আমি তখন ইউরোপে গবেষণার কাজে বাস করছি। হঠাৎ আমার গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক এক সুখবর দিতে আসলেন। বললেন আমরা খুব শিগগিরই জেনিভা যাচ্ছি। শুনে তো আমি মহাখুশি। কত বার চেয়েছি যেতে কিন্তু সম্ভব হয়নি বিভিন্ন কারণে। তাই বেশ পুলকিত ছিলাম।
প্রতি দুই বছর পর পর ইউরোপিয়ান মাইক্রোফিনান্স রিসার্চ কনফারেন্স হয় ইউরোপের কোনও এক দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেবার হয়েছিল সুইজারল্যান্ডের জেনিভা শহরের জেনিভা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে একজন রিসার্চ স্কলার হিসেবে আমার গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করবো ভেবেই আনন্দ লাগছিল। যাই হোক, কয়েকজন প্রফেসর আর আমরা কিছু ছাত্র মিলে বেলজিয়ামের ব্রাসেলস থেকে ব্রাসেলস এয়ারলাইন্স এ জেনিভার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । মাত্র সোয়া ঘণ্টার পথ। অনেকটা যেন বিমানে উঠে বসতে বসতেই বিমানের জানালা দিয়ে জেনিভা লেইক চোখে পড়লো।
জেনিভার অনেক গল্প শুনেছি কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে গল্পের চেয়েও সুন্দর জেনিভা। পাহাড়, হ্রদ দিয়ে ঘেরা জেনিভার আবেদন সব সময়ই আকর্ষণীয়। জেনিভাতে ২ লাখের কিছু বেশি লোকের বসবাস ।
কনফারেন্সের প্রথম দিন বিকেল বেলা জেনিভা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যখন আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে জেনিভা লেইকে বেড়াতে বের হয়েছি ঠিক তখনি তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। তারপর বৃষ্টি কিছুটা কমলে আমরা ঠিক সন্ধ্যার একটু আগে লেইকের পাড়ে গিয়ে পৌঁছি।
জাতিসংঘের অফিস এলাকায় একটি ভাঙা চেয়ার দাঁড়িয়ে আছে যার তিনটি পা আছে কিন্তু একটি পা ভাঙা। হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনাল ভূমি মাইন আর গুচ্ছ বোমার শিকার লোকের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই ভাঙা চেয়ার এখানে স্থাপন করে যাতে করে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এই প্রতিবাদের ভাষা জানতে পারে।
জেনিভা ফ্রান্সের কাছাকাছি হওয়াতে লোকজন ফরাসী ভাষাতেই বেশি কথা বলে। রাস্তার আশপাশে হরেকরকমের খাবারের দোকান। আমরা কনফারেন্স শেষ হওয়ার পর পাহাড়ের মতো উঁচু একটা রেস্তোরাঁতে গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে নেই। খাবারে তালিকায় ছিল আলুর চিপস, মুরগি আর সালাদ। সাধারণ খাবার হলেও মজাদার ও অসাধারণ উপস্থাপনার কারণে অনেক ভালো লেগেছিল।
লেইক জেনিভা হচ্ছে জেনিভাবাসীর প্রাণ। লেইক এর পাশেই যত রেস্তোরাঁ, স্থানীয় বা পর্যটক যাই বলুন না কেন, মানুষজন দিন রাত এখানে বসেই আড্ডা দিচ্ছে। লেকে আপনি স্কুবা ড্রাইভ করতে পারেন। চাইলে গোসল সেরে নিতে পারেন। তবে সেটা গ্রীষ্মকালে হলেই ভালো! আমাদের একদিন ডিনার পার্টি ছিল লেইক জেনিভার ভাসমান জাহাজে। অসাধারণ স্মৃতিময় সেই অভিজ্ঞতা। আমরা সবাই যার যার মতো গল্পে মেতে উঠি দেশ নিয়ে, গবেষণা নিয়ে, খাবার নিয়ে। প্রায় ৩ ঘণ্টার এই অবস্থানের সময় আমরা লেইক থেকেই জেনিভার আল্পস পর্বতমালা দেখে নেই। অনেক স্বাদের খাবার দিয়ে আমরা রাতের ডিনার সেরেছিলাম তবে ডেজার্ট এর স্বাদ ছিল অনেক মজার। এক বাংলাদেশি ভাই ক্যাটারিং করছিলেন তার সাথে কথা বলে বাংলাদেশের মানুষ জেনিভাতে কেমন আছে তা জেনে নিলাম।
জেনিভার ওয়াটার জেট একটা অসাধারণ ল্যান্ডমার্ক। এটি রাতের বেলা যখন আশেপাশের আলো জ্বলে উঠে তখন দেখতে অসাধারণ লাগে । ওয়াটার জেট থেকে প্রায় ৪৫০ ফুট উপরে পানি উঠে। এইখানে মূলত পর্যটকরা একটা ছবি নিতে ভোলেন না।
আমার ইউরোপিয়ান, বাংলাদেশি, আইরিশ, পর্তুগাল, ইথিওপিয়া, মেক্সিকো আর আমেরিকার বন্ধুদের সাথে অনেকদিন পর প্রাণ খুলে কথা বলে নিলাম। তবে প্রায় ৪০ টির বেশি দেশের ডেলিগেট উপস্থিত থাকাতে অনেক দেশের লোকজনের সাথে পরিচয় হলো, আবার কারও সাথে বন্ধুত্বও হয়ে গেল।
তবে বেড়ানোর সময় একটু বেশি পেলে আরও ভালো লাগতো। বরফের সাথে খেলতে পারার মজা একটু বেশিই নেওয়া যেত!
লেখক: পর্যটক ও গবেষক
ইমেইল: debashisemp@gmail.com
এই লেখকের অন্যান্য লেখা
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |