বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে ফ্রাঙ্কফুর্টের অনুষ্ঠান ও কিছু টুকরো গল্প

বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন জার্মানি (নিবন্ধিত সমিতি) এক চমৎকার অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ১৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে। জার্মান ভাষায় এই সমিতির নাম লেখা হয়, Bongobondhu Foundation Germany e.v । শেষের এই ই.ভি এর বিস্তার করলে দাঁড়ায় ‘আইঙ্গেত্রাগেনে ফেরআইন’ অর্থাৎ নিবন্ধিত সমিতি।

মমতাজুল ফেরদৌস জোয়ার্দারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 March 2019, 02:50 PM
Updated : 19 March 2019, 02:50 PM

ফ্রাঙ্কফুর্টের ফ্রিটস বাওয়ার হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রিত অতিথি ছিলাম আমি। ফ্রাঙ্কফুর্টের প্রধান রেল স্টেশন থেকে এই হল এর দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার। ফ্রাঙ্কফুর্ট প্রধান রেল স্টেশনের ১০৪ নম্বর প্লাটফর্ম থেকে যে কোনও ট্রেনে উঠে পরবর্তী স্টেশনে নেমে গেলেই এই হলে পৌঁছে যাওয়া যাবে।

যে কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছে, সেখানকার সবচেয়ে বড় হলটি-ই আসলে ফ্রিটস বাওয়ার হল। যার ভাড়া ৩ হাজার ইউরো বা বাংলাদেশি টাকায় ৩ লাখ টাকার মতো।

কিন্তু আয়োজক সংগঠন বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন, জার্মানির সভাপতি মাহফুজ ফারুক আমাকে জানালেন, এখানে অনুষ্ঠানের জন্য তাদের কেবল ৫০০ ইউরো খরচ দিতে হচ্ছে। সংগঠনের নিবন্ধন থাকায় সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় বাকি ব্যয় বহন করছে।

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের অনুষ্ঠানটা চার পর্বের ছিল। প্রথমে বঙ্গবন্ধুর উপর বিভিন্ন ভিডিওচিত্র দেখানো হয়। এই অংশটুকু পরিচালনা করেন সাংগঠনিক সম্পাদক ফরিদ হোসেন শিহাব। দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা সভা ছিল। এখানে দেখলাম বেশ কিছু তরুণ নেতাকর্মীকে বক্তব্য রাখার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এক্ষেত্রে সংগঠনের সভাপতি আমাকে বলেছেন, যে তারা নতুন নেতৃত্ব তৈরি করার জন্য, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে এবং নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করার তাগিদে এই ব্যবস্থা রেখেছেন।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি মাহফুজ ফারুক। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জার্মান আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এবং সর্ব ইউরোপীয় আওয়ামী লীগের সাবেক কর্ণধার অনিল দাস গুপ্ত। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগের সাবেক পরিচালক এবং এই সংগঠনের উপদেষ্টা নাজমুন নেছা পিয়ারী।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব উপস্থাপন করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম খালেদ। অনুষ্ঠানের তৃতীয় পর্বে শিশুদের অনুষ্ঠানগুলো সঞ্চালনা করেন শান্তা গ্রামুলা। আর অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক হ্যাপি উদ্দিন। তিনজনই চমৎকার অনুষ্ঠান উপস্থাপন করেছেন।

হ্যাপি উদ্দিনের পরিচালনায় মনোমুগ্ধকর সংগীত পরিবেশন করেন অংকিতা সর্মা, যারা উদ্দিন, মিনহাজ দ্বীপন, রিয়েল আনোয়ার, ইনামুল হক, শিরিন আলম, নিম্মী কাদের, আবৃত্তিতে অংশ নেন হাফিজুর রহমান আলম ও মায়েদুল ইসলাম তালুকদার।

এ অনুষ্ঠানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার সমাগম হয়েছিল। প্রায় ছয় বা সাত জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন- নাজমুন নেছা পিয়ারী, মাহফুজ ফারুক, অনিল দাস গুপ্ত, খসরু খান, মহসিন হায়দার মনি, হাফিজুর রহমান আলম, মাবু জাফর স্বপন,  বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন জার্মানির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সাইফুল সোহেল, যুগ্ম সম্পাদক কাজী আসিফ হোসেন দীপ, শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক সজন চক্রবর্তী, আব্দুল ওয়াদুদ, জাহিদুল ইসলাম পুলক এবং জালাল আবেদীন।

অনুষ্ঠানে আমি নিজেও একজন বক্তা ছিলাম। আমি অবশ্য আমার বক্তব্যে ১৭ মার্চ পালনের চেয়ে ৭ মার্চ পালনেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছি।

অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে এবং ফাঁকে ফাঁকে আমি বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলেছি। অনিলদার সাথে আমার অনেকক্ষণ আলাপ হয়েছে। উনার কাছে কয়েকটা বিরল আলোকচিত্র দেখলাম। তারপর পুরনো পত্রিকার কপিও দেখলাম। কথা প্রসঙ্গে জানালাম আমি বঙ্গবন্ধুর উপরে লেখালেখি করি, শুনে খুব খুশি হয়ে বলেন- যে লেখালেখি খুব জরুরি। তোমরা বঙ্গবন্ধুর উপরে লেখালেখি অব্যাহত রাখবে।

এছাড়াও বিভিন্ন উপদেশ দিয়েছেন।

যেসব বাচ্চারা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিল এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যে সব শিল্পীরা অংশ নিয়েছেন তাদের প্রত্যেককে উপহার দেন প্রধান অতিথি। বিদেশে থেকেও বাচ্চারা যেভাবে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে এটা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আমি ব্যক্তিগতভাবে অভিভূত।

ক্ষুদে শিল্পীদের মধ্যে ছিল- নাফিসা, মিলিয়া, নিদি, সাদিকা, আয়েশা। বিভিন্ন শিল্পীরাও চমৎকার সংগীত পরিবেশন করেছেন। জার্মানিতে আমি দ্বিতীয়বার কোনও অনুষ্ঠানে সরাসরি লালন গীতি শুনলাম। আমি লালন গীতির ভক্ত। ১৯৯৪ সালে যখন বুজবুর্গে ছিলাম তখন আমার বোনের বান্ধবী কুষ্টিয়ার শিল্পী মেহেরুন আপা এক অনুষ্ঠানে লালনগীতি পরিবেশন করেছিলেন, সেখানে আমি ছিলাম। আর প্রায় ২৫ বছর পর আবার কাল লালন গীতি শুনলাম।

জার্মানিতে অ-নিবন্ধিত ভাবে আর একটা বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন আছে। আমি সভাপতি মাহফুজ ভাইকে বলি  যে- আপনারা বঙ্গবন্ধু নীতি আদর্শ নিয়ে কথা বলছেন, কাজ করছেন আন্তরিকতার সঙ্গে, এখানে যদি দুইটা সংগঠন থাকে তাহলে কী জনগণের ভুল বার্তা পাঠানো হয় না? এটা ঠিক করা যায় না কোনওভাবে?

উত্তরে উনি বলেন, “দেখেন আমি ওই অংশের সভাপতিকে জানিয়েছি আমরা একত্রে বসতে পারি। কথা বলতে পারি আমাদের মধ্যে সমস্যাগুলা মিটিয়ে ফেলতে পারি।

তখন আমি উনাকে আবারও প্রশ্ন করি যে উনি তো এখন একাংশের সভাপতি হয়ে আছেন। উনি যদি এখানে আসেন তাহলে স্বাভাবিকভাবেই উনার সভাপতির পদ ধরে রাখতে চাইবেন। সেটা আপনি কিভাবে দেখবেন?

তখন মাহফুজ ফারুক আমাকে বলেন, “উনি যদি সভাপতি হতে চান উনি সভাপতি হবেন আমার কোনও আপত্তি নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটাররা যদি উনাকে ভোট দিয়ে সভাপতি নির্বাচিত করেন আমাদের কারো কোনও আপত্তি থাকবে না। আমি আজীবন বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের নেতৃত্ব দিতে চাই না এবং আমি আপনাকে আগেই বলেছি যে আমি নতুন নেতৃত্ব তৈরি করছি। আমরা কেউ চিরস্থায়ী না, এজন্যই তাদের কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছি। তাদের কাজের মধ্যে আমি কোনও কিছুতে নাক গলাতে যাইনি।”

সুদূর প্রবাসের এই অনুষ্ঠানে জনসমাগম হয়েছিল প্রচুর। তবে অনুষ্ঠানটা রোববার না হয়ে শনিবার হলে নিঃসন্দেহে আরো বেশি অতিথির উপস্থিতি থাকতো। কারণ সোমবার দিন বাচ্চাদের স্কুল এবং অনেকের কাজ থাকার কারণে রোববারে সন্ধ্যায় কোনও অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা কঠিন। এই দিন ফ্রাঙ্কফুর্টের আবহাওয়া খুবই খারাপ ছিল, যদিও অনুষ্ঠান শুরুর আগ দিয়ে আবহাওয়া কিছুটা ভালো হয়।

এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হয়ে আসার কথা ছিল আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফের। হঠাৎ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় উনি বর্তমানে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। এ কারণে জার্মানিতে আসতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। তবে টেলি-কনফারেন্সের মাধ্যমে উনি বক্তব্য দিয়েছেন অনুষ্ঠান চলাকালীন। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন এর কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম ঠান্ডু টেলি-কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তব্য দেন। তিনি বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের এই কমিটির কার্যক্রম এর প্রশংসা করে তাদের বঙ্গবন্ধু্র নীতি-আদর্শে কার্যক্রম অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান।

অনুষ্ঠানের ফাঁকে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান এর সাথে আমার আলাপের সময় উনি জানান কীভাবে যশোর শত্রু মুক্ত হয়েছিল ৬ ডিসেম্বর। যশোরের কনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মান্নান সাহেব একজন। উনি তখন এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। যখন কলকাতায় খবর পৌঁছায় যশোর শত্রু-মুক্ত হয়েছে তখন প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদ যশোর টাউন হলের মাঠে এসে নামেন। সেই সময় মিত্র বাহিনীর কর্নেল মনিন্দ্র সিং, তোফায়েল আহমেদ ও আব্দুর রাজ্জাককে সালাম দিয়ে অভ্যর্থনা জানান। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান তখন তার রাইফেলটা ফেলে তোফায়েল আহমেদকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন। তোফায়েল আহমেদ উনাকে সান্ত্বনা দেন কান্নাকাটি না করার জন্য। সেদিন এই দুই নেতা আনুমানিক ১৫ থেকে ২০মিনিটের মত সেখানে ছিলেন। তারপর তারা আবার হেলিকপ্টারে কলকাতা ফিরে যান। ৬ তারিখের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা মান্নান ৩ জন সহযোদ্ধাকে হারিয়েছিলেন।

অনুষ্ঠানের ফাঁকে গল্প করতে গিয়ে নাজমুন নেছা পিয়ারী আমাদেরকে কিছু অজানা তথ্য দেন। তা হলো দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রয়াত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী যে সময় জার্মানিতে রাষ্ট্রদূত হয়ে আসেন তখন জার্মানির চ্যান্সেলর ছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ভিলি ব্রান্ড(তাকে আমরা উইলি ব্র্যান্ড বলে থাকি)। তিনি এক অনুষ্ঠানে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন- “তোমার দেশ তো স্বাধীন হয়ে গেল তুমি কি চাও, বল তোমার জন্য আর কি করতে পারি?

তখন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তাকে বলেছিলেন- “দেখুন আমার দেশের এত মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে, আপনাদের একটা রেডিও সেন্টার আছে যেটাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার হয়। সেখানে হিন্দিতে অনুষ্ঠান প্রচার হয়, উর্দুতে অনুষ্ঠান প্রচার হয়, কিন্তু বাংলা ভাষার কোন অনুষ্ঠান নেই। বঙ্গবন্ধু আমাদের ভাষা সংস্কৃতিকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। একটা বাংলা বিভাগ যদি চালু করা যায় তাহলে তার স্বপ্ন পূরণ হবে।”

তখন তাড়াহুড়ো করে ডয়চে ভেলে এশিয়া বিভাগ উৎসাহিত হয়ে বাংলা বিভাগ চালু করে এবং দেশ থেকে তারা নির্বাচন করে কিছু কর্মী নিয়ে আসে। সেই সময়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পিয়ারী আপাকেও জার্মানিতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান শেষে নৈশ ভোজের ব্যবস্থা ছিল। নৈশ ভোজ সেরে আমি জার্মান আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের নেত্রী স্নিগ্ধা বুলবুলের সাথে দুটো ছবি তুলে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

এই অনুষ্ঠানের একটা দিক আমার খুব ভাল লেগেছে যে প্রস্তাবিত সময়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে এবং শেষ হয়েছে। অহেতুক কোনও বিলম্ব করা হয়নি, যা বাঙ্গালির কোন অনুষ্ঠানে বিরল।

সিনহা দাদা উনি একজন মনিপুরী, আমাকে রেল স্টেশনে পৌঁছে দিলেন। খুবই আন্তরিক মানুষ তিনি। মনে একটা প্রশান্তি নিয়ে নিজ শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। জার্মানিতে এত বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং সফল অনুষ্ঠান আমি বাঙ্গালিদের করতে দেখিনি।

ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক

লেখক: তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন, জার্মানি।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!