এর পেছনে কিছু কারণও রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বাংলাদেশি অভিবাসীদের কঠোর পরিশ্রম, আন্তরিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার সুনাম নতুন করে কিছু নয়, কাতারও এর মধ্যে ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক-অতীতে প্রশংসার পাশাপাশি অন্যান্য দেশের নাগরিকদের তুলনায় বাংলাদেশিদের কাতারে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে চলেছে। কাতার কর্তৃপক্ষের কাছে এটি একটি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাদক সম্পর্কিত অপরাধ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। অন্যদিকে কথায় কথায় মারামারি, ছুরিকাঘাতের ঘটনা নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রসঙ্গত, পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর সারিতে থাকার পাশাপাশি কাতার পৃথিবীর অন্যতম শান্তিময় দেশের একটি।
বাংলাদেশিদের বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পেছনের কারণটি সম্ভবত ‘ফ্রি-ভিসা’। কাতারের ‘ফ্রি-ভিসা’ ধরনটি এমন যাতে কোনও চাকরি, বাসস্থান, ভিসা লাগানো, ভিসা নবায়ন, বিদ্যুৎ-পানি বিল, চিকিৎসা, আসা-যাওয়ার বিমান ভাড়াসহ সামগ্রিক দায়ভার নিজেকেই গ্রহণ করতে হবে। কাতারের কোনও কোম্পানি, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি এই দায়ভার নেবে না। আর ‘ফ্রি-ভিসা’ অন্যান্য দেশের নাগরিকের ক্ষেত্রে নামমাত্র মূল্যে হলেও কেবল বাংলাদেশিরাই আকাশচুম্বী মূল্য দিয়ে এসব ভিসা কিনে থাকেন। পরিণামে হাজার হাজার লোক কাতারে এসে চাকরি না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করেন।
কাতারের বাণিজ্যিক অঞ্চল নাজমায়, বিশেষত সুক-আল-হারাজ এলাকার প্রবেশপথে গাড়ির গতিরোধ করে কাজ খোঁজা বাংলাদেশিদের গাড়ির উপর ঝাঁপিয়ে পড়া কাতারিদের কাছে খুবই বিব্রতকর। এতে জাতিগতভাবেও আমরা অন্যান্য বিদেশিদের কাছে হেয় হয়ে যাই।
বাংলাদেশের মানুষের গড় মাথাপিছু বার্ষিক আয় এখন এক হাজার ৪৬৬ ডলার বা এক লাখ ২৩ হাজার ৭১০ টাকার সমতুল্য। সেই দেশের একজন নাগরিক যখন অনিশ্চিত চাকরির খোঁজে ৫-৬ লাখ টাকা খরচ করে কাতার পাড়ি জমান, তখন তাদেরকে গরীব কিংবা খেটে খাওয়া মানুষ আখ্যায়িত করা কঠিন হয়ে পড়ে। বরং তাদেরকে টাকা কামানোর প্রতিযোগিতায় অস্থির কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হয়।
অর্থোপার্জনের জন্য শুধু আমরা একলা নই, অন্যান্য দেশের নাগরিকরাও এসেছেন। মুদ্রা বিনিময় হারে বাংলাদেশি টাকা শক্তিশালী অবস্থানে। এক কাতারি রিয়াল (মুদ্রা) বাংলাদেশি ২৩ টাকার সমান। অন্যদিকে, তুলনামূলকভাবে এক কাতারি রিয়াল নেপালি সাড়ে ৩০ রুপির, পাকিস্তানি প্রায় ৩৯ রুপির এবং শ্রীলঙ্কান প্রায় ৪৮ রুপির সমান। সেই বিবেচনায় ওইসব দেশের নাগরিকদের অর্থোপার্জনের জন্য তাদের আরও মরিয়া হয়ে ওঠা যৌক্তিক ছিল। কিন্তু কাজের জন্য কাতারের কোথাও কোনও রাস্তায় দাঁড়িয়ে, নির্দিষ্ট কোনও জায়গায় সমবেত হয়ে, মানুষ বেঁচার বাজার বসিয়ে, গাড়ির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, গাড়ির গতিরোধ করে অন্য দেশের নাগরিকদের শ্রম বিক্রি করতে দেখা যায় না। আমাদের এসব বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে।
এদেশের বিদ্যমান আইন ভঙ্গ করে কোনও অবৈধ বসবাসকারী, ব্যবসায়ী বা শ্রমিকের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নিলে সেখানে দূতাবাসের হস্তক্ষেপের অবকাশ থাকে না। কিন্তু ব্যাপারটি যদি এমন হয় যে শুধু বাংলাদেশিদের টার্গেট করে এ ধরনের কার্যক্রম চালানো হয়, তাহলে আমার মতে বিষয়টি নিয়ে কাতারে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা।
কাতারে প্রতিনিধিত্বকারী দূতাবাসই এদেশে একমাত্র বাংলাদেশি সরকারি মিশন। কাতারের বাংলাদেশ দূতাবাস বিষয়টির গভীরতা ও দুর্দশার কথা মাথায় রেখে স্বপ্রণোদিত হয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে দৃশ্যমান ও ফলপ্রসূ আলোচনা করতে পারতো। ইতোমধ্যে বিসিকিউ এবং বিএফকিউ এর মতো সংগঠন- যাদের পদচারণা শুরু হয়েছিল কাতারে বাংলাদেশিদের সার্বিক দেখভাল, কল্যাণ ও মঙ্গলসাধনের স্লোগানে, তারাও কিছু দৃশ্যমান ভূমিকা নিতে পারতো। কিন্তু তা হয়নি। প্রবাসে দূতাবাস অথবা বিভিন্ন সংগঠনের আয়োজনে পাঁচতারা হোটেলে বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালনের মাধ্যমে ততোক্ষণ পর্যন্ত জাতিসত্তার ভাবমূর্তি বিকশিত করবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের নাগরিকদের প্রতি যথোচিত সাহায্য-সহযোগিতা, সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত না হয়।
এমন এক পরিস্থিতে দূতাবাস যথাযথ কূটনীতিক হস্তক্ষেপ করবে_ এমন ভাবাটাই স্বাভাবিক। কূটনৈতিক দরকষাকষির জায়গায় আমরা এখনো ততটা সবল নই। হয়তো এ কারণে প্রায়ই চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা মোকাবেলা না করে, বরং এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতাই সবসময় লক্ষ্য করা হয়। এবার যেন ব্যতিক্রম কিছু হয়।
কাতারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আসুদ আহমেদের মেয়াদকাল প্রায় শেষ, খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কাতার ত্যাগ করবেন। বর্তমান রাষ্ট্রদূতের বিদায় এবং নতুন রাষ্ট্রদূত আগমনের মধ্যকার ফাঁকা সময়টা যেন আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতার কাল হিসেবে চিহ্নিত না হয়। যেকোনও পরিস্থিতিতেই কাতারের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষগুলো আমাদের নাগরিক, বাংলাদেশি পাসপোর্ট ধারক!
বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের যে কোনও দূতালয় এলিট-শ্রেণির পাশাপাশি কায়িক-শ্রেণির প্রবাসীদের জন্যও আশার কিরণ ও শেষ আশ্রয়ালয়ে পরিণত হোক, এই প্রত্যাশা।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ লেখক-সাংবাদিক অ্যাসোসিয়েশন, কাতার।
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |