বাবা দিবসের ছোটগল্প: ময়ূরাক্ষী

কফির দোকান খোলার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সারারাত লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করার পর সকালবেলা স্টারবাক্স এর এই ক্যাফেটাই যা ভরসা। ভেন্ডিং মেশিনের বিস্বাদ কফি আর বিস্কুট দিয়ে যদি সকালের নাশতাটাও করতে হত, তাহলে আর বাকি দিনটা টেকা যেত না।

কাজী প্রিয়াংকা সিলমী, যুক্তরাষ্ট্র থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 June 2019, 09:57 AM
Updated : 16 June 2019, 01:46 PM

দরজার বাইরে ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে শুনতে পাচ্ছি খুঁটখুঁট শব্দ, জানালার কাঁচ দিয়ে দেখতে পাচ্ছি বারিস্তাদের। ইশ! যদি দরজাটা খুলে এক কাপ আগুন-গরম কফি দিত, তাহলে বোধ হয় শীতে দাঁড়িয়ে থাকাটা সহনীয় হত! কিন্তু না, তা দেবে না, ঠিক সাতটার এক মিনিট আগেও দরজা খুলবে না এরা। রাত জেগে থিসিসের গবেষণা কাজ করে আজকাল প্রায় সকালেই আসা হচ্ছে এখানে, তাই এই তথ্যটা এখন আমার জানা।

সোনালি চুলো সুদর্শন বারিস্তা ছেলেটা আমায় দেখে মিষ্টি হাসি দেয়। ভাবি, হয়তো চেনা খদ্দেরের জন্য বিশেষ হাসি। আমিও হাসি। ও বলে, ‘আজ কি প্রচণ্ড ঠাণ্ডা! তাই না?

মাথা নেড়ে ভদ্রতাবশত বলি, ‘হুম,খুব ঠাণ্ডা’। বাংলাদেশি মেয়ে আমি, আমার কাছে আমেরিকার পুরো শীতকালটাই ভয়াবহ কষ্টের, অক্টোবর মাসে যখন বরফ পড়াও শুরু করেনি, তখন থেকেই আমার হাড় কাঁপুনি শুরু হয়েছে। আজ নতুন করে কোন ‘প্রচণ্ড ঠাণ্ডা’ অনুভব করছি না।

ছেলেটা গল্প করা শুরু করে, ‘আজকে গাড়ি বের করতে যা ঝামেলা হয়েছে!’। আমি মাথা নেড়ে চুপ করে থাকি। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। বেশি আগ্রহ দেখালে ছেলেটা কাজ থামিয়ে না আবার ওর কুকুরের গল্প জুড়ে দেয়। আগে একবার কি মনে করে কুশল জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তারপর সে দীর্ঘ আলাপ জুড়ে দিয়েছিল যে সে অধীর হয়ে তার শিফট শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছে। কাজের পর সে তার কুকুরের জন্য শীতের নতুন সোয়েটার কিনতে যাবে।

কফির অর্ডার নিয়ে  সোনালি-চুলো জিজ্ঞাসা করে, ‘আর তোমার নাম’? আমি মনে মনে একটু দুঃখ পাই। নাহ, ছেলেটা তাহলে আমাকে মনে রেখে আপন ভেবে এত গল্প করেনি। নেহায়েতই আমেরিকান ‘স্মল টক’, এদেশিয় মানুষ আবহাওয়া, দিনকাল, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে অচেনা মানুষের সঙ্গে বকবক করতে ভালবাসে।  

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার সহজ ‘কফিশপ নামটা’ বলি। আমরা যারা দুর্বোধ্য নামের দলের সদস্য, তারা প্রায় সবাই একটা ‘স্টারবাক্স নাম’ বানিয়ে নিয়েছি। আমাদের মহৎ উদ্দেশ্য হলো ‘কফির কাপে ভুল বানানের নাম লেখা’ নিধন করা। আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো, তৈরি-কফি পরিবেশনের ছুঁতোয় কেউ যেন চিৎকার করে আমাদের নামের ভুল উচ্চারণ না করতে পারে। জন-কেভিন-কেটি ধরণের আমেরিকান প্রচলিত নামের অধিকারী না, এমন অনেক বন্ধুদেরই দেখেছি নাম-কসাইদের হাত থেকে বাঁচার এ ব্যাকুল প্রচেষ্টা করতে।

আমার আমেরিকান বান্ধবী রিয়াহনা ওর প্রথম নামের বদলে ওর শেষ নাম ‘পার্কার’ ব্যবহার করে, ইরানি বান্ধবী ‘লেইলা’ নিজেকে ‘লিলি’ বলে পরিচয় দেয়। আর পাগলাটে মেক্সিকান বন্ধু ‘হোসে’ কফিশপে নিজের নাম বলে ‘টুয়েন্টি টু’। কফি দেবার সময় যখন বারিস্তা ‘টুয়েন্টি টু’ বলে ডাক দেয়, তখন ক্যাফের সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়। সে জন্য আমি চেষ্টা করি হোসের সঙ্গে ক্যাফেতে না যেতে। 

গোগ্রাসে ‘ক্রোয়াসোঁ’ খাচ্ছিলাম, আমেরিকাতে এসে এই ফরাসি নাশতার প্রেমে পড়েছি আমি। খেতে খেতে বারবার কাউন্টারের দিকে তাকাই। একটা ভ্যানিলা ল্যাটে বানাতে এতক্ষণ লাগে? নাকি ‘আ ওয়াচড পট নেভার বয়েলজ’ হাঁড়ির দিকে তাকিয়ে থাকলে পানি কখনই ফুটে না? আমি কফির চিন্তা দূর করার জন্য মোবাইলে মন দেই। স্ক্রিনে বাবার দুটো মিসডকল ভাসছে, কলব্যাক করা দরকার। কিন্তু সেটা করতে ইচ্ছা করে না। যদি বাবা জানেন যে আবার সারারাত ধরে লাইব্রেরিতে পড়েছি, তাহলে অনেক উপদেশ দেবেন। এর বিকল্প হলো মিথ্যা কথা বলা- রাতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম, সকালে উঠে ক্যাম্পাসে এসেছি। তবে সত্য বা মিথ্যা কোনটাই পছন্দ হয় না।  

অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ মনে হলো কেউ অনেকক্ষণ ধরে চেঁচাচ্ছে। খেয়াল করে বুঝি, বারিস্তাটা আমাকেই ডাকছে। ‘মু… মু…’। আশপাশে অনেকেই তাকাচ্ছে এই উদ্ভট নামের ব্যক্তিটি কে, তা দেখার জন্য। ইংরেজি শব্দ ‘মু’ এর বাংলা অর্থ ‘হাম্বা’। ‘হাম্বা’ নামের মানুষটা দেখতে কেমন, তা জানার জন্য আমারও হয়তো আগ্রহ হত। 

আমি মাথা নিচু করে কাউন্টারে গিয়ে আমার কফি নিয়ে বলি, ‘নামটা ‘মু’ না, ‘মো’। সোনালি-চুলো খুব দুঃখিত চেহারা করে বলে, ‘ওহ, নো। আমি খুব সরি’। এই ‘সরি’ শুনে আমার খুব একটা মন ভরে না। সকালে একবার হৃদয়ভঙ্গ হয়েছে, আর না। কফি নিতে নিতেই ফোনটা বাজে। ভাইবারে বাবার ফোন, ধরতে ইচ্ছা করে না। তাও ধরি।  মস্তিস্কের দ্রুত অঙ্ক অনুসারে বাংলাদেশে এখন বিকেল। বাবা তার বিকেলের হাঁটা বাদ দিয়ে আজ বাসায় থেকে গেছেন আমাকে ফোন করার জন্য।

‘সকালে ফোন ধরিস নাই কেন?’ বাবার প্রথম কথা।

 ‘বাবা, আমি তোমার সকাল, মানে আমার রাতে লাইব্রেরিতে ছিলাম। লাইব্রেরিতে ফোন ধরা বারণ...,’ আমি বোঝানোর চেষ্টা করি।

 ‘ওহ, তাই বল,’ বাবার গলায় স্বস্তির নিঃশ্বাস, ‘তো কখন ফিরেছিস বাসায়?’

সত্য নাকি মিথ্যা বলব চিন্তা করতে ইচ্ছা করে না। তাই সত্যিটাই বলে ফেলি। ‘বাসায় ফিরিনি বাবা, সারারাত লাইব্রেরিতেই ছিলাম।’

‘কি বলছিস!! কেন? পরীক্ষার পড়া আগে থেকে করিস নাই কেন? সারারাত জেগে পড়লে কি আর ব্রেইন কাজ করে? পরীক্ষায় ভালো মার্ক তুলতে পারবি না রে, মা! তো কখন পরীক্ষা তোর?’

‘উহু! আমার আজ কোন পরীক্ষা নাই। তোমাকে বলেছি তো বাবা, আমি আমার থিসিস লিখছি, মানে গবেষণার কাজ। এখানে ভাল গ্রেড পেতে হলে, ভাল করে কাজ করতে হবে আর লিখতে হবে মৌলিক কিছু। পরীক্ষা দেয়ার মতন অত সহজ না এটা। তোমাকে বলেছি তো আগে, বাবা।’

‘ও!’ বাবা একটু চুপ করে ভাবে। তারপর বলেন, ‘সেদিন যে বললি আজ পরীক্ষা আছে, অনেক ব্যস্ত?’

‘বাবা, ওটা আমার পরীক্ষা না। আমার স্টুডেন্টদের পরীক্ষা। ওদের পরীক্ষার কোয়েশ্চেন পেপার বানাচ্ছিলাম বলে ব্যস্ত ছিলাম।’ বলেই মনে হল, ফটোকপি সেন্টার থেকে প্রশ্নপত্রগুলো নিতে হবে। সকাল সকাল গেলে ভিড় এড়ানো যাবে। ‘বাবা, আমাকে এখন রাখতে হবে। রাখি, বাই।’

ভারি ওভারকোট, হাতমোজা, কানটুপি পরে নিয়ে ব্যাগটা দুকাঁধে ঝুলিয়ে কফির মগ হাতে আবার দরজার বাইরের শীত মোকাবেলা করতে প্রস্তুত হই। বের হয়েই মনে হয়, জিজ্ঞাসা করা হয়নি যে বাবা কেমন আছেন।

ফোন টেপার জন্য ঠাণ্ডায় হাতমোজা থেকে হাত বের করতে হয়। তবু হাঁটতে হাঁটতেই ফোন দেই। আর ঠিক করি যে, বঙ্গবাজার থেকে কেনা হাতমোজা ফেলে দিয়ে আমেরিকান টাচস্ক্রিন গ্লাভস কেনার সময় হয়েছে। একটা রিং হতেই শোনা যায় বাবার উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর, ‘কিরে, কোন সমস্যা হলো নাকি?’ 

‘না বাবা, তোমার কেন মনে হয় অলিতে-গলিতে আমার জন্য সমস্যা রেডি হয়ে আছে?’ আমি বিরক্ত স্বরে বলি। ‘তোমরা কেমন আছ, জিজ্ঞাসা করতে ভুলে গেছিলাম। তাই ফোন করলাম আবার।’

‘আমাদের আর থাকা, তুই ভাল থাকলেই আমরা ভাল থাকি।’ বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

শুনে অপরাধ-বোধ জাগে, জানি একবার আমার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য সারাদিন অপেক্ষা করেন বাবা। কিন্তু সারারাত না ঘুমিয়ে মাথার ঠিক নেই। তাই, ‘নিজের যখন ছেলে-মেয়ে হবে, তখন বুঝবি কেন চিন্তা করি' এ  জাতীয় কথা শুরু হবার আগেই বলি, ‘তাহলে ধরে নিচ্ছি ভাল আছ তোমরা। আচ্ছা, আমি রাখি এখন।’ ফোনটা রেখে দিয়ে মন খারাপ করে হাঁটতে থাকি।

কপি সেন্টারে পৌঁছে দেখি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রগুলো ফটোকপি করে রাখার কথা থাকলেও করেনি। কাউন্টারে থাকে কম বয়সী শিক্ষানবিস দোকানির উপর রাগ করতে গিয়েও করি না। হয়তো নতুন কাজে ঢুকেছে, এখনও হালচাল বুঝে ওঠেনি। বেচারি লজ্জিত স্বরে বলে, ‘আমি এক্ষুণি করে দিচ্ছি।’ দেড়শ কপি করতে অন্তত ১০ মিনিট লাগবে। আমি ‘একটু আসছি’ বলে দোকান থেকে বেরিয়ে আসি। আশা করি বাইরের ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে মাথার ঝিমুনি ভাবটা একটু কমে যাবে। আর দোকানের একদিকে রাখা ভেন্ডিং মেশিন দেখে আরেকটা কফি খাওয়ার ইচ্ছাটাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা, আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে মাদকসেবীরা যেমনটা করে।

মোবাইলে ইমেইল চেক করতেই চোখে পড়ে এক ছাত্রীর ইমেইল, তার জ্বর হয়েছে বলে সে পরীক্ষা দিতে পারবে না। ইমেইলটা পড়ে চট করে মেজাজ খারাপ হয়। ছাত্রীর মেকাপ পরীক্ষা নেয়ার জন্য আরেকটা প্রশ্নপত্র বানাতে হবে, সেই জন্য না। মেজাজ গরমের কারণ হল ছাত্রীটি আমাকে সম্বোধন করেছে, ‘ডিয়ার মিস চাইডি’ বলে। কত্তবড় সাহস, শিক্ষকের নাম জানে না! একবার মনে হয় লিখি যে, ‘আগে ঠিক করে আমার  নাম লেখে পাঠাও, নয়তো মেকাপ পরীক্ষা নেব না’। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেই।

আমার নাম ‘ময়ূরাক্ষী চৌধুরী’, এ নাম মনে না রাখতে পারলে একজন আমেরিকান অল্পবয়সী মেয়েকে খুব একটা দোষ দেয়া যায় না। সত্যিই যদি জ্বর হয়ে থাকে, তাহলে এটুকু ভুল হতেই পারে। আমি সেমিস্টারের প্রথম ক্লাসে সাধারণত ছাত্র-ছাত্রীদের বলে দেই যে আমার নামটা ওদের জন্য একটু কঠিন হতে পারে, ওরা চাইলে আমাকে ‘মো’ ডাকতে পারে।

অল্প কিছু ছেলেমেয়ে অবশ্য তাও কষ্ট করে আমার নামের সঠিক উচ্চারণটা শিখে ফেলে। ওরা যদি পরীক্ষায় খারাপ করে, তখন আমার মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছা হয়, ওদের গ্রেড বাড়িয়ে দিতে। কিন্তু যেহেতু ওদের গ্রেড বাড়াই না, সেজন্য এ মেয়েটিকেও শাস্তি না দেবার সিদ্ধান্ত নেই। কে জানে, এই জ্বরওয়ালি বেচারি হয়তো প্রথম ক্লাসটাতে আসেনি, তাই আমার সহজ নামটা জানে না সে।

‘ময়ূরাক্ষী’ নামটা আমার বাবার দেয়া। আমার একটুও পছন্দ না। একে তো নামের অর্থটা অদ্ভুত, তার উপর পৃথিবীর হাতেগোনা কিছু মানুষ ছাড়া কেউ এই নামের সঠিক উচ্চারণ করতে পারে না। কেউ ডাকে ‘মউরাখি’, কেউ ডাকে ‘মরখি’। ‘মৈরি’, ‘মৌখি’, এমনকি ‘মাইরি’ ডাকও শুনেছি। বাবা কক্ষনো স্বীকার করেন না, কিন্তু তিনিও অন্যমনস্ক ভাবে দু-একবার আমাকে ‘মউরাখি’ বলে ডেকেছেন।

সাধারণত মানুষের প্রথম নামটা কঠিন হলে তার একটা ছোট নাম বা ডাকনাম থাকে। যেমন বলিউডের নায়িকা ঐশ্বরিয়াকে ডাকা হয়  'অ্যাশ', এক বান্ধবী প্রিয়দর্শিনীকে আমরা ডাকি ‘প্রিয়া’ বলে। কিন্তু আমার নামে সেরকম কোন ব্যাপার নেই। বাবা ছোটবেলা থেকেই আমাকে ডাকেন ‘ময়ূরাক্ষী’, তিনি নামটা ছোট করেননি বলে আমারও কখনও ছোট নামের চিন্তা হয়নি।

ছোটবেলাতে এ নামের জন্য নানান যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে। স্কুলের ছেলেরা আমাকে ডাকত ‘মইরাখি’ বলে। 'এই, মই টাকে কোথায় রাখি বল দেখি!। এই মই! এই মই! কোথায় যাস?’

আমি যখন কলেজে পড়ি তখন বন্ধুরা উত্থাপন করল যে তারা আমাকে ‘ময়ূর’ বলে ডাকতে চায়। ময়ূর+অক্ষি এর প্রথম অংশ। আমি দ্বিমত না করলেও কখনও নামটা সাগ্রহে গ্রহণ করিনি- ময়ূর নামটা তো পুরুষ পাখির নাম! কারো উর্বর বুদ্ধিতে আমাকে ‘আঁখি’ ডাকার চিন্তাটা আসেনি, আমিও মুখ ফুটে বলিনি। তাই সম্পূর্ণ নাম ‘ময়ূরাক্ষী' এর বিভিন্ন রূপ নিয়েই  চলেছে আমার জীবন।

ভার্সিটির নামটা ছিল সব চেয়ে ভয়াবহ। আমাকে ডাকা হত, ‘রাক্ষসী’ বলে। কি যা-তা অবস্থা। তারপর যখন আমেরিকাতে পড়তে আসলাম, শুরু হল নতুন ঝামেলা। আমেরিকানরা ‘বাংলাদেশ’ শব্দটাই  উচ্চারণ করতে পারে না, আর আমার নাম তো বহু দূরের কথা। প্রথম সেমিস্টারের নতুন বান্ধবী কেটি বুদ্ধি দিল নামটা ছোট করে ‘মো’ রাখার জন্য। ‘মোনিক জোন্স' নামের একজন বিখ্যাত আমেরিকান বডিবিল্ডারের ডাকনাম নাকি ‘মো’। কেটি তার বিশাল ভক্ত।

সুন্দর সংস্কৃত শব্দকে কেটে-ছিঁড়ে বারোটা বাজানোর পর এখনও  মাঝে মাঝে আমাকে নাম-বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। যেহেতু ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টগুলো ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রী দিয়ে ভর্তি, তারা প্রায়ই আমায় ডাকে ‘মায়ুরাক্সি’ বলে। তারা নাকি এ নদীর নাম পড়েছে তাদের স্কুলের পাঠ্য-বইয়ে।

‘এটা বুঝি তোমাদের বাংলাদেশের খুব বিখ্যাত নদী?’ অতি উৎসাহী অনেকে জিজ্ঞাসা করে।

‘নাহ, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ মনে হয় জানেই না যে ময়ূরাক্ষী নামে সত্যিকারের একটা নদী আছে। অন্তত আমার পরিচিত বেশিরভাগ মানুষই জানে না।’ আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি।

‘তাহলে?’

সময় থাকলে আমি বিশদে বলি। ‘আমাদের দেশের জনপ্রিয় লেখক হলেন হুমায়ূন আহমেদ আর তার খুব জনপ্রিয় বইসিরিজের চরিত্র হল হিমু। সেই হিমু সাহেবের একটা কাল্পনিক নদী আছে যার নাম সে দিয়েছে ময়ূরাক্ষী নদী। লোকটার সময় কাটানোর দরকার হলে সে কল্পনায় সেই অপূর্ব সুন্দর নদীতে চলে যেতে পারে। যারা হিমুকে ভালবাসে বা হিমুর মতন হতে চায়, তারাও ওই কল্পনার ময়ূরাক্ষী নদীটাকে ভালবাসে।’

এ গল্প বলতে বলতে আমার মুখ-চোখে মনে হয় বিরক্তি দেখা যায়। যারা খেয়াল করে শোনে তারা জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি ওই লেখককে পছন্দ কর না?’

‘না না, এমন কিছু না। আমি ওনার প্রায় সব বই পড়েছি...শেষের দিকের কিছু বই ছাড়া’, আমি তাড়াতাড়ি উত্তর দেই।

আমি বাবাকে খুব ভালবাসি, তবুও নাম নিয়ে এ ভোগান্তিগুলোর কথা আমি বাবাকে কখনও ভুলতে দিই না। আমার নাম-জড়িত কোন কাণ্ড ঘটলেই আমি বাবার ফোনে মেসেজ পাঠাই, ‘বাবা, আবার!’।

বাবা আমাকে অনেক আদর করে উত্তর লিখে পাঠান--

‘ও আমার লক্ষী

তুই ময়ূরাক্ষী

হয়ে আমি পক্ষী

নিব তোকে বক্ষি ’

বাবা খুব একটা ভালমানের কবি না হলেও খুব ভালমানের বাবা। তাই আমি তাকে প্রতিবার ক্ষমা করে দিই।

খুব অল্প বয়সে বাবা বিয়ে করেছিলেন মাকে। শুনেছি যে ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষায় ফেল করার পর বাবা বাসা ছেড়ে পালিয়ে যান। শেষমেষ যখন বাসায় ফিরলেন, তখনও তার মন উড়ুউড়ু। এখানে-সেখানে তাস পিটিয়ে বেড়ান, পাড়ার যাদের খারাপ ছেলে বলা হয় তাদের সঙ্গে মেশেন। অতঃপর, বাংলাদেশের অবিবাহিত ছেলেদের সব সমস্যার মহৌষধ দেয়া হয় তাকে, বাবাকে ধরে-বেঁধে বিয়ে দেয় আমার  দশম শ্রেণী পড়ুয়া মায়ের সঙ্গে। এরকম ওষুধি বিয়ের পর সাধারণত যা হওয়ার কথা তা-ই হয়, বাবার স্বভাবের কোন পরিবর্তন হলো না। 

তখন দেশের বিবাহিত দম্পতিদের সব সমস্যার মহৌষধের প্রেস্ক্রিপশন সাধা হয় আমার মা’কে, ‘বাচ্চা নিয়ে নাও, সব ঠিক হয়ে যাবে’। আমি যখন মায়ের পেটে তখন বাবা আবার উধাও হয়ে যান। আর আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান আমার ছোটখা‌ট মা। মায়ের কথা ভাবলেই আমার মনে খুব দুঃখি একটা মেয়ের মুখ ভেসে ওঠে।

বাবা যখন শেষমেশ ফিরে আসলেন, আমি তখন কয়েক দিনের শিশু। মায়ের মৃত্যু বোধহয় বাবাকে বেশ ধাক্কা দেয়। দাদীর ভাষ্যে, এরপর খুব দায়িত্ববান হয়ে যান বাবা। দাদী-ফুপুদের সাহায্য থাকলেও, ছোট্ট আমার পুরোদস্তুর অভিভাবক বাবাই ছিলেন। অনেক চাপ সত্ত্বেও  আর দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। অবশ্য লেখাপড়াও করেননি আর। দাদুর কাছে টাকা ধার নিয়ে একটা মুদি ও মনোহরি সামগ্রীর দোকান দেন। অদ্ভুত ধরণের দোকান। এক দিকে সাধারণ দোকানের মতন বিস্কিট-চানাচুর-পাউরুটি-সাবান-শ্যাম্পু ইত্যাদি নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসের সম্ভার; আর দোকানের পেছন দিকে সারি সারি তাকে রাখা পুরাতন বই। পাড়ার ছেলেমেয়েরা তিন টাকা করে সেই বই ধার নিতে পারত। যত দিন গিয়েছে ব্যবসার পরিসর বাড়ানোর খাতিরে বইয়ের তাকের সংখ্যা কমেছে। যখন অন্য পাড়ায় আরেকটা দোকান দেয়া হলো, সেগুলোতে আর বইয়ের তাক করা হয়নি। কিন্তু বাবার বই পড়ার উৎসাহের কমতি দেখিনি কখনও।

ছোটবেলা থেকেই দেখেছি বাসাভর্তি কুয়াশা-মাসুদ রানা আর সেবা প্রকাশনীর বই। আর ছিল হুমায়ূন-সুনীল-সমরেশের উপন্যাস। বাবা কখনও স্বীকার করেননি, কিন্তু আমার মনে হয় বাবা হুমায়ূন আহমেদের হিমু চরিত্রটির মধ্যেই খোঁজার চেষ্টা করেছেন বিশ বছর বয়সে হারানো নিজের ভবঘুরে জীবনটাকে। আর সেখান থেকেই নিজের মেয়ের নাম রেখেছেন ‘ময়ূরাক্ষী’। 

যখন একটু বড় হলাম, তখন লুকিয়ে লুকিয়ে একদিন হিমুর ‘ময়ূরাক্ষী’ উপন্যাসটা পড়ে ফেললাম। তখনও আমি কিশোরী, হিমুর মোহ বোঝার ক্ষমতা হয়তো হয়নি। হিমুকে একটুও ভাল লাগল না। কি ভয়ানক ঠগবাজ লোকটা। সবাইকে বিভ্রান্ত করে, জেনে শুনে প্রেমিকা রূপাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখে।

হিমুর গল্প পড়ে বাবার উপরও খুব রাগ হলো আমার। বাবাও বুঝি মাকে এভাবে কষ্ট দিত? হিমু নামের লোকটার জন্যই কি বাবা আমার এই জঘন্য নামটা দিল?

সে রাগ বড় হবার পর আস্তে আস্তে কমে গিয়েছে। ছোটবেলায় বুঝতাম না, তবে এখন মনে হয় বাবার প্রতি আমার ভালবাসাটা যেন বাবা অর্জন করে নিয়েছেন। সেই ভালবাসার চাপে মা-হারানোর রাগ-কষ্টটা জায়গা করতে পারেনি। আমাকে পড়ানোর জন্য বাবা নতুন করে বীজগণিত-জ্যামিতি শিখেছিলেন। আগাথা ক্রিস্টির গল্পের বই পড়া শুরু করেছিলেন যেন মেয়েকে নির্ভুল ইংরেজি ব্যাকরণ শেখাতে পারেন। মেয়ের যেন জামা-জুতা কিনতে সমস্যা না হয়, ঈদের সময় দোকানিদের সঙ্গে দরদাম করা শিখেছেন। শাড়ি কিভাবে পরাতে হয়, চুল কিভাবে বাঁধতে হয়, টেইলরকে কিভাবে বকা দিতে হয়, সব কিছুই শিখেছেন। কৈশোরে যখন পিরিয়ডের ব্যাথায় কাঁতরাতাম, তখন এই বাবাই কাজ ফেলে বাড়িতে থাকতেন। আমার পাশে বসে গল্পের বই পড়ে শোনাতেন, যেন আমি ব্যাথার চিন্তা মন থেকে ভোলাতে পারি।

সেই বাবার কথাতেই বিদেশে আসা। পাশ করে একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে বেশ সুখে দিন কাটছিল। একদিন বাবা হঠাৎ বলেন, ‘তুই বিদেশে যাবি না?’

আমি আকাশ থেকে পড়ি, ‘বিদেশ যাব কেন? দেশে কী সমস্যা?’

বাবা খুব কাঁচুমাচু করে বলেন ‘না, সবাই যে যায়। তুই গেলে ভালই হয়।’

আরও কথাবার্তা বলে আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারি। আমার চাচা-ফুপুরা সবাই অনেক পড়াশোনা করেছেন। দুজনের বিদেশি পিএইচডিও আছে। বাবাকে কেউ মুখে কিছু বলে না, তবে বাবা হয়তো একটু তাচ্ছিল্য অনুভব করেন। ব্যবসায়ীর চাইতে চাকরিজীবী বা শিক্ষাবিদের দাম বেশি আমার বাবার পরিবারে। তাই হয়তো আমার বিদেশি ডিগ্রি নিয়ে বাবার গর্ব করার স্বপ্ন। 

আমি খুব একটা পাত্তা দিলাম না বাবার কথায়। ডিগ্রি বা পুঁথিগত বিদ্যা আমাকে কখনই আকর্ষণ করেনি। পরিচিতদের মধ্যে যাদের সত্যিকারের জ্ঞানী মনে হত তাদের প্রায় কারোরই বিদেশি ডিগ্রি নেই। তাছাড়া, পাশ করে কেবল নিজের মতন করে আয় করছিলাম। জীবনে প্রথমবার নিজের ইচ্ছা মতন যা খুশি তা করার পয়সা তখন হাতে। সেই পয়সা দিয়েই বই কিনে যত খুশি জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব। আবার কষ্ট করে ডিগ্রির জন্য পড়ালেখা করার কোন কারণ খুঁজে পেলাম না।

কিন্তু বিপত্তি শুরু হল যখন একে একে বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু করল। একদিন বাবার সাথে তুমুল তর্কের মধ্যে বলে ফেললাম, ‘তুমি ঠিক করে বল, তুমি কি চাও, আমি বিয়ে করি নাকি বিদেশে পড়তে যাই?’

বাবার চোখ চকচক করে উঠল, ‘তুই বিদেশে পড়তে যাবি?’

এরপর বিয়ে না করে কিভাবে বিদেশে পড়তে আসলাম সেটা অন্য গল্প। কিন্তু মাঝেমাঝে ভাবতে ভালই লাগে যে বাবার স্বপ্ন পূরণ করতেই আমি এত কষ্ট করছি।

শীতের ন্যাড়া গাছগুলোতে এখন সবুজ বসন্তের নতুন পাতা চলে এসেছে। মাস্টার্স থিসিস লেখার কাজ প্রায় শেষের দিকে। প্রফেসর পিএইচডির অফার দিয়েছেন কিন্তু আমার আপাতত তেমন একটা ইচ্ছা নেই। একা একা থেকে আমি হাঁপিয়ে পড়েছি। কফির জ্বালানি দিয়ে চালানো জীবনটা আর ভাল লাগছে না। দেশে গিয়ে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াব আর বিকেলে বাবা-মেয়ে মিলে বারান্দায় বসে বই পড়ব এরকম দিবাস্বপ্ন দেখে দিন গুনি। বাবার ইচ্ছা ছিল মেয়ে বিদেশে পড়বে, সে স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। এখন আমার নিজের ইচ্ছা পূরণ করার সময়।

বাবা আজকাল আর প্রতিদিন ফোন করেন না। আমি ভাবি, কাজের চাপ একটু কমলে আমিই ঘনঘন  ফোন করব। তখন বাবার মান ভাঙবে। তা আর হয় না, হয় অনেক কাজ থাকে আর যখন কাজ থাকে না তখন সামনের ব্যস্ততার কথা চিন্তা না করার জন্য ইউটিউবের অর্থহীন কোন হাসির ভিডিও দেখতে ব্যস্ত থাকি। কে জানত, থিসিস লেখার চাইতেও কঠিন লাগবে তা সংশোধন করার কাজ! একেক বার ভাবি এইবার বুঝি কাজ শেষ, আর তখনই প্রফেসর এর তলব পড়ে। আরো কাজ করতে হবে। আরো দুটো বিশ্লেষণ করতে হবে বা কোন অনুচ্ছেদ যোগ করতে হবে লেখায়।

মাথা খারাপ করা অবস্থা। এর মাঝে একদিন একটা বইয়ের প্যাকেজ এসে হাজির। অবাক হই। অ্যামাজন থেকে তো কোন বই কিনিনি!

খুলে দেখি কালো রঙের শক্তমলাটে বাঁধাই করা একটা বই। আমার ব্যাচেলর্সের থিসিসটা ঠিক এরকম করে বাঁধাই করেছিলাম। ভাবলাম কেউ কি আমার থিসিসটাই পাঠিয়ে দিয়েছে?

মলাট উল্টে দেখি বড় বড় করে লেখা শিরোনাম ‘ময়ূরাক্ষী’। লেখক ‘আসলাম চৌধুরী’। আরো চমকে যাই। ‘আসলাম চৌধুরী’ আমার বাবার নাম।

পৃষ্ঠা উল্টিয়ে যা দেখি, তাকে বলা যেতে পারে ময়ূরাক্ষী নিয়ে লেখা একটা বিশাল প্রবন্ধ। যেন একটা থিসিস বা গবেষণার বই।

ময়ূরাক্ষী শব্দের আভিধানিক অর্থ‘ময়ূরের মতো চোখ এমন’। তবে ‘ময়ূরাক্ষী’ শব্দটি আক্ষরিক অর্থে ময়ূরকে দৃষ্টি প্রদানকারী অঙ্গটিকে ব্যক্ত করে না। ময়ূরের পেখমে চোখের মতন আকৃতির নীল-সবুজ রঙের কারুকাজকে মূর্ত করে ‘ময়ূরাক্ষী’ শব্দটি। ডারউইন তাঁর ন্যাচারাল সিলেকশন তত্ত্বে ময়ূরের পেখমের ময়ূরাক্ষীর উদাহরণ দিয়ে বিবর্তনবাদ বিষয়ক বিশ্লেষণ করেন।

ময়ূরাক্ষী নদীটির নামের উৎপত্তি কি তা জানা যায়নি। তবে ভাবা হয়, ঝকঝকে নীল পানির জন্য নদীটিকে এ নাম দেয়া হয়।

বাংলার মধ্যযুগীয় কবি চণ্ডীদাসের রাধাকৃষ্ণ কাব্যে ময়ূরাক্ষী নদীর উল্লেখ পাওয়া যায়। অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদের মতে ষষ্ঠ শতকে গৌড় রাজ্যের আদি রাজধানী কোটাসুর ছিল এই ময়ূরাক্ষীর তীরে। 

ময়ুরাক্ষী নদীর উপনদী কোপাই নদী দেখেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার বহুল-পরিচিত কবিতা ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে’ রচনা করেন।

প্রায় দুশো পৃষ্ঠার প্রবন্ধে চোখ বোলাতে বোলাতে আমি বাবাকে ফোন করি। বাংলাদেশে রাত প্রায় তিনটা বাজে, কিন্তু অপেক্ষা করা সইবে না আমার। 

‘বাবা তুমি এটা কী করেছ?’

‘ও পেয়েছিস ওটা!’ ঘুম ঘুম গলায় বলেন বাবা। ‘তুই যে খালি বলতি আমি থিসিস লেখা বুঝি না, গবেষণা কত কষ্ট বুঝি না। খালি পরীক্ষা দেয়ার সাথে গুলিয়ে ফেলি। তাই ভাবলাম ওরকম কিছু নিজে লিখি। তাহলে বুঝব তুই কতটা কষ্ট করছিস। তাহলে হয়তো আর বোকামানুষের মতন প্রশ্ন করব না।’

আমার চোখে পানি আসে। কিন্তু বাবা তো কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারে না। দেশ ছাড়ার আগে একটা স্মার্টফোন কিনে দিয়েছিলাম, ভাইবার-হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করা শিখিয়েছিলাম। সেটা রপ্ত করতেই বাবার কষ্ট হয়েছিল। সেই বাবা ইন্টারনেট বা লাইব্রেরি সার্চইঞ্জিন ছাড়া কিভাবে গবেষণা করেছেন?

‘কিন্তু তুমি তো...বাবা, তুমি তো কম্পিউটার ইউজ করতে পারো না। কিভাবে করলে এটা?’

‘আর বলিস না, প্রথমে পাবলিক লাইব্রেরি আর ভার্সিটির লাইব্রেরিতে গেছিলাম। সপ্তাহ খানেক ঘোরাফেরা করলাম। কি যে কষ্ট, লাইব্রেরিয়ানকে এই গবেষণাটা করব বললে হাসাহাসি করে। তখন একজন বুদ্ধি দিল ইন্টারনেট করতে। গেলাম এক ইন্টারনেটের দোকানে। এক ছেলে তারপর শিখায় দিল- টাইপ করা, গুগুল করা। গুগুল যে কি চমৎকার জিনিস! মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার এইটা। ছেলেটা অনেক সাহায্য করেছে, আমি ওকে টাকাও দিয়েছি অল্প কিছু।’

আমি কাঁদতে থাকি আমার পাগল বাবার কথা শুনে।

‘মা, আমি এখন ঘুমাই? তুই কাঁদবি বুঝি নাই। ভেবেছিলাম তুই খুশি হবি। তুই অনেক ব্যস্ত জানি, তবু  পুরাটা পড়ে দেখিস কিন্তু মা!’ আমি যে কোন আবেগে কাঁদছি, তা আমি নিজেই জানি না। তাই সেটা কথায় কি ভাবে প্রকাশ করব বুঝতে পারি না। বাবা ফোন রেখে দেন।

আমি চট করে একটা গুগল অনুসন্ধান করি ময়ূরাক্ষী নিয়ে যে উইকিপিডিয়া প্রতিবেদন আছে তাতে কী লেখা সেটা দেখতে। মনে ক্ষীণ সন্দেহ, সাহায্য করার নামে হয়তো ছেলেটা আমার সাদাসিধে বাবার থেকে টাকা নিয়েছে। কিন্তু না, উইকিপিডিয়ায় যা আছে তা টেনেটুনে এক-দেড় পৃষ্ঠা হবে হয়ত। বাবার প্রবন্ধ শুধু ইন্টারনেট ঘেঁটে দায়সারা টুকলি করা না। এ যে একটা বিষয়ের উপর পুরোদস্তুর গবেষণা। শেষে আবার রেফারেন্স বা তথ্যসূত্র অধ্যায়ও আছে।

নিজের নাম নিয়ে এত্ত কিছু জানার ছিল কে জানত?

ময়ূরাক্ষী নদী নিয়ে শুধু হুমায়ূন আহমেদই গল্পই লেখেন নি, ‘নদীর নাম ময়ূরাক্ষী’ কথার গানও লিখেছেন। এক সাক্ষাৎকারে ওনার স্ত্রী শাওন বলেছেন যে হুমায়ূন সেই গানটা প্রথমে লিখেছিলেন স্ত্রীর রাগ ভাঙ্গানোর জন্য ‘মান ভাঙ্গানি সঙ্গীত। ’

কিন্তু হুমায়ূন আহমেদই প্রথম এই নদী নিয়ে কল্পনা করেননি।’লালসালু'র লেখক সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ ১৯৪৫ সালে ‘নয়নচারা’ গল্পে বয়ান করেছেন কল্পনার ময়ূরাক্ষীর নদী। বাবা আবার সে গল্পের প্রথম ক’টা লাইনও তুলে দিয়েছেন-

ঘনায়মান কালো রাতে জনশুন্য প্রশস্ত রাস্তাটাকে ময়ূরাক্ষী নদী বলে কল্পনা করতে বেশ লাগে। কিন্তু মনের চরে যখন ঘুমের বন্যা আসে, তখন মনে হয় ওটা সত্যি ময়ূরাক্ষী...

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কল্পনা নয়, বাস্তবের ময়ূরাক্ষী নদীর কথা বলেছেন তার ‘তারিণী মাঝি’ গল্পে-

...আষাঢ় মাস। অম্বুবাচী উপলক্ষ্যে ফেরত যাত্রীর ভিড়ে ময়ূরাক্ষীর গনুটিয়ার ঘাটে যেন হাট বসিয়া গিয়াছিলো…

আর রবিঠাকুর কবিতা লিখেছেন-

…আমার মন বসবে না আর কোথাও,

         সব-কিছু থেকে ছুটি নিয়ে

             চলে যেতে চায় উদাস প্রাণ

                 ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে।…

শুধু শিল্প, সাহিত্য, গান, চলচ্চিত্র না, বাবার প্রবন্ধে আছে মহাভারতের ইন্দ্রের পুরাণকাহিনীর অংশ। সেখানে বর্ণনা করা আছে ময়ূরের পেখমভরা হাজার চোখের ইতিকথা। আলোচনায় আছে নদীটির উৎস, বন্যা, বাঁধ, পানি প্রকল্প, সমকালীন রাজনৈতিক তাৎপর্যের নৈর্ব্যক্তিক আলোচনা।

বাবা লিখেছেন একদম গবেষণা গ্রন্থের কায়দায়- শিরোনাম, সূচী, ভূমিকা, লিটারেচার রিভিউ, মেথোডলজি, রেজাল্ট, উপসংহারসহ নানান অধ্যায়।

শুধু শেষ অধ্যায়টা অন্যরকম। সেটা একটা চিঠির মতন। চিঠিটা আমাকে লেখা-

...তুই সব-সময় জানতে চাইতি আমি কেন হিমুর ময়ূরাক্ষীর নামে তোর নাম রেখেছি। যখন বলতাম ‘হিমু’ থেকে নামটা নেইনি, জানি তুই বিশ্বাস করতি না। হয়তো ভাবতি, তোর অশিক্ষিত বাবা হুমায়ূন আহমেদের সহজভাষার গল্পের বই ছাড়া আর কোথা থেকে এই মুখভরা নামের কথা চিন্তা করতে পারে। এও জানি, নামটা তোর পছন্দ না। না হবারই কথা। ছয়-সাত বছর বয়স হবার আগে তুই নিজের নামটা নিজেই ঠিক করে উচ্চারণ করতে পারতি না। অনেকে বলেছিল নামটা বদল করতে। হয়তো আমার উচিত ছিল তোর ছোটবেলাতেই নামটা বদলে দেয়া। কিন্তু কখনও তা করা হয়নি।

আমি নিজে না বললেও তুই নিশ্চয় জানিস যে তোর মা যখন অন্তঃসত্ত্বা তখন আমি বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। তখন বয়স কম, সবাই দায়িত্ব নিতে বলছে। কিন্তু আমি সে দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত ছিলাম না, মনে অশান্তি, কিছুই ভাল লাগে না। এটা-সেটা করে মন ভাল করার চেষ্টা করি। হাস্যকর শোনাবে এখন, সেইবার আমি মূলত প্যাড়া সন্দেশ খাবার জন্য দেওঘরে গিয়েছিলাম। তখন মিষ্টি খেতে খুব ভালবাসতাম। কয়েকবার বাড়ি পালিয়ে যশোর, নওগাঁ আর পাবনার প্যাড়া সন্দেশ খেয়ে এসেছি। কে যেন বলল, দেওঘরের প্যাড়া আরও মজা। প্রথমে জানতাম না যে দেওঘর নামের এই শহরটা ভারতে। একে ওকে জিজ্ঞাসা করে যখন জানতে পারলাম, তখন আরও যেতে ইচ্ছা হলো। দালাল ধরে বর্ডার পার হয়ে চলে গেলাম দেওঘরে।

এই দেওঘরে এসেই দেখা হল ময়ূরাক্ষী নদীর সঙ্গে। আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কেমন যেন অপার্থিব শান্তি ভর করল মনে। যখন মনের শান্তি নিয়ে ফেরত আসলাম, সব শেষ। তোর মা নেই। তোর দাদী যখন তোকে আমার কোলে এনে দিল, খুব ভয় পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল হাত গলে পড়ে যাবি। কিন্তু তোকে ভালো করে শক্ত করে ধরতেই, তুই চোখ মেলে তাকালি আমার দিকে। আমার মন থেকে হঠাৎ সব ভয় দূর হয়ে গেল, অনুভব করলাম সেই শান্তি। ময়ূরাক্ষী নদী দেখে ঠিক যেমন লেগেছিল। তোর নাম আমি রাখলাম ময়ূরাক্ষী।

...আমি তো আর কবি-সাহিত্যিক নই যে গল্প-কবিতা লিখে নিজের অনুভূতিটাকে অমর করব। তুই-ই আমার অমূল্য সৃষ্টি, তাই তোর নাম দিয়েই অমর করলাম আমার শান্তির অনুভূতিটাকে।

...তবে আজকাল ভয় হয়। যখন আমি থাকব না, তখন কার উপর তুই নাম নিয়ে রাগ করবি? তাই এই লেখা। এটা পড়ে যেন তুই তোর বাবাটাকে ক্ষমা করে দিতে পারিস। আর জানতে পারিস যে, তোর নাম শুধু মাত্র এক হিমুর কল্পনার নদীর জন্য বিখ্যাত না। শত বছর ধরে ময়ূরের চোখ নিয়ে হয়েছে পুরাণ কথা,গবেষণা। ময়ূরাক্ষী নদী অবদান রেখেছে মানুষের জীবনে, মুগ্ধ করেছে বাংলার কবি-সাহিত্যিকদের। ঠিক তেমনি, তুই আমার ময়ূরাক্ষী।

ফোনটা সুরে সুরে বাজছে। মনে হয় বাংলাদেশে ভোর হয়েছে। নিশ্চয় বাবা ফোন করছেন।

আমি কাঁদতে চাচ্ছি না। কান্না ভরা স্বর শুনলে বাবা আবার ভাববেন যে আমি খুশি হই নি। কিন্তু ঝরঝর করে আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আমি ফোনটা ধরছি না। জানি বাবা হয়তো অভিমান করছেন। ভাবছেন, মেয়েটা এত ব্যস্ত, বাবাটার জন্য একটুও সময় নেই।

লেখক পরিচিতি: কাজী প্রিয়াংকা সিলমীর জন্ম ঢাকায়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে অধ্যায়নরত।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!