শীতের ভ্রমণ: মেরিল্যান্ডে বাংলাদেশি জিনিয়াসদের কাছাকাছি

শীতপ্রধান দেশ কানাডা। বছরের প্রায় অর্ধেক সময় এখানে আবহাওয়া ঠাণ্ডা থাকে। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এ তিন মাস অত্যাধিক ঠাণ্ডা। হয় ঘনঘন তুষারপাত। দূরঅবধি দুচোখ যেদিকে তাকাই শহর, বন্দর, খোলা মাঠ- চারদিক যেন বরফের সাদা চাদরে ঢাকা।

সাদেকুল ইসলামমো. , টরন্টো থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Jan 2019, 03:57 AM
Updated : 30 Jan 2019, 03:57 AM

এসময়টায় তাপমাত্রা সবচেয়ে কম। প্রায়ই শুন্যের নিচে, নেগেটিভ সংখ্যা। এখন পর্যন্ত কানাডার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ইউকনে, মাইনাস ৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রতিকূল আবহাওয়া। তাতে কি? জীবনযাত্রা থেমে নেই। মানুষ ক্রমাগত ছুটছে। অফিস,

শিল্পকারখানা, ব্যবসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব চলছে নিয়মমাফিক। কিছুটা ধীরগতি কখনো। যেমন অতিমাত্রায় তুষারপাতে বা তুষারবৃষ্টির সময়ে।

উত্তর আমেরিকাসহ বিশ্বব্যাপি ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই ছুটির আমেজ শুরু  হয়। ছুটি মুলত ডিসেম্বরের শেষ তৃতীয়াংশে। নতুন বছরের শুরু দিনটাও। বছরের প্রথম দিনটা ছুটি কেন? সুন্দর পৃথিবী গড়তে কাজপ্রিয় মানুষেরা এদিনে পুরো বছরের পরিকল্পনা করে। ছুটির এই সময়টাকে কাজে লাগাতে অনেক ভেবেছি- কোথায় যাওয়া যায়!

জীবন সংগ্রামের অনেক বছর পার করেছি। কানাডাতেই প্রায় নয় বছর ছুঁইছুঁই। ফিরব কি ফিরবনা সেটা অমিমাংসিত রেখেই ২০১০ সালে জাপানের আকাশে উড়াল দিয়েছি। পরেরদিন সাস্কাচেওয়ানের আকাশসীমায় দুরুদুরু হৃদয়ে কানাডায় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হয়েছি। এই সাস্কাচেওয়ানের রাজধানীতে সঞ্চিত আনন্দ-কষ্ট ও সুখ-দুঃখের অনেক স্মৃতিবহুল সময়ের কথা কিছুই মনে নেই আমাদের মেয়ে ছোট্ট নাবিহার। আমি দৌড়েছি সাস্কাচেওয়ান, আলবার্টা ও ওন্টারিও প্রদেশে। দেখেছি প্রাকৃতিক বৈচিত্রেভরা বিশাল এদেশকে। ধারণা নিয়েছি মানুষের জীবনযাত্রার।

টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সুযোগে ২০১১ সালে আরম্ভ হয় এই নগরীয় জীবন। নাবিহা পায় খেলার সাথী ছোট ভাইবোন নাশিতা ও ইহানকে। সময়ের সাথে বেড়ে উঠা তিন সন্তানকে নিয়ে এতোদিন ঘোরাঘুরি ছিল টরন্টোকেন্দ্রিক, আর তা মুলত গ্রীষ্মকালে। ওরা দেখতে চাই মা-বাবার লাল সবুজের বাংলাদেশকে। চাই দেখতে আত্মীয়দের- আর তারা থাকে কে কোথায়। অতি ব্যস্ত জীবনে ডিসেম্বরের এই শীতকালীন ছুটির সময়টাকে বেছে নিয়েছি বাচ্চাদের জন্য কাজে লাগাবো বলে। শিক্ষা, বন্ধুত্ব ও আত্মীয়তাকে প্রাধান্য দিয়েছি। জানবো বিজ্ঞান, দেখবো বাংলাদেশি জিনিয়াসদের। যাবো এবার আমেরিকা, মেরিল্যান্ড- এই হলো সিদ্ধান্ত।

ক্রিস্টমাসের দিনে সবাই যখন নিজ নিজ শহরে আত্মীয়-বন্ধুদের সাথে সময় কাটাচ্ছে, ঠিক তখন আমরা গাড়ি চালাবো নায়াগ্রা হয়ে আমেরিকার ইন্টার-স্টেটের বড় বড় হাইওয়েতে। সাম্প্রতিক বছরের সাথে অমিল রেখে গেলবছর ২০১৮ এর ক্রিস্টমাসের দিনটাতে তুষারপাত হয়নি। তবে ঠাণ্ডার কমতি নেই। তাতে কি? এতোগুলো বছরে তা আমাদের সয়ে গেছে। সকাল ৭টা ৩০ মিনিট। বের হলাম আমরা, মূল চালক আমি। সহধর্মিণী ইভা, সেও ভালো গাড়ি চালায়। যেতে হবে ৮০০ কিলোমিটারের পথ।

ওন্টারিওর গর্ব আমাদের হাইওয়ে-৪০১ দিয়ে চলছি। সগর্ভে দাড়িয়ে থাকা টরন্টোর সিএন টাওয়ারকে পেছনে ফেলে মিসিসুয়াগা-ওকভিল-হ্যামিল্টন শহরের আলোক ঝলমলে সুউচ্চ বিল্ডিংগুলোকে ডানে বামে রেখে সেন্টক্যাথরিনের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য পেরিয়ে খুব অল্প সময়ে সকাল ৯টায় নায়াগ্রার কানাডা-আমেরিকা বর্ডারে পৌঁছেছি। ভ্রমণের কথা ভেবে ভেবে উত্তেজিত বাচ্চারা আগের রাতে তেমন ঘুমায়নি। চলন্ত গাড়িতে ওদের গভীর ঘুমটা বর্ডারে এসে গাড়ির গতিশুন্যে এই বুঝি ভেঙ্গে গেল।

ফিরে দেখি ঠিক তাই। ওপাশে আমেরিকা জানার পর ওরা সমানে উত্তেজিত। নাবিহা আর নাশিতা আনন্দে বলল, ‘ওহ ফাইনালি উই আর দেয়ার!’ ভেবেছে- তাহলে বর্ডার পার হলেই মেরিল্যান্ড- ইতি খালামনির বাসা। তাদের আমি বুঝিয়ে বলি- ‘লং ওয়ে টু গো মাই মা’। ইমিগ্রেশন পার হচ্ছি। ওখানেই প্রথম বুঝলাম কানাডিয়ান পাসপোর্টের গুরুত্বটা। সময় নিল মাত্র ২ মিনিট। আমাদের কাছে ড্রাইফুডের সাথে ছিল কলা ও কমলা। অফিসার কমলাগুলো ফেলে দিলেন, বললেন ‘হ্যাভ আ নাইস টাইম ইন আমেরিকা’।

বাফেলোর হালকা বরফে ঢাকা বুকটা চিড়ে এগিয়ে যাচ্ছি, উপরে নীলাভ সাদা আকাশটা। দেখতে পাওয়া বাড়িঘরগুলো কিছুদুর পরে আর নাই। আছে দুপাশে জনমানবহীন শুধু গাছপালা-জঙ্গল। একটু কি ভয় পেলাম? ঠিক তাই। অজানা আশঙ্কা, যদি কিছু হয়- গ্যাস ফুরানো, ইঞ্জিন বিকল। শক্ত প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি বটে। নতুন ব্রেক সিস্টেম, জ্যাক, বুস্টার কর্ড, টুল বক্স। সাথে বেসিক জ্ঞান- এ আমার জানার আগ্রহ সবসময়। আরো প্রায় ঘণ্টা পরে জনবসতি চোখে পড়লো। হাইওয়ে থেকে বেরিয়ে গাড়ির ফুয়েল ট্যাঙ্ক ভরাট করলাম। আমরা নিলাম একটু বিরতি। শরীর হালকা করে তাতেও খাবার ফুয়েল দিতে হলো।

পিটসবার্গ অজ্ঞরাজ্যের ভয়ংকর পিচ্ছিল পাহাড়ি পথের শুরু। চারদিকে পাহাড়, আঁকাবাঁকা পথ। আর তাতেও বরফের হালকা স্তর। অপ্রশস্ত পথ দিয়ে কখনো পাহাড়ে উঠছি, নামছি, বা পাশ দিয়ে চলছি। এগিয়ে যাওয়া সহজ নয়। চালকের ভাল দক্ষতা অবশ্যই প্রয়োজন। চোখেমুখে ক্লান্তির ছায়া স্পষ্ট, তবুও ইভা চেয়েছে চালকের আসনে বসতে। আমি তাকে দিতে ভরসা পাইনি। তবে তার সাহসের প্রশংসা করি। ‘বাচ্চাদের যত্ন নিতে তুমি অনেক কষ্ট করেছো, ওটা আমি তেমন পারিনা’- গাড়ি ওর হাতে না দিতে আমি বুঝিয় তাকে।

কঠিন পথ, সন্দেহ নাই। তা আগেই জেনেছি। তবে এতটা কঠিন আশা করিনি। চ্যালেঞ্জ নেয়াটা দরকার, নিজের উপর আস্থা বাড়ে। প্রকৃতির এই পাহাড়ি অপার সৌন্দর্য সবদিকে। দুচোখ ভরে তা দেখেছি। গ্রীষ্মে কিংবা শরতে, তরতাজা আবহাওয়ায় প্রখর সূর্যালোকে এই প্রকৃতি অতি চমৎকার হবে এটা আমি নিশ্চিত। অসম পথ পেরিয়ে একসময় পেনসালভানিয়া অজ্ঞরাজ্যে প্রবেশ করি। বাফেলোর পর বিরতিসহ আরো কটা ঘণ্টা কেটে গেছে। অর্ধেকের কিছুটা বেশি পথ পাড়ি দিয়ে নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলেছি। সন্ধ্যা হয়ে এলো। ওয়াশিংটনের চওড়া হাইওয়ে দিয়ে ১২০ কিমি/ঘণ্টা গতিতে চালিয়ে যখন মেরিল্যান্ডে ঢুকছি, আনন্দটা বেড়ে গেল। অবশেষে সেখানে পৌঁছলাম। সবমিলিয়ে ১২ ঘণ্টা।

ইতি ইভার ছোট বোন। হাজবেন্ড ড. আরিফ ও সে দুজনেই মলিক্যুলার বায়োলজিস্ট। ওরা পিএইচডি করেছে জাপানে। এখন তারা মেরিল্যান্ড এন. আই. এইচ. এর সাইন্টিস্ট। মেরিল্যান্ডে অবস্থিত পৃথিবী বিখ্যাত এই বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে আমরা দেখব। আর বিজ্ঞানে আগ্রহী আমাদের স্কুলবয়সি দুই মেয়ে সাথে থাকবে। প্রায় ৭০টি বড় বড় বিল্ডিংয়ের এই ইন্সটিটিউটগুলোর বিশাল ব্যারাকের ভিজিটর প্রবেশপথে আমাদের গাড়িটাকে সিকিউরিটির লোকেরা তন্নতন্ন করে চেক করলো। আর আমাদেরকে চেকিংটা ছিল- ঠিক যেন বিমানবন্দরের সিকিউরিটি পার হচ্ছি।

আমেরিকায় জাতীয় স্বাস্থ্য গবেষণার প্রতিষ্ঠান হলো ন্যাশনাল ইন্সটিউটস অব হেলথ, সংক্ষেপে এনআইএইচ। জনস্বাস্থ্য ও বায়োমেডিকাল গবেষণার সাতাশটি প্রতিষ্ঠানের এই বিশাল কেন্দ্র মেরিল্যান্ডের বেথেসডায় অবস্থিত। বায়োমেডিকাল গবেষণায় বিশ্বে এটা সেরা। সব থেকে বড়। আবিষ্কারের নেশায় হাজার হাজার গবেষক এখানে রাতদিন পরিশ্রম করছে। পোস্টডক বা অন্যান্য গবেষণার জন্য প্রাণরসায়নবিদ, রসায়নবিদ, অনুজীববিজ্ঞানী, মেডিকাল ডক্টরদের তুমুল প্রতিযোগিতা এখানে।

এখানকার বিভিন্ন ইন্সটিটিউটে বাংলাদেশের তুখোড় জিনিয়াসরাও আছে। পৃথিবীর বড় বড়  গবেষকদের সাথে প্রতিযোগিতায় মেধা আর যোগ্যতা প্রমাণ করে আমাদের ছেলেমেয়েরা এখানে জায়গা করে নিয়েছে। অন্যান্যদের মাঝে সিনিয়র হিসেবে পেলাম আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাল বন্ধু জুবায়ের ও তুষারকে। ওরা একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছে। গর্বে বুকটা ভরে যায়! ওরা সবাই বাংলাদেশের সোনার সন্তান।

বেথেসডার এনআইএইচ থেকে ওয়াশিংটন ডিসি মাত্র ২০ কিমি পথ। দেখতে যাবো। মেরিল্যান্ডে কি সুন্দর রোদ্রউজ্জ্বল দিন! আবহাওয়া ভাল। তাপমাত্রা ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। টরন্টোতে তখন তাপমাত্রা শুন্যের নিচে। ইতির পরিবার নিয়ে সবাই একসাথে ওয়াশিংটন যাবো বলে উবারের বড় গাড়িতে উঠি। বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সেই অলিগলি ভেদ করে ভাইস প্রেসিডেন্টের বাসভবনের পাশ দিয়ে উবারের গাড়িটা ধীর গতিতে যেতে যেতে একসময় থামলো। দেখলাম সেখানে লিংকন মেমরিয়াল। সপ্তাহের সাত দিনই সেখানে মানুষের ভিড়। সেখান থেকে হেঁটে গেলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মেমোরিয়ালে।

ওখানে সবকটি অঙ্গরাজ্যের নামফলকসহ ইতিহাসের কথা বলে। প্রচুর দর্শকের ভিড় সেখানেও। শীতকাল বলে পানির ফোয়ারাগুলোর আর্টিস্টিক ঝলকানিটা ছিলনা। আরো দূরে ওই যে ওটা কি? আকাশ ছুঁতে চায়। সেটা ওয়াশিংটন মনুমেন্ট। পরে নিরাপত্তা বেষ্টনি পেরিয়ে আমরা যাই বিখ্যাত হোয়াইট হাউসের কাছে। দেখতে হলো একটু দূর থেকে বৈকি। আমেরিকানদের জাতীয় ক্রিস্টমাস ট্রি ওখানে, সেটা সুউচ্চ বটে। খুব সুন্দর করে সাজানো। প্রচুর মানুষের সমাগম। আশির্বাদের আশায় মানুষের ফেলা কয়েনগুলোতে চারপাশটা যেন ভরপুর প্রায়। ভার্জিনিয়া অজ্ঞরাজ্য খুব বেশি দূরে নয়, ৪৫ মিনিটের পথ। সেখানকার ‘অ্যায়ার অ্যান্ড স্পেস’ মিউজিয়ামে গেলাম আমরা। অসাধারণ সুন্দর করে সাজানো। বিমান-স্পেসবাহনের আবিষ্কার, আর ক্রমউন্নতি দেখানো হয়েছে সেখানে। দ্বিত্বীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত অনেক কটা বিমান চোখে পড়লো।

বিজ্ঞানের আবিষ্কার সভ্যতার উন্নতি করে। এর অপব্যবহারে শুধু ধ্বংস। তা মুহূর্তে অথবা ধীরে ধীরে। এর ক্ষতিকর প্রভাব থাকে বছরের পর বছর। পারমানবিক বোমার ভয়াবহতা বিশ্ব দেখেছে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে। ধ্বংসে নয়, বিজ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে। একটা সুন্দর পৃথিবী গড়তে হবে। আর তা আমাদেরকেই। দেখে আসলাম বায়োমেডিকাল বিজ্ঞান গবেষণায় বিশ্বের সেরা বড় প্রতিষ্ঠান, ন্যাশনাল ইন্সটিউটস অব হেলথ (এনআইএইচ)। এখানে বাংলাদেশি সোনার সন্তান, জিনিয়াসরা পিছিয়ে নেই।

লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী, রিসার্চ সাইন্টিস্ট, জৈব রসায়ন, টরন্টো, কানাডা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!