নিশ্চয়ই মাঠের বাইরে ছিলাম। বাইরেরও বাইরে যাবার সুযোগ হয়েছে। তাই এই ক্রিকেট বিশ্বকাপের দুই ম্যাচে কেমন ছিলাম আমরা? যেমন, ছিলাম আমরা…এসব গাল-গপ্পো নিয়েই এই লেখা।
পড়েছি ব্রায়ান লারা যদি টের পেতেন- তিনি আউট, তবে আর কারও সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতেন না। সোজা সাজঘরের দিকে হাঁটা। একদম সৎ নিপাট ভদ্রলোক। তার কাছে ক্রিকেট শুধুই একটা খেলা। ক্রিকেটের সেই দিন কি আর আছে? আগেই বলেছি বিষয়টা আমাদের কাছে ভিন্ন।
লেখার এই পর্যায়ে ইহা মনে হয় মেলা।
বাংলাদেশের প্রথম দুই ম্যাচ ছিলো ওভালে। কাছাকাছি দুই ট্রেন স্টেশন ওভাল আর ভক্সোল। একটা করে ট্রেন থামে আর সমর্থকদের শরীরের সব শক্তি এক করে ‘বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ’, চিৎকার। সে চিৎকার গগনবিদারী নয় ভূ-বিদারী। শত কণ্ঠে বাঙলাদেশ পৌঁছে যায় লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে আন্ডারগ্রাউন্ডে। সেই চিৎকারে কেঁপে উঠতে দেখিছি লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড কর্মীদের।
বোন-ভাবী-ভাই-দুলাভাই-শালা-খালা-মা-দাদী-স্ত্রী-স্বামী-দুধের শিশু-বার্গারের শিশু-একা-দোকা সব্বার মেল ওভাল।
দক্ষিণ আফ্রিকার খেলার দিনের কথাই ধরুন না। এক দক্ষিণ আফ্রিকান দেশি ভাই আরেক দেশির কাছে কী চাইতে পারে?
প্রথমত কিছুই না। তারপরও বড়জোড় পানির বোতল। কিংবা একটু আধটু ফেভার। কিন্তু খালি চোখে এর কিছুই তেমন দেখিনি। কানেও শুনিনি।
কিন্তু অনেক চিৎকারের ভেতর নিজের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে- ''ভাবি আমার জন্য এক্সট্রা ডায়াপার আনছিলেন তো?"
ভাবতে পারেন ভাবি- ক্রিকেটের কতো বড়ো ফ্যান! টয়লেটে পর্যন্ত যেতে চান না!
এরকম হরেক ভাবি-আপার ভিড়ে সেরা হলেন তারাই…যারা উত্তেজনার বশে ভুলেই যান বাংলাদেশে কাদের বিপক্ষে খেলছে। শুধু তা না, প্রথম আট ওভার ব্যাটিং করার পর সেটা ঘোষণা দিয়ে জানতে চান!
একদল রমণী আপন মনে ছবি তুলেই যাচ্ছেন। উনাদের দেখে মনে হতে পারে ‘ক্রিকেট তুমি কি কেবলই ছবি!’
ভায়েরাও কম যান না। দুই সিট পেছনে একজন ব্যস্ত ধারাভাষ্যে। মুখের ভাষায় কমলালেবুর ঘ্রাণ। এক সারি নিচেই পিচ রিপোর্টার এবং জলবায়ুবিদ। মুখের ভাষায় পেয়ারার সুবাস। এতো এতো ক্রিকেটিয় বিশেষজ্ঞের ভিড়ে নিজেকে আপনার ক্রিকেটিয় অর্বাচীন মনে হলে দোষ দেবার কিছু থাকবে না।
ওভালের মাটি ফুরে যেন ভেসে উঠে ‘বাংলা’ নামের ব-দ্বীপ। যেখানে চট্টগ্রামের মানুষ বলতে থাকে দক্ষিণ আফ্রিকা আর নিউ জিল্যান্ড বাংলাদেশের সাথে 'খেলা খায়' ( খেলা খেলে)। সিলেটিরা বলে মাহমুদল্লাহ রিয়াদ শুধুই উবায় (দাড়িঁয়ে ) থাকে। তিন বছর ধরে লন্ডনে থাকা সবুর ভাযের ছোট্ট মেয়ে বলে উঠে- 'বোতলের মুখটা খুলে দাও বিগ হেল্প হবে'।
এই শত শত বাঙালির মাঝে বসে আপনার মনে হতে পারে , বাঙালি কী বেশি ভালোবাসে! ক্রিকেট নাকি নিজের দেশ?
আমি ভেজাল ভালো পাই না। তাই নির্ভেজাল ভাষায় বলতে চাই, দুটোর কোনটাই না। এরা ভালোবাসে নিজের চেহারা।
নিজের চেহারাখানা একবার স্ক্রিনে দেখা যাবে। ব্যস এই আশায় সাদা চামড়ার ক্যামেরাম্যানকে বাঙালি নিজের মায়ের ব্রাদারহুড বর্গা দেয়।
ক্যামেরাম্যান দেখলেই ‘মামা’, ‘মামা’, ডেকে পেছন পেছন দৌড়।
এক ক্যামেরাম্যানকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মামা’ ডাক কেমন লাগছে?
- একটু কনফিউজড। আমি তো ছেলে আমাকে মাম্মা ডাকছে কেন? আমি বড়জোড় পাপা হতে পারি।
আমি বোঝাই, ‘মামা’ মানে তুমি তাদের মায়ের ভাই।
- ওরে বাবা তোমাদের দেশে তো আমি কোনদিনও যাইনি। তারপরও আমার এতো এতো বোন। আর কিছু কিছু বোনের ছেলে তো আমার বাবার চেয়েও বয়সে বড়। যাক শেষমেষ নিজের কাজ নিয়ে গর্ব করার মতো একটা কারণ তো পাওয়া গেলো। আই অ্যাম দ্য মামা অব বেঙ্গালিস।
তবে বিদেশি দর্শকরাও কম যান না। এক নিউ জিল্যান্ড দর্শক আর পাকিস্তানি দর্শক। তাদের মাথাতেও আমাকে টিভিতে দেখাও ভূত। পাকিস্তানি অনেক চেষ্টা করেও বাংলাদেশের পতাকা কিনতে পারেনি। পেয়েছে নিউ জিল্যান্ডের পতাকা। আমি বললাম- আইডিয়া খারাপ না। নিউ জিল্যান্ডের ফ্যান তো কম। তোমাকে দেখাবেই। হলোও তাই এই দুই দর্শকের কল্যাণে আমি নিজেও টিভিতে...
শুধুই ক্রিকেট। তাই দেশ থেকে বিদেশে। বিলেতে। এমন বাঙালি পাওয়া যাবে ভুরিভুরি। এই পর্যায়ে খেলাকে মনে হবে হারানো মানুষের আসর কিংবা ঈদের আগের বা পরের পুনর্মিলনী। আমরা যারা করে খাই- এমন অতিথি'র ডরে একটু আধটু সরে যাই।
বিশ্বকাপের আগে আগেই অফিসের কাজের চাপ বেড়ে যায়। এখানে সেখানে অফিসের কাজে ট্যুরে যেতে হয়। কিন্তু গ্যালারির ত্রিশ গজের ভেতর দেখা হয়ে যায় ঠিকই। সেই সব চেনা দেশি মুখ। এই সব চেনা মুখের সাথে আবার একবারের বেশি দুইবার দেখা করার সুযোগ নেই। কারণ অর্থ বিভ্রাট। ওভালে নগদ কোনও কারবার নাই। সবই ডেবিট কিংবা ক্রেডিট কার্ডে। ৫০ পেন্সের চিপস (ডোবা তেলে আলু ভাজা) কিনতে ছোঁয়াতে হয় চার পাউন্ড। ১ পাউন্ডের পিৎজার জন্য ছোঁয়াতে হয় তের পাউন্ড। এসব কিনতে দেশি প্রিয় মুখের একমাত্র ভরসা আপনি। আসলে আপনার পকেটে থাকা ক্রেডিট কিংবা ডেবিট কার্ড।
কে হায় পকেট খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে? তাই প্রিয়মুখ থাক থাক নিজ মনে দূরেতে, আমি গাই- বাঁচাও পকেট সুরেতে।
এই পর্যায়ে নিজেকে মনে হবে কিপ্টা বোলার। একদমই রান মানে পয়সা দেয়া যাবে না।
ক্রিকেট আমাদের বিশ্বায়িত করেছে ঠিকই। কিন্ত বিশ্বজনীন বা গ্লোবাল করেছে কি?
ওভালে এই প্রশ্নের সহজ কোন উত্তর খুঁজে পাইনি। লন্ডনে অনেক দক্ষিণ আফ্রিকান মানুষ আছে। খেলার দিন সেই দেশের সমর্থকদের বাপ-বাপান্ত-মা-মামান্ত করছিলো বাংলাদেশের সমর্থকরা। ওরা নিশ্চুপ। কারণ যারা মা-বাবা নামাচ্ছেন তাদের বয়স ১৩ কি ১৪।
দক্ষিণ আফ্রিকানরা আদতে ছিলো খানিকটা উল্টো। উপস্থাপক লন্ডনে থাকেন এমন এক দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট কোচ বাবার কাছে জানতে চাইলেন- দক্ষিণ আফ্রিকা জিতবে?
-অবশ্যই। আমরা খুব ভালো দল।।
সেই বাবার প্রায় সাত আট বছরের পুঁচকে কে জিজ্ঞেস করা হলো, আফ্রিকা জিতবে?
পুঁচকের উত্তর - মে বি।
এটাই সহজ সরল বিনয়। এই বিনয়ের ধারে নিউ জিল্যান্ড'র সমর্থক আমাকে বললো-
কাল অফিস যাবে না?
- যাবো।
এক কাজ করো সিক লিভ নিয়ে নাও। আজকের খেলায় হেরে তো তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে।
এতটুকুই খোঁচাখুঁচি। বাকিটা জীবনের গল্প। মসজিদে খুন হয়ে যাওয়া মানুষের গল্প। কেমন করে নিউ জিল্যান্ড আরো বেশি বেশি মানুষ ভালোবাসছে সেই সব গল্প। কি করে ধর্ম-বর্ণ-মানবতার কাছে হেরে গেল- সেই গল্প।
হাড়ির ভাত সেদ্ধ হলো কিনা তা জানতে গোটা হাড়ি সুদ্ধ ভাত তো আর টেপা সম্ভব না। তেমনি এমন একটা-দুটো মানুষ দিয়েই মানুষ গোটা একটা জাতিকে চিনতে চেষ্টা করবে । এমনটাই হয়তো স্বাভাবিক।
তেমনি গোটা বাঙলাদেশ তো আর খেলা দেখতে বিলাত আসতে পারবে না। কেউ কেউ আসবে। এসেছেন। এদের কেউ কেউ আবার এই দেশেরই স্থায়ী বাসিন্দা। এই কেউ কেউদের বলছি- দয়া করে মূত্র বিসর্জন করতে গিয়ে ভদ্র হবেন। নিজের পিতৃপ্রদত্ত প্রত্যঙ্গে টিস্যুখানা ছোঁয়াবার পর পবিত্র সেই টিস্যুখানা ইউরেনালে ফেলবেন না। ইউরেনালে টিস্যু ফেলে ফেলে টয়েলেটের কি দশা আমরা করেছিলাম..তা নিশ্চয়ই আপনিও দেখেছেন। টয়লেট ক্লিনার হিসাবে অনেক বাঙালিও কিন্ত ওভালে কাজ করেন।
হরভাজন সিং অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসকে মাংকি বা বান্দর ডেকে ছিলেন। এটা যদি হয় বর্ণবাদ, নির্জলা অন্যায়, জঘন্যতম কাজ- তবে দক্ষিণ আফ্রিকান খেলোয়াড় ভ্যান ডার দুসেন-কে গ্যালারি থেকে ‘বান্দর ডুসেন’ ডাকাও অন্যায়। গ্যালারিকে ময়লা বোঝাই করে ফেলাও অন্যায়।
গালি-গালাজ করা ছাড়া খেলা দেখতে… নির্দিষ্ট জায়গায় ময়লা ফেলতে… ভিনদেশিদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে… নিজের ভেতর ক্রিকেট স্পিরিট ধরে রাখতে আমাদের প্রত্যেক কে কি ব্রায়ান চার্লস লারা হতে হবে? কি মনে হয়?
লেখক:
গবেষণা আর লেখালেখির চেষ্টা করেন ।
ছবি: রিনভি তুষার, স্যাম ম্যাকেঞ্জি, মাহামুদুল হাসান হীরা।
লেখকের ইমেইল : kurchiphool@gmail.com
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |