প্রবাসীর ভ্রমণ: দশ আঙুলের ছাপ দিয়ে চীনে প্রবেশ

গত বছর ইন্দোনেশিয়া বেড়ানোর জন্য ইন্টারনেটে যখন ফ্লাইটের খোঁজ করছিলাম, দেখলাম সবচেয়ে সস্তা বিমান ‘চায়না সাউদার্ন অ্যায়ারলাইন্স’ এর টিকেট। সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না চীনের বিমানে চড়ব কিনা! অমূল্যবান, এটা বোঝানোর জন্য ‘মেইড ইন চায়না’ এ কথাটি ব্যবহার হয় এ এলাকায়।

নাঈম হাবিব, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 March 2019, 05:46 AM
Updated : 17 March 2019, 05:46 AM

অন্য বিমানের টিকিট-মূল্য যেহেতু অনেক বেশি তাই সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম এবার চড়েই যাবো চীনের বিমানে। টিকেট কিনলাম জার্মানি থেকে চীনের গুয়াংজু হয়ে ব্যাংকক। ইন্দোনেশিয়া ঘুরে ফেরার পথে টিকিট ছিল বালি থেকে গুয়াংজু হয়ে জার্মানি। ট্রানজিট পয়েন্ট গুয়াংজু বিমানবন্দর। ট্রানজিট সময় বা স্টপওভার সময় ছিলো আঠারো ঘণ্টা। যাবার সময় ট্রানজিট সময় কয়েক ঘণ্টার ছিল মাত্র। ফিরতি পথে আঠারো ঘণ্টা কী করে বিমানবন্দরে কাটাব সেটা ছিল বিরাট চিন্তার বিষয়।

ইন্টারনেট ঘেটে জানতে পারলাম যদি শেষ গন্তব্যের টিকিট হাতে থাকে আর সেটা যদি একটি নির্ধারিত সময়ের ভেতরে হয়ে থাকে তাহলে গুয়াংজু বিমানবন্দরে চব্বিশ ও বাহাত্তর ঘণ্টার ট্রানজিট ভিসার আবেদন করা যাবে এবং এই ভিসা ব্যবহার করে নাকি চীনেও ঘুরে আসা যাবে। ব্যাপারটাকে মেঘ না চাইতে বৃষ্টিই ধরলাম আমি। কিন্তু আমি সবুজ পাসপোর্টধারী আরও অনেক কিছু জানতে হবে আমাকে। ইস, আমাদের পাসপোর্টে যদি সবুজের মাঝে লাল, মানে ওই লাল বৃত্তটি ছাপা হতো তাহলে কতো সুন্দরই না লাগত। সম্মানিত কর্তৃপক্ষ দয়া করে ব্যাপারটি একটু ভেবে দেখবেন।  

সবুজ পাসপোর্টধারী বা বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীরা চীনের গুয়াংজু বিমানবন্দরে ট্রানজিট ভিসার আবেদন করতে পারেন কিনা বা ভিসা গ্রান্টেট হবে কিনা ইন্টারনেট তন্ন তন্ন করে খুঁজেও এর কোনো উত্তর পেলাম না। ইতিমধ্যে আমরা সবাই হয়তো জেনে গেছি কিছু শর্তসাপেক্ষে চীন ভ্রমণে বাংলাদেশিদের আগে থেকে ভিসা নিতে হয়না। যখন থেকে চীন আমাদের এ সুযোগটি দিয়ে আসছে আমার গল্পটা সে সময়ের। যদি ট্রানজিট ভিসা না হয় তাহলে টুরিস্ট ভিসার আবেদন করব খবর পড়ে এমন আশা বুকে বাঁধলাম।

মাঝরাতে ইন্দোনেশিয়ার বালি থেকে উড্ডয়ন করে চায়না সাউদার্ন অ্যায়ারলাইন্সের বিমান চীনের গুয়াংজু বিমানবন্দরে অবতরণ করল ভোরে। জরুরি কাগজপত্র, পাসপোর্ট গুছিয়ে ট্রানজিট টার্মিনালের দিকে গেলাম। লাগেজ সঙ্গে নেওয়া যাবে না। এগুলো পৌঁছে যাবে ফাইনাল গন্তব্যে। ছোট্র একটি ফরম পূরণ করে চব্বিশ ঘণ্টার ট্রানজিট ভিসার আবেদন করে পাসপোর্ট জমা দিলাম অ্যায়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন অফিসে। সঙ্গে দিলাম আমার জার্মান রেসিডেন্ট আইডি কার্ড। এটা লাগবে না বলে আইডি ফিরিয়ে দিয়ে দিল।

ওয়েটিং অ্যারিয়ায় বসে বসে অপেক্ষা করলাম। কোকাকোলা খেলাম। চীনা ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ সেখানে পানি, কোকাকোলা, কেক, চকলেট রেখেছেন বিমানযাত্রীদের জন্য। কোনো বিমানবন্দরে এটা আমি এই প্রথম দেখলাম। মনে একটু আশা জাগলো ভিসা দিতেও পারে। হঠাৎ ভাবলাম সর্বনাশ, জার্মানির রেসিডেন্ট আইডি ছাড়া তো ভিসা নাও হতে পারে। কারণ, আমার পাসপোর্টে কোথাও লেখা নেই আমি কোথায় বাস করি। এই কোথায় বাসের মধ্যে অনেক সময় অনেক কিছু নির্ভর করে। দৌড়ে গিয়ে আইডি জমা দিলাম আবার।

কিছুক্ষণ পর এক নারী কর্মকর্তা কিছু পাসপোর্ট হাতে এগিয়ে আসলেন। আমি দূর থেকেই বুঝে ফেললাম সেখানে আমার পাসপোর্ট নেই। আবার যখন আসলেন আমারটা নিয়ে আসলেন। চব্বিশ ঘণ্টা চীন দেশে ঘোরার ভিসা পেয়ে গেলাম। পাসপোর্টের সঙ্গে ছোট্ট একটি কাগজ ধরিয়ে বললেন, বাইরে আশি নম্বর গেইটটির পাশেই চায়না সাউদার্ন অ্যায়ারলাইন্সের অফিস। সেখানে বিমানের হোটেল ট্রান্সপোর্ট অপেক্ষা করবে। হোটেলের ব্যাপারটায় একটু পরে আসছি, এখনো ইমিগ্রেশন সম্পন্ন হয়নি। এটা তো ছিল প্রথমধাপ মাত্র।

পাসপোর্ট কন্ট্রোল অফিসার পাসপোর্টি রিডেবল মেশিনে দিলে সামনের মেশিনটি বাংলায় বলতে শুরু করলো, আঙুলের ছাপ দিন। বাহ, চমৎকার তো! সত্যিই চীনাদের তুলনা হয় না। বুড়ো আঙুল, মধ্য আঙুল, কনিষ্ঠ আঙুল এভাবে বাংলায় আমার দশ আঙুলের ছাপ নেওয়া সম্পন্ন হলে ‘চীন দেশে আপনাকে স্বাগতম’ বলে গেইটটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গেল।

সঙ্গে একটি ছোট্র ব্যাগ ছিলো আমার। সেটির ভেতরে কিছু পেয়ারা ও প্যাশনফ্রুট ছিলো। ইন্দোনেশিয়া থেকে কিনেছিলাম জার্মানি নেওয়ার জন্য। ব্যাগটিকে স্কেনিং মেশিনে দিয়ে ধরা খেলাম। কর্মকর্তা ডাকলেন। ব্যাগ খুলতে বললেন। হাতে রিসিটের মতো কিছু একটা ধরিয়ে চীনা ভাষায় কিছু একটা বললেন তিনি, সেটা আমার বুঝার বিষয় নয়। আমি জানতে চাইলাম এগুলো এখানে রাখবেন যাবার সময় ফেরত দেবেন মনে হয়? রিসিটে চীনা ভাষার পাশাপাশি ছোট্র করে ইংরেজিতে পড়লাম। লেখা রয়েছে ‘দস্তখত করেন এগুলো আমরা ডিস্ট্রয় করবো।’ ফলফ্রুট নিয়ে চীনে প্রবেশ নিষেধ লেখা ছিল।

গুয়াংজু বিমানবন্দর থেকে গাড়ি করে শহরের একটি হোটেলের উদ্দেশ্যে যাত্রা ধরলাম। সাউদার্ন চায়না বিমানের হোটেলে। এটি বিনামূল্যে প্লাস ব্রেকফাস্ট। যাত্রাবিরতি দীর্ঘক্ষণ হলে আপনি নিজেই বিমানটির ওয়েবসাইটে ঘেটে পছন্দের হোটেলটি বুক করে নিতে পারবেন।

চীনের বড় বিখ্যাত শহর সাংহাই ও বেইজিং এর পরেই চলে আসে গুয়াংজুর নাম। গুয়াংজু হলো গুয়াংডং প্রদেশের রাজধানী শহর। এশিয়ার আরেক আকর্ষণ হংকং থেকে মাত্র ১২০ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে আর ম্যাকাও প্রদেশ থেকে ১৪৫ কিলোমিটার উত্তরে গুয়াংজুর অবস্থান। গুয়াংজুর রয়েছে ২ হাজার ২০০ বছরেরও বেশি পুরনো ঐতিহ্য।

প্রায় ১৪ মিলিয়ন জনসংখ্যা এবং ৭ হাজার ৪৩৪ বর্গকিমি আয়তন নিয়ে গড়ে উঠা গুয়াংজু পৃথিবীর অন্যতম আলফা গ্লোবাল সিটি। প্রতিনিয়ত এখানে মানুষ আসছেন। প্রধানত ব্যবসায়িক কারণে পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে অনেক মানুষ গুয়াংজুতে আসা-যাওয়া করে থাকেন। চীনের অন্যান্য প্রদেশ থেকে এবং দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্নও দেশ থেকে গুয়াংজুতে প্রচুর পর্যটক আসেন।

চিন্তা করছি পরবর্তী সময়ে এ রুটে যাতায়াত করলে বেইজিংয়ের বিমান ধরবো। দীর্ঘসময় যাত্রাবিরতি করবে স্বেচ্ছায় এমন ফ্লাইটের টিকেট কিনবো। এক ঢিলে দুই পাখি। এতে গ্রেইট ওয়াল অব চায়না দেখার সুযোগ হয়ে যাবে।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!