বিশ্বের বৃহত্তম ভলকানিক লেক ভ্রমণ

আপনি কি পাহাড়-প্রকৃতিপ্রেমী? আপনার  মেঘ ছোঁয়ার স্বপ্ন? আপনার সুইজারল্যান্ড দেখার ইচ্ছা কিন্তু, এটা আপনার বাজেটের মধ্যে পড়ে না? আপনি একজন বাইকার? সিনেমার কোন দৃশ্যের মতো পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে ইচ্ছেমতো গতিতে মোটরবাইক চালানোর শখ? তাহলে উত্তর সুমাত্রার লেক টোবায় ভ্রমণের কোনো বিকল্প নেই।

নাঈম হাবিব, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Jan 2019, 03:39 AM
Updated : 29 Jan 2019, 03:39 AM

আগ্নেয়গিরি শহর বেরাস্তাগি বেড়ানো শেষে একটি সেয়ারিং গাড়িতে করে গিয়েছিলাম লেক টোবায়। সড়ক পথে চার ঘণ্টার রাস্তা। আঁকাবাঁকা সড়কপথ। ভয় আর উত্তেজনার যাত্রা ছিল এটি। আপনি সরাসরি সেখানে যেতে চাইলে মেদানের কুয়ালানামু বিমানবন্দরে নেমে সেয়ারিং গাড়িতে করে যেতে পারবেন। লেক টোবার খুব কাছে একটি বিমানবন্দর রয়েছে। তবে সব দেশের বিমান এ বন্দরে নামে না।

ঘণ্টা তিনেক যাত্রা শেষে আমরা লেক টোবার দেখা পেয়ে গেলাম। লেকের কিনারায় পাহাড়ি সড়ক পথে আরো ঘণ্টাখানেকের পথ পাড়ি দিতে হবে। আমাদের গন্তব্য লেক টোবার সামসির দ্বীপ। লেকের মধ্যে এটি একটি ভলকানিক দ্বীপ। দ্বীপের চতুর্দিকে লেক। সে দ্বীপে যেতে প্রথমে যেতে হবে সেখানকার পারাপার নামক ঘাটে।

লেক টোবা বিশাল এলাকাজুড়ে একটি বৃহৎ লেকের নাম। লেকটি প্রায় ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ৫০৫ মিটার গভীর। এটি একটি মহাআগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ জুড়ে অবস্থিত বৃহৎ প্রাকৃতিক হ্রদ। ইন্দোনেশিয়ার বৃহৎ ও বিশ্বের বৃহত্তম ভলকানিক লেক এটি। শুনে অবাক হবেন, লেকটির তলদেশে আগ্নেয়গিরি এখনো জীবিত!

৭৫ হাজার বছর আগে একটি মহাআগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণে এই লেকের সৃষ্ট হয়। বিস্ফোরণের পর এর ধোঁয়া ও ছাই আকাশে একটি পর্দার তৈরি করেছিল। যা সূর্যের আলো পৃথিবীতে আসতে বাধা সৃষ্টি করেছিল। জেনে অবাক হবেন, মহাআগ্নেয়গিরি টোবা বিস্ফোরিত হওয়ার ফলে সারা বিশ্বব্যাপী ভলকানিক শীত নেমে এসেছিল। পৃথিবীর তাপমাত্রা তখন ৩ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে এসেছিল এবং পৃথিবীর অক্ষাংশের তাপমাত্রা ছিল ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দূরের আফ্রিকা মহাদেশেও এর প্রভাব পড়েছিলো। গত আড়াই কোটি বছরের মধ্যে এটিই ছিল বিশ্বের বৃহত্তম ভলকানিক বিস্ফোরণ।

পারাপার ঘাট থেকে টিকিট কেটে ফেরিতে উঠলাম। পনেরো বিশজনের মতো যাত্রী। বোট লেকের মাঝপথে পৌঁছুলে চারদিকের মেঘ-পাহাড়ের মিলনমেলা দেখে ইন্দোনেশিয়ায় নয় সুইজারল্যান্ডে আছি মনে হলো। ঘাট থেকে সামসির দ্বীপ আধঘণ্টার পথ। এই পথে গতবছর অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের কারণে একটি ফেরি দুর্ঘটনায় ১৯০ জন নিহত হয়েছিলেন। একটা মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ছিল এটি। তখন খবরে পড়েছিলাম।

আমার বিদেশি সঙ্গী বললো, জায়গাটি দেখতে যেমন সুইজারল্যান্ডে মতো। আবার ট্রপিকাল কিছু রয়েছে এখানে। সে বললো, আম, কলা, পেঁপে গাছ, বাঁশ বাগান, এসব সুইজারল্যান্ডে দেখা যাবে না। চারদিকের উঁচু উঁচু পাহাড় আর সাদা মেঘের উড়োউড়ি মনটাকে একদম শীতল করে তুললো। খুব উপভোগ করেছিলাম আধঘণ্টার এ বোট যাত্রা। একদম হোটেল ঘাটে আমাদের নামিয়ে দিল।
ব্যাপারটা সুন্দর। আপনি সামসির দ্বীপের যে হোটেলই বুক করুন না কেন আপনাকে একেবারে হোটেলে পৌঁছে দেবে। হোটেলের বেলকনিতে বসেই সারাক্ষণ লেক টোবার সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। লেকে সাঁতার কাটলাম। যদিও একটু ভয় ছিল মনে। হোটেল কর্মকর্তা বললেন, নির্ভয়ে সাঁতার কাটতে,তিনি দৈনিক তিন-চারবার সাঁতার কাটেন এখানে বললেন। এখানকার হোটেলগুলো মেহমানদের জন্য হোটেলের সামনে ছোট ছোট ঘর বানিয়ে রেখেছে। যাতে সবাই সে জায়গায় বসে সুন্দর এমন দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন। নতুন বিবাহিতদের জন্য ভ্রমণের উপযুক্ত যায়গা হবে এটি।
ইন্দোনেশিয় বাতাক জাতির বাস এখানে। বাতাকদের ঘরবাড়ি দেখতে খুবই আকর্ষণীয়। পৃথিবীর আর কোনো দেশের কোনো জাতির সঙ্গে এদের ঘরবাড়ির কোনো মিল নেই। এসব ঘরবাড়ির দেখতে দূর,বহুদূরের দেশ থেকে মানুষ আসছেন দৈনন্দিন। বাতাকদের নিজস্ব ভাষাও রয়েছে। বাতাক ভাষা। এখানের বাতাক মিউজিয়াম ভ্রমণ করে আরও অনেক কিছু জানা যাবে।

হোটেলের কাছেই অনেকগুলো ভালো খাবারের রেঁস্তোরা পেয়ে গেলাম। ইন্দোনেশিয় খাবার খুবই উপভোগ করলাম। জার্মানিতে দেশিও খাবার খুব মিস করা হয়। মাছ, শাকসবজি, ভর্তা এগুলোই খেয়েছি বেশি। বাইকার পর্যটকদের অন্যরকম পছন্দ এ দ্বীপ। এখানে মোটরবাইক ভাড়ায় পাওয়া যায়। এ দ্বীপে গাড়ি-ঘোড়া না থাকায় পাহাড়ি পথে আপনি ইচ্ছেমতো গতিতে মোটরবাইক চালাতে পারবেন। পুরো দ্বীপটি মনের মতো করে ঘুরে দেখতে পারবেন।

খুব ইচ্ছে ছিলো মোটরবাইক চালিয়ে পুরো দ্বীপটি ঘুরে দেখার। কিন্তু লাইসেন্সবিহীন কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ইন্সুরেন্স এর দায়ভার নেবে না তাই এ ইচ্ছাটি অপূর্ণ রইল।

ফিরতি পথে হোটেল ঘাটে ফেরির অপেক্ষায় ভাবলাম, আরো কিছুদিন যদি এখানে থেকে যেতে পারতাম!

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!