুকের কলিজাকে কুচি কুচি করে কাটলে যে জ্বালা হতে পারে, তার থেকে এই কষ্ট ও ব্যথা কোনো অংশেই কম নয়।

প্রবাসী হওয়ার ভীষণ বড় একটা যন্ত্রণা আছে। আমাদের শরীর বিদেশে থাকলেও, মনটা বারবার ছুটে চলে যায় দেশে ফেলে আসা সেই আপন মানুষগুলোর কাছে। এই পর্যন্ত প্রবাসে বসে কত প্রিয়জনেরই না আমাদেরকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সংবাদ পেলাম। মন চাইলেও তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারিনি। মৃত চেহারাগুলোর দিকে তাকিয়ে ক্ষমা চেতে পারিনি। নিজেকে ভীষণ স্বার্থপর ও অপরাধী মনে হয়।

তাদেরকে শেষ মুহূর্তে দেখতে না পারার কষ্টের সঙ্গে যোগ হয় আপ জনের জন্য দায়িত্ব পালন করতে না পারার প্রচণ্ড মনোবেদনা। বুকের কলিজা পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও বুঝি এতো যন্ত্রণা হয় না।

কলেজে অধ্যয়নের প্রথম দিকে কবি জন ডানের একটা ইংরেজি কবিতা পড়েছিলাম, তার শেষের দুটো লাইন খুব মনে পড়ছে:

ছোট একটা নিদ্রার পর, পরকালে গিয়ে আমাদের ঘুম ভাঙবে। তারপর আর মৃত্যু থাকবে না, মৃত্যুর মৃত্যু হবে।

ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী, প্রতিটা মৃত্যুতে বিশ্বাসীদের তার নিজের মৃত্যুকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করতে হয়। এখানে অনেকটা জন ডানের চিন্তাধারার সঙ্গে আমার ভাবনার মিল খুঁজে পাই। ব্যক্তিগতভাবে আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না। বরং অন্তিমকালে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সাক্ষাতে আমি উদগ্রিব থাকবো।

কিন্তু কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি আমার মৃত্যু যাতে আমার পরিবার কিংবা অন্য কারোর ভোগান্তির কারণ না হয়। আমার ধারণা আমার সমবয়সীরা একইভাবে চিন্তা করেন। আল্লাহ সুবহান আ তা আলা, আমাদের দোয়া কবুল করবেন। ইনশাআল্লাহ।

জন টেইলার নামে একজন বিজ্ঞ মানুষ বলেছিলেন, ‘আমরা আমাদের প্রিয় মানুষকে হারানোর জন্যে দুঃখ করি, তবে ওই পারের অন্যরা তাকে পাওয়ার জন্যে উল্লসিত হয়।’ আমাদের প্রয়াত আপন ও প্রিয় মুখগুলো, নিশ্চয়ই পরকালের ভালো মানুষের দল ভারি করেছেন। এইতো মাত্র কয়েক দিনের ব্যাপার, তারপরই তাদের সঙ্গে আমরাও অনন্তকালের জন্য মিলিত হবো। তখন তাদের হারানোর আর কোন ভয় থাকবে না।

তারপরও প্রতিটা আপন, প্রিয়, পরিচিতজনের মৃত্যু আমাদের ব্যথিত করে, কষ্ট দেয়, বুকটা ভেঙ্গে চুরমার করে। আমরা কাঁদতে চাই একটু স্বস্তির আশায়। আমাদের পল্লিকবি জসিমউদ্দিনের ভাষায়, ‘এসে জড়াজড়ি কাঁদি, কেঁদে যদি হয় সুখ’।

প্রকৃতি তার নিজের নিয়মে কাজ করে চলবে। যার যখন ডাক আসবে তাকে তখনই এই মায়ার পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমিও ফোন তুলে হ্যালো বলবো, টেক্সট ম্যাসেজ চট করে দেখে নিবো, কিংবা ফেইসবুকে চোখ রাখব। আবারও কোন প্রিয়মুখের চলে যাওয়ার খবর পাবো। আবার ভারাক্রান্ত হবো।

শেষে আজকের মতোই নিজেকে সান্ত্বনা দিবো, এই তো আর কয়েকটা  দিনের অপেক্ষা। তার পরই আমাদেরকে ছেড়ে যাওয়া সেই প্রিয় মুখগুলোর দেখা আমি পাবো। অবশেষে একদিন আমিও মরীচিকার পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো। তখন অন্যরাও নিশ্চয়ই এই খবরটা পাবেন ফোন, টেক্সট কিংবা ফেইসবুকে।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি

ইমেইল: quazih@yahoo.com

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!