মোবাইল ঘড়িতে রাত আটটা বাজে। কিছু বুঝে উঠার আগে রবি আমাকে বললো, চলেন আপনাকে বাঙালি রেস্তোরাঁয় নিয়ে যাবো রাতের খাবারের জন্য। এই লোভনীয় প্রস্তাব শুনে আমি এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম, ঘুম ভাঙানোর জন্য যতটা বিরক্ত হয়েছিলাম এখন তার থেকে কয়েক গুণ বেশি ভাল লাগছে। ফ্রেশ হয়ে রবির সঙ্গে বের হয়ে গেলাম।
রাতের মাসকট শহর। এত সুন্দর শহরের সৌন্দর্যে প্রেমে না পড়ে উপায় নেই। দুই- একবারের জন্য হলেও মনে হচ্ছিল আমি এখনো ঘুমের মধ্যে সুন্দর কোন স্বপ্ন দেখছি নাতো! আপনার কল্পনায় আপনি একটা শহরকে যেভাবে দেখতে ভালবাসবেন এই শহর যেন তেমনভাবেই সাজানো। প্রশস্ত রাস্তার দুই পাশে সারি সারি নয়নাভিরাম ল্যাম্পপোস্টের আলোয় মন হারিয়ে যায়, দিনের তপ্ত কড়া রোদের প্রখরতা ছাড়িয়ে চারদিকে এখন হিমেল হাওয়া বয়ে চলেছে ধীর গতিতে। সাই সাই করে গাড়িগুলো ছুটে চলেছে আপন গন্ত্যব্যে। এ যাত্রা যদি শেষ না হতো তবে হয়ত আমি অনন্তকাল ধরে এই পথ ধরে চলতাম গন্ত্যব্যহীন।
রবি ‘আল সিব’ নামে এক জায়গায় একটা রেস্তোরাঁর সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করালো। আমি তাকিয়ে দেখি সাইনবোর্ডে ‘সি শেল’ লেখা। উত্তরার ‘সি শেল’ এর কথা মনে পড়ে গেলো আমার। ভেতরে রিসিপশনে কথা বলে জানলাম এটা উত্তরার ‘সি শেলের’ ওমান শাখা।
আপনি যখন বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশি খাবারকে আবিষ্কার করবেন এ আবিষ্কার আপনাকে স্বর্গীয় সুখ এনে দিবে। বাংলায় লেখা খাবার তালিকায় আমি চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি। সি শেলে প্রায় সব ধরনের বাঙালি খাবারই আপনি পাবেন। খাবারের তালিকায় নানা ধরনের বিরিয়ানির নাম দেখে আমার চোখে মুখে আনন্দের ছাপ। আর রবি সেটা খেয়াল করে বলে উঠলো, আমি বলেছিলাম না এখানে সব বাঙালি খাবার পাবেন আপনি।
আমার প্রিয় এ স্বদেশী খাবার খেতে থাকলে পাকস্থলি কোন কথা শোনে না। প্রতিটি খাবারই খুব সুস্বাদু হয়েছে, অবাধ্য পাকস্থলি পুরো খাবার শেষ করতে বাধ্য করলো আমাকে। এই রেস্টুরেন্টের প্রতিটি কর্মকর্তা-কর্মচারি বাঙালি আর সবাই খুবই আন্তরিক। শুধু খাবারের বিলটা না হয় একটু অবুঝের মতো আচরণ করেছে, তাতে কী! মনতো ভরেছে।
খাবার শেষ করে হাঁটতে বের হলাম। রেস্টুরেন্টের পিছনের গলিতে অনেক লোকের সমাগম। রবি বললো এই জায়গাতে প্রতি বৃহস্পতিবার বিভিন্ন জায়গা থেকে অসংখ্য বাঙালিরা একত্রিত হয় সুখ-দুখের গল্প করতে, আনন্দকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে। পুরো ওমান জুড়ে নাকি প্রায় ৭ লাখ বাঙালির বসবাস। যদি ‘মিনিস্ট্রি অব হেলথ’ এর ভাইভা পরীক্ষায় পাশ করে এই দেশে ডাক্তারি করার সুযোগ পাই, তবে হয়ত তাদের জীবন থেকে নেওয়া গল্পগুলোর সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাবে।
রবি আমাকে ডরমিটররিতে নামিয়ে অ্যায়ারপোর্টে গেলো বাঙালি ডাক্তারদের আনতে। মধ্যরাতে কলিং বেলের শব্দে সাড়া দিয়ে দরজা খুলে দেখি তিনজন নতুন মুখ। প্রথমে যার সঙ্গে পরিচিত হলাম তিনি ডা. সিয়াম। সুঠামদেহী, হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণবন্ত, তারুণ্যদীপ্ত। দেখেই বুঝা যাচ্ছে খুব মিশুক টাইপের মানুষ উনি। পরিচিত হয়ে খুব ভাল লাগলো। দ্বিতীয় জন ডা. মারুফ; হালকা চাপদাড়ি, মুচকি হাসি, বিনয়ী ভাব, আর ফরমাল পোশাক দেখেই বোঝা যায় খুব ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ উনি। তৃতীয়জন ডা. মাশফিক। চোখে চশমা পরিপাটি পোশাক আর কথাবার্তায় ভীষণ গোছানো, পুরোপুরি একজন ছিমছাম মানুষ। ডরমিটরি যেন আজ নতুন ডাক্তারদের মিলনমেলায় পরিণত হলো।
লেখক: চিকিৎসক, রিনাইসেন্স পিএসি হাসপাতাল, ওমান
ই-মেইল: dr.mrhossain87@gmail.com
এই লেখকের আরও পড়ুন-
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |