এর মধ্যে নতুন চন্দ্রবর্ষকে বরণ করে নেওয়ার অনুষ্ঠান সবচেয়ে বেশি সময় ধরে পালন করা হয়। চীনা পঞ্জিকা অনুযায়ী চাঁদের সঙ্গে মিল রেখে এটা পালনের রেয়াজ, তাই প্রতিবছর ইংরেজি পঞ্জিকাবর্ষ থেকে কিছুটা পিছিয়ে পড়ে। এখানে চীনা পঞ্জিকাবর্ষ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়া জরুরি। চন্দ্রবর্ষের ১২ প্রতীকের মধ্যে অন্যান্যগুলো হচ্ছে ইঁদুর, ষাঁড়, বাঘ, খরগোশ, ড্রাগন, সাপ, ঘোড়া, ছাগল, বানর, মোরগ, কুকুর ও শুকর। পঞ্জিকা অনুযায়ী এ প্রতীক নির্ণয় করা হয়।
এ বছরকে ‘সমৃদ্ধির বছর’ হিসেবে বিবেচনা করছেন চীনা রাশি বিশেষজ্ঞরা। কারণ, এ বছরের প্রতীক শুকর। শুকর প্রতীকের শক্তি হচ্ছে সৌভাগ্য, সমৃদ্ধি ও সন্তুষ্টি। চীনারাও রাশি অনুযায়ী প্রত্যাশা করছেন এ বছর সমৃদ্ধ হবে জীবন। শুকরকে বিচক্ষণ বলেও বিবেচনা করা হয়। তাই বিচক্ষণ আচরণও থাকবে বছরজুড়ে।
এবারে চন্দ্রবর্ষের প্রথম দিনটা ছিলো ৫ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার। আমি অফিসে গিয়ে মিস্টার লিমকে না দেখে বসকে জিজ্ঞেস করাতে বললেন উনি ছুটি নিয়েছেন চন্দ্রবর্ষ উপলক্ষে। আমি তখন ফেইসবুক খুলে বেশ কিছু চন্দ্রবর্ষ পালনের ইভেন্ট দেখতে পেলাম। সবগুলোই আমাদের বাসা থেকে দূরে, তাই কিছুটা মনোক্ষুণ্ণ হলাম। কারণ আমরা বাস করি সিডনির দক্ষিণ পশ্চিমের একটা সাবার্ব মিন্টোতে। সেখান থেকে যেখানেই যেতে চাই না কেন মোটামুটি ঘণ্টা খানেকের ড্রাইভ।
অবশেষে আমাদের সাবার্ব মিন্টো মার্কেটপ্লেসের একটা পোস্ট দেখলাম। তারা চন্দ্রবর্ষ ২০১৯ উপলক্ষে ৯ ফেব্রুয়ারি শনিবার সকাল দশটা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত চীনের ঐতিহ্যবাহী সিংহ নাচের ব্যবস্থা করেছে এবং সপরিবারে সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সেটা কোন ইভেন্ট ছিলো না, তাই একটা কমেন্ট করে রাখলাম যাতে করে মনে থাকে।
একজন সোজা হয়ে দাড়াচ্ছেন আর অন্যজন তার সামনে থেকে নিপুণ দক্ষতায় লাফ দিয়ে পিছনের জনের মাথার উপরে চড়ে বসছেন। তারপর লেটুসের ঝাড়টা দোকানে উপরের চৌকাঠে টেপ দিয়ে ঝুলিয়ে দিচ্ছেন। আমি আর তাহিয়া তাদের পিছনে ঘুরে-ঘুরে তাদের কাজ দেখলাম। সবগুলো দোকানে লেটুস ঝোলানো, শেষে উনারা নিজেদের ভ্যানের কাছে ফিরে গিয়ে সাজ-সরঞ্জামাদি বের করা শুরু করলেন। দুইটা সিংহ আর সাথে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে একটা বড় ড্রাম, তার সাথেই একিটা লোহার স্তম্ভের সাথে একটা কাসা ঝুলানো। আর হাতে বাজানোর জন্য কাসার তিনজোড়া চাকতি।
