অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে প্রতি শহরতলী থেকে শহর গড়ে তোলা হয়েছে। গ্রাম বা শহুরে জীবনযাপনে আহমরি তফাৎ চোখে পড়ে না এদেশে। আগুন্তুক হিসেবে আমি যা দেখতাম তাতেই মুগ্ধ হতাম। তবুও দিন শেষে কোথায় যেন অতৃপ্তি। ছোট্ট যে শহরে আমি ছিলাম আশপাশে কোনো বাঙালি ছিলো না। মাইলখানেক দূরত্বে কয়েকটি বাংলাদেশি পরিবার বাস করতো। মাঝেমধ্যে দেখা হতো। একেবারেই ছোট পরিসরে আয়োজিত হতো দেশিয় উৎসব-পার্বন।
ওখান থেকে বাণিজ্যিক নগরী সিডনির দূরত্ব পাঁচশ মাইল। অস্ট্রেলিয়ায় সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশিদের বসবাস সিডনিতে। বৃহৎ পরিসরে বিস্তৃত বাঙালি কমিউনিটি। কমিউনিটি প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানতে পারি বাংলাদেশিদের উদ্যোগ-অংশগ্রহণে নানা সাংস্কৃতিক-সামাজিক কর্মকাণ্ড। সেসব আমাকে আপ্লুত করতো তখন। গভীরভাবে উপলদ্ধি করতাম একটি জাতির আত্মপরিচয়ের বহিঃপ্রকাশের প্রধান মাধ্যম তার মাতৃভাষা।
প্রবাসে আমাদের সন্তানরা আধো বাংলা-ইংরেজি মিশ্রনে কথা বলে। কতটা শ্রুতিমাধুর্য সে হিসাব বড়ই গড়মিলে। শঙ্কিত হই এই ভেবে যে তৃতীয়-চতুর্থ বা পরের প্রজন্ম গল্পের ছলে না বলে বেড়ায়, ‘আমাদের পূর্বপুরুষদের ভাষা ছিল বাংলা এবং একদিন আমরা বাঙালি ছিলাম’!
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে একটি গান খুব শোনা হতো তখন, ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে। স্মৃতি যেনো আমার এ হৃদয়ে বেদনার রঙ্গে রঙ্গে ছবি আঁকে’। পরবর্তীতে সিডনিতে স্থায়ী বসবাস শুরু। সিডনি বাঙালি কমিউনিটিতে নিজেকে সম্পৃক্ত করা। এরই মধ্যে কমিউনিটির বিভিন্ন কাজে যথাসাধ্য সহযোগিতা করে যাচ্ছি, যাবো।
গত এক দশকে একজন প্রবাসী হিসেবে আমি দেখছি, বাংলাদেশিরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই বসবাস করছেন, অবধারিতভাবেই সেখানে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন সংগঠন-প্রতিষ্ঠান। শুধু বিদেশে থেকে দেশিয় রাজনৈতিক কোন্দল-দলাদলির ঘটনা-রটনার বাইরে অন্যান্য কর্মকাণ্ড প্রশংসনীয়। যেমন জাতীয় দিবস উদযাপন, উৎসব-পার্বণ ও দেশজ সংস্কৃতির চর্চা-প্রসার। তাই বিদেশ বিভূঁইয়ে নবপ্রজন্মের মধ্যে নিজ মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা ও প্রসারে সাংগঠনিক ভূমিকাকে অস্বীকার করা উচিত নয়।
প্রায় পঞ্চাশ-ষাট দশকের সিডনি বাঙালি কমিউনিটি এখন অনেক বেশি বিস্তৃত। সাংস্কৃতিক বিস্তৃতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। সম্প্রতি সংযোজন হয়েছে মঞ্চনাটক । মঞ্চনাটক এর আগেও প্রদর্শিত হয়েছে সিডনির মঞ্চে। তবে গত কয়েক মাসে পরপর প্রদর্শিত হয়েছে ভিন্ন সংগঠন আয়োজিত মঞ্চনাটক- দর্শক চাহিদার কারনে কোনটি দ্বিতীয়, তৃতীয়বারও মঞ্চস্থ হয়েছে।
নাটকটি লিখেছেন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি নাট্যকার বেলাল হোসেন ঢালী। রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। গত ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮ সিডনির ব্যাংকস টাউনের ব্রায়ান ব্রাউন থিয়েটারে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়।
ইন্দোনেশিয়া থেকে সমুদ্রপথে ট্রলারে করে অস্ট্রেলিয়ায় আসা একদল শরণার্থীর কর্মকাণ্ড ফুটিয়ে তুলেছেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বসবাসরত স্থানীয় বাংলাদেশি শিল্পীরা। সমুদ্রযাত্রা ও বেআইনিভাবে অস্ট্রেলিয়া প্রবেশের গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে নাটকটি। নাটকটিতে অভিনয় করেছেন- মো. আবদুল কাউয়ুম, ফজলুল হক শফিক, রহমত উল্লাহ, নুরে আলম লিটন, হাবিবুর রহমান হাবিব, কামরুল ইসলাম, আমেনা আক্তার সাগর, মেরিনা জাহান ও মো. মাসুদুর রহমান।
এর আগে সিডনিতে বেলাল হোসেন ঢালীর রচনায় ও নির্দেশনায় ‘সিটিজেন’, ‘আদমখানা’ ও ‘বিদ্রোহী’ নাটক মঞ্চায়নের পর দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
বেলাল ঢালীকে ধন্যবাদ সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত জীবনযুদ্ধের গল্প তুলে ধরার জন্য। ব্যক্তিগতভাবে আমার সুস্পষ্ট কোনো ধারণাই ছিলো না, রিফিউজি বা শরণার্থীদের সম্পর্কে। ঘটনা প্রবাহে হাস্যরসাত্মক সংলাপগুলো কঠিন জীবন সংগ্রাম সহজ করে তুলেছে। দর্শকদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। মঞ্চসজ্জায় ছিলেন পরিচিত মুখ লরেন্স ব্যারেল। সবকিছু মিলিয়েই পরিচ্ছন্ন ছিলো নাটকটি।
বিনোদনের মাধ্যমে কমিউনিটি-সমাজে যদি ম্যাসেজ দেয়া যায় সেটা গুরুত্ব বহন করে। এ নাটকটির মাধ্যমে অভিবাসন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাবেন শরণার্থীরা। এছাড়া আমার ব্যক্তিগত অভিমত সংগঠন-আয়োজক-উদ্যোক্তা সবার সহযোগিতায় অন্যান্য শাখায়ও সংযোজন হোক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, সেই সঙ্গে চর্চা হোক দেশিয় ভাষার। বাঙালি কমিউনিটি প্রভাব রাখুক মাল্টিকালচারাল এ মহাদেশটিতে।
শুভকামনা নাটকটির পরিচালক, কলাকুশলী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে। বিভ্রাটের কবল থেকে মুক্ত হোক রিফিউজিরা।
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |