ভলতাভা নদীর শহর প্রাগ

মধ্য ইউরোপে বেড়ানোর একটা অসাধারণ জায়গা হচ্ছে চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগ। বর্তমানে দেশটি 'চেকিয়া' নামেও পরিচিত।

দেবাশিস সরকার, অস্ট্রেলিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Jan 2019, 04:00 AM
Updated : 26 Jan 2019, 01:58 PM

এদেশে প্রায় দেড় কোটির কিছু বেশি মানুষের বসবাস। ভলতাভা নদীর শহর প্রাগ। ভ্রমণ-পিপাসুরা একবারের জন্য হলেও প্রাগের অসাধারণ সব গল্প শুনেছেন। আমারও খুব ইচ্ছে ছিল যে প্রাগ বেড়াতে যাবো। হঠাৎ একদিন বাসের টিকেট কেটেই ফেললাম। একা একাই বেড়াতে গেলাম। বাসে যাতায়াতের জন্য অনেক লম্বা সময় লাগে ভ্রমণ করতে, কিন্তু খরচের কথা চিন্তা করে চলেই গেলাম।

ব্রাসেলসের গার্ড দু নর্ড রেল স্টেশনের পাশেই ইউরো লাইনস এর বাস স্টেশন। যাই হোক, জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের পথ পেরিয়ে খুব ভোরে গিয়ে নামলাম প্রাগের বাস স্টেশনে। ওইসময় এক ধরণের শিহরণ কাজ করছিলো। সকালে সূর্য উঠার সাথে সাথে রঙিন প্রাগকে প্রথম দেখার অভিজ্ঞতা সত্যিই ভোলার নয়।

তারপর ট্রামে করে চলে গেলাম শহরে। তখনও অনেকটাই সকাল আর প্রচণ্ড শীত। ভলতাভা নদীর পাশে বসার জায়গায় মাথার নিচে ট্রাভেল ব্যাগটাকে বালিশ বানিয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলাম। ভলতাভা নদীর দুই পাশ দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে আপনি প্রাগের অনেক সৌন্দর্যই উপভোগ করতে পারবেন। আমি হেঁটে হেঁটে বেড়াতে লাগলাম।

১৪ শতকের বিখ্যাত চার্লস ব্রিজ হচ্ছে প্রাগের প্রধান পর্যটন আকর্ষণ। সম্রাট চতুর্থ চার্লস ১৩৫৭ সালে এই ব্রিজ উদ্বোধন করেন যা তার নাম অনুসরণ করেই আজকে চার্লস ব্রিজ নামে পরিচিত। বলা হয়ে থাকে প্রায় ২০ হাজার মানুষ প্রতিদিন এই ব্রিজ দিয়ে হেঁটে যান যার বেশিরভাগই পর্যটক। এত মানুষ ব্রিজের উপর বেড়াতে যায় যে আপনাকে একরকম ঠেলাঠেলি করেই এগিয়ে যেতে হয়। ব্রিজের উপর ভাস্কর্য্গুলোর কারুকার্য দেখলে যে কেউ প্রেমে পড়ে যাবে। এই ব্রিজের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে আপনি শত শত বছরের ইতিহাসের নিদর্শন দেখে যেতে পারবেন।

চার্লস ব্রিজের উপর ‘ব্রিজ ব্যান্ড’ নামে গানের দল আপন মনে গান-বাজনা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেকের কাছে আবার ওদের গানের রেকর্ডারও বিক্রি করছে। তাছাড়া ব্রিজের উপর অনেক চিত্রশিল্পী কাজ করে। তারা হবুহু মানুষের ছবি এঁকে দিচ্ছে। মানুষজনকে শুধু কিছু সময় ওদের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে হয়। ব্রিজের একপাশে উঁচু পাহাড়ে ঘরবাড়ি দেখতে অন্যরকম সুন্দর লাগে।

ডানসিং বিল্ডিং হচ্ছে আরেকটা দর্শনীয় স্থান। এই বিল্ডিং এর দিকে তাকালে মনে হবে যেন নাচানাচি করছে। আসলে এটা একটা রেঁস্তুরা। এখানে আসলে সবাই একটা ছবি তুলতে ভুলে না। আমিও ভুল করিনি। প্রাগে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল বা জ্যোতির্বিদ্যার ঘড়ি দেখতে ভিড় লেগে যায়। অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ঘড়ি পুরনো টাউন হলে টাওয়ারে দেখতে পাওয়া যাবে। ১৫ শতকের স্মৃতি নিয়ে এই ঘড়ি আজ অব্দি চালু আছে। তাছাড়া আপনি প্রাগ কাসল দেখে আসতে পারেন। প্রাগ কাসল দেখতে অসাধারণ লাগে।

নদীর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখি উইশ ওয়াল বা ইচ্ছে দেয়াল। এ দেয়ালে সবাই যার যার মনের কথা লিখে আসে এই বিশ্বাসে যে সেটা সে পাবে। আমি অনেক ভেবেও বুঝতে পারলাম না কি চাইবো। তাই বাবার আদর করে দেওয়া নিজের নামই লিখে আসলাম। সাথে ছবিও তুলে আনলাম যাতে পরে কেউ বেড়াতে গেলে বলতে পারি সে কথা।

প্রাগের সুন্দর সুন্দর বিল্ডিঙের সরু গলিগুলোতে দেখলাম পর্যটকরা আনন্দে হাঁটাহাঁটি করছে। বিল্ডিং এর আশপাশে অনেক সরু রাস্তা যেন পুরান ঢাকার গলি। ওইসব পথ দিয়ে হেঁটে যেতে অদ্ভুত সুন্দর লাগে। বেড়ানোর দিন খোলা বাজার বসেছিল প্রাগ শহরে। ঘুরে ঘুরে দেখে নিলাম ওদের লোকাল কৃষি পণ্য। ফিশ বা মাছ রেস্তুরা আছে চার্লস ব্রিজের পাশেই। ক্ষুধা লাগলে খেয়ে নিতে পারেন।

অনেক মডার্ন আর্ট চোখে পড়ে রাস্তার পাশে। কাঠের তৈরি অথবা স্টিলের তৈরি অনেক ভাস্কর্য,  আর্ট আপনার মন কেড়ে নিবে। হঠাৎ রাস্তায় দেখি রিকশা। প্রাগে রিকশার দেখা পাব ভাবিনি। দেখেই ঢাকা শহরের কথা মনে পড়ে গেল। দিনের বেলার প্রাগের কথা যত না শুনেছি, রাতের বেলার প্রাগের কথা তার চেয়ে বেশি শুনেছি। রাতে প্রাগকে নাকি অদ্ভুত সুন্দর লাগে। সত্যিই সুন্দর রাতের দেখা পেলাম প্রাগে। রাতের অন্ধকারে চার্লস ব্রিজের সৌন্দর্য যেন কয়েকগুন বেড়ে যায়। ব্রিজের বাতিগুলোর আলো নদীর পানিতে যেন আনন্দের মূর্ছনা ফেলে। নদীর পাশে বসে এককাপ কফি না খেলে কি আর চলে?

ফেরত আসার সময় একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি তখন বাসে ঘুমাচ্ছি। হঠাৎ পুলিশ এসে আমাকে ঘুম থেকে তুলে পাসপোর্ট নিয়ে গেলো একটু পর ফেরত দেওয়ার কথা বলে। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। পাশের যাত্রীদের জিজ্ঞেস করে জানলাম তাদেরটাও নিয়ে নিয়েছে। এইরকম অবস্থায় মধ্যরাতে হঠাৎ অচেনা এক জায়গায় পুলিশের পাসপোর্ট নিয়ে  যাওয়াটা আমার জন্য ভনায়ক ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যাই হোক, বেশ কিছুক্ষণ পর পুলিশ 'দুঃখিত' বলে হাসিমুখে পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে গেল। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।

আপনি না চাইলে প্রাগ আপনাকে ছাড়বে না। আমাকেও ছাড়েনি। আবার শান্তির ঘুম দিয়ে নিলাম। কিন্তু ঘুমের মধ্যেও চোখে ভাসছিলো প্রাগের উজ্জ্বলতা।

লেখক: পর্যটক ও গবেষক

ইমেইল: debashisemp@gmail.com

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!