বিশেষ করে তারা শিশুদের দেখলেই গায়ে এসে মাথা ঘষে দিচ্ছিলো। রায়ানের সাঁতার শেষ হওয়ার পর আমরা রায়ানকেও নিয়ে গেলাম। ততক্ষণে সিংহ দুজন মিন্টোর মূল মার্কেটপ্লেসে ঢুকে পড়েছে। প্রত্যেকটা মার্কেটপ্লেসে ঢোকার আগে তারা নাচ প্রদর্শন করছিলো। নাচ শেষ হওয়ার সাথে সাথে দুজন দুটো কাগজের বন্দুক ছুড়ছিলো। সেখান থেকে হলুদ আগুনের ফুলকির মতো ছোট ছোট কাগজের টুকরো বাতাসে ছড়িয়ে পরে এক ভৌতিক পরিবেশ তৈরি করছিলো।
রায়ান শুরুতে ড্রাম আর কাসার বাদ্যে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেও সহসাই নিজেকে সামলে নিলো। ড্রাম আর কাসার বাদ্য আসলেই এতো প্রকট ছিলো যে আমাদের বড়দেরই কানে তালা লেগে যাচ্ছিলো। সিংহের নাচ দেখে একসময় রায়ান আমার কোলের মধ্যে নাচা শুরু করলো। এই উৎসবের সবচেয়ে লক্ষণীয় দিক ছিলো দোকানগুলোতে আসা সব বয়সের, ধর্মের এবং বর্ণের মানুষদের অংশগ্রহণ।
পৌঢ়রা শুরুতে রায়ানের ভীতু চেহারা দেখে গায়ে পরে আমার কাছে এসে রায়ানকে বুঝানো শুরু করলো, ইটস জাস্ট এ টয়। পরে যখন রায়ান নাচা শুরু করলো উনারা পাশে দাঁড়িয়ে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিলেন। একজন মাকে দেখলাম সারা শরীর পর্দায় ঢাকা, বুঝলাম উনি প্র্যাকটিসিং মুসলমান। উনিও উনার বাচ্চাদের সিংহের পাশে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলে নিচ্ছিলেন।
সিংহ দুজন প্রত্যেকটা দোকানের দরজায় এবং ভিতরে নাচ শেষ করে আগে থেকেই ঝুলানো লেটুস খাওয়ার ভঙ্গিতে ছিঁড়ে নিচ্ছিলো। তারপর সেটা কিছুক্ষণ চাবানোর ভঙ্গি করে ছুড়ে দিচ্ছিলো। সেটা ধরতে পারা দোকানির জন্য সৌভাগ্যের প্রতীক। এভাবে একসময় সবগুলো দোকানের সামনে নাচা শেষ হলো। ইতোমধ্যে অবশ্য সিংহের ভিতরের মানুষ দুজন পালাক্রমে তাদের জায়গা বদল করছিলো তখন বাইরে থেকে নতুন মানুষ মুখোশের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছিলো।
এই কাজটা করা হচ্ছিলো সুনিপুণ দক্ষতার সাথে, যাতে করে দর্শক বুঝতেই পারছিলো না কখনো মানুষ বদল হচ্ছে। নাচ দেখা শেষ করে আমরা বাসার পথে পা বাড়ালাম। রায়ান তখনও গাড়ির সিটের মধ্যে বসে নাচের ভঙ্গি করছিলো। আসলে যেকোনো ধরনের রঙিন, জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানই বাচ্চাদের টানে। আর বহু সংস্কৃতির দেশ অস্ট্রেলিয়া বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক উৎসবগুলোকে সবসময়ই উৎসাহ দিয়ে যায়। তাই বছরজুড়েই কোন না কোন উৎসব লেগেই থাকে।
আপনি একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই আপনার বাসার আশপাশেও এমন নির্মল বিনোদোনের উপকরণ খুঁজে পেতে পারেন। যদিও সিডনি শহরেই এই অনুষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বেশি জাকজমক করে পালন করা হয়।
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |