মন্ট্রিয়লের গালগল্প: আ জার্নি বাই ট্রেইন টু নিউ ইয়র্ক

বিশ্বাস করুন আর নাই করুন - স্ট্যাচু অব লিবার্টির পাদদেশে দাঁড়িয়ে আমার বারাবার মনে পড়ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা ভবনের সামনে অবস্থিত অপরাজেয় বাংলার কথা। আর টাইম স্কোয়ারে গিয়ে মনে পড়ল ‘শালিক চত্বরে’র কথা। শালিক চত্বর আর এখন নেই।

হেলাল হোসেন ঢালীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Jan 2019, 12:13 PM
Updated : 6 Jan 2019, 12:14 PM

সেখানে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামজিক বিজ্ঞান অনুষদের ইট সিমেন্টের নান্দনিকতা বহির্র্ভূত এক বিশাল ইমারত। স্মৃতিসৌধ নয়, শহীদ মিনার নয়, টিএসসি মোড় নয়, আমার মনে পড়লো অপরাজেয় বাংলা আর শালিক চত্বরের কথা। খুব অবাক ঘটনা না হলেও এই মনে হওয়ার শানে নুযুলটা চমকপ্রদ। অবশ্য তা বোঝার জন্য এই গল্পের শেষতক অপেক্ষা করতে হবে।

অপেক্ষা সবসময় বিরক্তিকর হলেও কখনও কখনও মধুরও হয়। আমরা যখন নিউ ইয়র্কের ট্রেইনে ওঠার আগে চেক ইন এর জন্য বিশাল বড় লাইনে অপেক্ষা করছি, আমাদের তখন একটুও খারাপ লাগেনি। বরং ছাত্র জীবনে পড়া ‘নিউ ইয়র্ক’ কবিতায় নিউ ইয়র্কের যে রূপ বর্ণনা পেয়েছি সেই রূপ স্বচক্ষে দেখার আকাঙ্ক্ষা বিরক্তিকর অপেক্ষাও মধুময় হয়ে উঠেছিল।

আমাদের দলে ছিলাম চারজন: আমার মেয়ে অণুভা, ছেলে অরিত্র, স্ত্রী তানিয়া, আর আমি। আমরা চারজনই ছিলাম ভীষণ উচ্ছ্বসিত কিন্তু প্রত্যেকের উচ্ছ্বাসের কারণ আলাদা। এই যেমন আমি উচ্ছ্বসিত ছিলাম আলো এবং কাচে ঘেরা রাতের নিউ ইয়র্ক দেখবো বলে। তানিয়ার উচ্ছ্বাসের কারণ ওর চাচা-চাচী, ফুপু, মামা-মামী, চাচাতো, ফুপাতো ও মামাতো ভাই-বোনদের সাথে দীর্ঘদিন পর দেখা হবে সেই আনন্দে। অরিত্র উচ্ছ্বসিত তার বহুল আকাঙ্ক্ষিত সেন্ট্রাল পার্ক জ্যু তে যেতে পারবে সেই খুশিতে। মাদাগাস্কার শিরোনামের একটি অ্যানিমেটেড সিনেমা দেখে ওর ধারণা হয়েছে যে মাদাগাস্কারের সিংহটার সাথে সে সেন্ট্রাল পার্ক জ্যুতে গিয়ে দেখা করতে পারবে এবং মাদাগাস্কারের গল্পটা ওই সিংহের কাছ থেকে আবার শুনতে পারবে। অণুভা ঠিক কারণে উচ্ছ্বসিত তা স্পষ্ট না হলেও সে আমাদের সাথে যেতে পারছে এই আনন্দেই আহ্লাদে আটখানা।

অণুভার নিউ ইয়র্ক যাত্রার সুনির্দিষ্ট কোন কারণ ছিলনা বলে কিনা জানিনা, ট্রেইনে ওঠার জন্য আমাদের মধুময় ওর কাছে বিষময় হয়ে উঠেছিল। অণুভা সেই বিষ আমাদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার আগে আমাদের উদ্ধার করলেন অ্যামট্রাক  (ট্রেইনের নাম) এর একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা। তিনি আমাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চেক ইনের ব্যবস্থা করে দিলেন এবং আমরা পেলাম ট্রেইনের সবচেয়ে সেরা চারটি সিট।

অণুভা এবং অরিত্র - এই দুই ভাই-বোনের জন্য আরও কতজায়গায় যে সুবিধা পেয়েছি তার কোনও ইয়ত্তা নেই। এই যেমন তানিয়া, অরিত্র আর অণুভার আমেরিকান অ্যাম্বেসিতে ভিসার জন্য সাক্ষাৎকারের দিন ভিসা অফিসার গুরু-গম্ভীর কণ্ঠে বিভিন্ন প্রশ্ন করার এক পর্যায়ে জানতে চাইলেন যুক্তরাষ্ট্রে আমরা কোথায় যেতে চাই। আমি উত্তর দিলাম- ‘নিউয়র্ক’। অরিত্র সাথে সাথে বলে উঠলো - বাবা, এটা নিউয়র্ক না, নিউ ইয়র্ক।

ভিসা অফিসার ভদ্রলোক হেসে দিলেন। আমাকে বললেন – ‘তোমার ছেলের সামনে তুমি সাবধানে কথা বলবে, অন্তত ভুল উচ্চারণে কিছু বলবে না।‘ মুহূর্তের মধ্যে গুরু-গম্ভীর পরিবেশ হালকা একটা পরিস্থিতিতে রূপ নিল। ভিসা অফিসার জানিয়ে দিলেন – ‘তোমাদের ভিসা হয়ে গেছে, দু/তিন দিনের মধ্যে পাসপোর্ট পেয়ে যাবে।’

তাই প্রায়ই বাচ্চাদের কারণে নানান সুবিধা পাই বলে তাদের বাহানাও কম সহ্য করতে হয়না। এই যেমন ভয়ে ছিলাম - দশ/এগারো ঘণ্টার ট্রেইন ভ্রমণ এরা কিভাবে নেয়। উড়োজাহাজে যাওয়া যেত। কিন্তু আমি ট্রেইন পছন্দ করেছি তিনটি কারণে: এক. উড়োজাহাজে ভাড়া বেশি; দুই. বিমানে আশপাশের কিছুই দেখা যায়না যা  ট্রেইনে গেলে দেখা যায়; তিন. উড়োজাহাজে ভ্রমণ আমি খুবই ভয় পাই। যদিও উড়ো জাহাজ অন্য যে কোনও বাহনের চেয়ে নিরাপদ। কিন্তু আমার সবসময় মনে হয় উড়োজাহাজের কিছু হলে আমার বাঁচার কোনও সম্ভাবনাই থাকবেনা। ট্রেইন, বাস কিংবা জাহাজ হলে কিছুটা হলেও আশা থাকে।

উড়ো জাহাজে যেতে হবে এই ভয়ে আমার সুপারভাইজার ফান্ডিং দিবেন জেনেও মেক্সিকোর কানকুন এবং ভ্যানকুভারে অনুষ্ঠিতব্য দুটি কনফারেন্সের জন্য লেখা জমা দেই নি। কিন্তু সানফ্রান্সিসকো থেকে মনে হয় রেহাই পাবনা, কারণ সেখানে ইতিমধ্যে আমার একটি লেখা গৃহীত হয়েছে। আমাকে উপস্থাপন করতেই হবে। খোঁজ খবর নিচ্ছি সানফ্রান্সিসকোতে অনুষ্ঠিতব্য কনফারেন্সে ট্রেইনে বা বাসে যাওয়া যায় কিনা। অবশ্য উড়োজাহাজ ছাড়া সানফ্রান্সিসকোতে যাওয়া সহজ হবে না বলেই মনে হচ্ছে। তবে নিউ ইয়র্ক বেশ কাছে। তাই ট্রেইনই বেছে নিয়েছি। অবশ্য আমার এই ট্রেইন প্রীতিতে ছেলে-মেয়েরা প্রথম দিকে বিরক্ত হলেও আমার এবং তানিয়ার (আমার স্ত্রী) মুগ্ধ নয়ন দেখে ওরাও ট্রেইনে মজা করা শুরু করে দিল। কিন্তু বিপত্তি হলো অন্য জায়গায়, খাবার নিয়ে।

ট্রেইনের খাবারের খুব দাম, তা আগেই জানা ছিল। তাছাড়া পশ্চিমা ট্রেইনের খাবারের মেন্যু কি না কি থাকে, তা নিয়ে একধরণের সংশয়তো ছিলই। তাই বাসা থেকে সবরকমের খাবারই নিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু ট্রেইনের ক্যাফেটেরিয়া থেকে আসা খাবার এবং কফির গন্ধের কাছে আমাদের নিয়ে আসা খাবার নস্যি মনে হচ্ছিল। উত্তরোপনিবেশিক নানান তত্ত্ব দিয়ে নিজেকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছি - ওদের খাবারের গন্ধ বেশি ভাল লাগলেও আসলে তা অত ভাল নয়। এগুলো বিজ্ঞাপন এবং আমাদের শিক্ষণের ফল। কিন্তু খাবারের গন্ধে উত্তরোপনিবেশিক সব তত্ত্ব পরাজিত হলো এবং আমরা যথারীতি আমাদের সাথের খাবার রেখে ট্রেইনের খাবারই কিনলাম। কিন্তু যেই না ওই খাবার মুখে দিয়েছি তখন সব উত্তরোপনিবেশিক তত্ত্বের প্রবক্তাদের মনে মনে আবার সালাম ঠুকে বললাম – ‘গুরুবাক্য শিরোধার্য’।

ট্রেইন ছুটে চলেছে কখনো বিস্তির্ণ মাঠের ভিতর দিয়ে, কখনে নদীর পাশ দিয়ে, কখনো পাহাড়ের ঢালু দিয়ে, ওপর দিয়ে, কিংবা পাহাড় কেটে বানানো সুড়ঙ্গ দিয়ে। মাঠগুলো শাদা তুষারে আচ্ছন্ন। কোথাও কোথাও নদীর পানি বরফ হয়ে শাদা তুষারে আচ্ছন্ন বিস্তির্ণ প্রান্তরের মত দেখাচ্ছে। গাছগুলো সব পাতাশূন্য। পাতাশূন্য গাছ দেখে আমার মেয়ের সে কি দুঃখ!

আমাদের আনন্দময় ট্রেইন ভ্রমণ সবসময় আনন্দময় ছিল তা নয়। ইমিগ্রেশনের জন্য দু ঘণ্টা ট্রেইন দাঁড়িয়েছিল। তবু ভালো আমাদের নামতে হয়নি, ইমিগ্রেশন অফিসাররাই ট্রেইনে এসেছিল। দুই ঘণ্টা তবু সওয়া যায়, নিউ ইয়র্ক থেকে ফেরার পথে ইমিগ্রেশনে নিয়েছিল চার ঘণ্টা। এই চার ঘণ্টার অপেক্ষা আমাদের নিউ ইয়র্ক ভ্রমণের সব আনন্দ প্রায় ভুলিয়ে দিয়েছিল।

নিউ ইয়র্কে আমরা অসম্ভব মজা করেছি। প্রথম মজা পেয়েছি - আমরা কোন বাসায় উঠবো সেটা নিয়ে তানিয়ার ফুপাতো বোন, মামী, আর চাচীর টানাটানিতে। ট্রেইন স্টেশন থেকে আমাদের নিতে এসেছিলেন আমিন দুলাভাই (তানিয়ার ফুপাতো বোন সীমা আপার বর)। আমিন ভাই অসম্ভব আন্তরিক। দেশের রাজনীতি নিয়ে তিনি এত বেশি আবেগপ্রবণ যে, মাঝেমধ্যে তার সাথে আমার তর্কই লেগে যেত। তার সাথে আমার রাজনৈতিক বিতর্কের আপাত বিরতি ঘটেছিল নিউ ইয়র্কে যাওয়ার দ্বিতীয় দিনে মামী এসে আমাদেরকে তাদের বাসায় নিয়ে যাওয়ার সময়। দ্বিতীয় দিনেই মামীর বাসায় যাওয়ার কারণে ফুপু, সীমা আপা, আমিন ভাই এবং ছোট্ট আলিশার অসম্ভব মন খারাপ। কিন্তু কি আর করা! বেড়ানোর মত অন্তত চার বাসা অথচ আমাদের সময় মাত্র সাত দিন। তাই সীমা আপার বাসা থেকে আমরা চলে গেলাম ব্রংসে মামার বাসায়। মামার বাসার সুবিধা হলো এখানে অষ্টম তলায় মামার বাসা, দশম তলায় জিয়া চাচার বাসা, তিন মিনিট পর মণি কাকার বাসা। মামার বাসা মাঝখানে থাকায় প্রতিদিন সবার সাথেই দেখা হতো। আমরা যাব বলে জিয়া কাকা আগেই ছুটি নিয়েছিলেন, মামা তার ম্যানেজারের ওপর ওই কয়েকদিনের ব্যবসার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, আর আমিন ভাইর ফার্মে এখন কোনও কাজ নেই বলে তিনি সার্বক্ষণিক সময় দেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন।

আমরা তাদের এই আয়োজনকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পেরেছিলাম। মামাদের সাথে গেলাম সেন্ট্রাল পার্ক জ্যুতে। ফারহান, ইরফান, অরিত্র, অণুভার সে কি আনন্দ। সাথে হাসিন (তানিয়ার আরেক চাচাতো বোনের ছেলে) থাকায় বাচ্চারা একজন যথার্থ সঙ্গী পেল যে সবকিছু খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছিল। অরিত্র অবশ্য হতাশ হয়েছিল মাদাগাস্কারের সিংহের সাথে দেখা না হওয়ায়। বেচারা সিংহ ওই সময় ওখানে ছিলনা। তবে সিংহ না দেখার দু:খ ঘুচলো ‘দ্য পোলার এক্সপ্রেস’ নামের চতুর্মাত্রিক একটি সিনেমা দেখে। অণুভা অবশ্য প্রথমে ভয় পেয়েছিল। কিন্তু পরে দেখা গেল ও আর চশমা খুলছেই না; সিনেমা শেষ হওয়ার পরেও না।

জিয়া কাকা নিয়ে গেলেন কানেক্টিকাটের নিউ লন্ডন এবং মহিগান সানে। সাথে রাওদা মণি (চাচাতো বোন) থাকায় রাওদা আর অণুভার এই মেঘ এই রৌদ্র ভাব আমাদের জন্য ছিল আরেক বিনোদন।  রূহান এবং রূহামা (চাচাতো ভাই ও বোন) হাসিনের মোবাইলে গেইম খেলায় ব্যস্ত থাকলেও নিউ লন্ডনের ছোট্ট সমুদ্র সৈকতে এই ঠাণ্ডার মধ্যেও আমাদের সাথে নামতে ভুল করেনি। আটলান্টিকের পাড় বলে কথা! তাপমাত্রা যদি মাইনাসও হতো তাও আমরা নামতাম। ছবি তোলার জন্য হলেও নামতাম। কিন্তু আমাদের ভাগ্য এত ভাল ছিল যে, ওইদিন তাপমাত্রা ছিল প্লাস দশের ওপরে। নিউ লন্ডন থেকে আমরা গেলাম মহিগান সানে। বিশাল ক্যাসিনো সেন্টার। ক্যাসিনোতে দাঁড়ানোর সুযোগ আর পেলাম না। রূহান আমাদের কে টেনে নিয়ে গেল বাচ্চাদের খেলার জায়গা আর্কেডে। হরেকরকম বাহারি সব আয়োজন। মোশন রাইড এবং মটর সাইকেল রেইসের লোভ আমিই সামলাতে পারলাম না, বাচ্চাদের কথা কি বলবো!

স্ট্যাচু অব লিবার্টি দর্শনে বাচ্চাদের খুব আগ্রহ ছিল বলে মনে হয়না। তবুও আমাদের বহর অনেক বড় হয়ে গেল। আমরা চারজন, মামা-মামী-ফারহান-ইরফান, রূহামা, রাইসা, এবং মুনিয়া সহ প্রায় এগারো জনের দল। স্ট্যাচু অব লিবার্টি স্মৃতিস্তম্ভটি একটি দ্বীপে অবস্থিত। হাডসন নদীর মাঝখানে অবস্থিত ওই দ্বীপের নাম ছিল বেডলো আইল্যান্ড। ১৯৫৬ সালে সালে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় লিবার্টি আইল্যান্ড। ফরাসি ভাস্কর ফ্রেডরিক অগাস্তে বারথোল্ডির নকশাকৃত কপারের তৈরি এই ভাস্কর্যটি মূলত মার্কিন জনগণকে দেয়া ফ্রান্সের জনগণের এক অনন্য উপহার। স্ট্যাচু অব লিবার্টির প্রতি যে মোহ ছিল তা কাছে গিয়ে কেটে গেল। আমাদের বেশি ভাল লাগলো যাওয়া আসার পথেই। ব্যাটারি পার্ক থেকে হাডসন নদী দিয়ে স্ট্যাচু অব লিবার্টি আইল্যান্ডে যাওয়া আসার সময় নদীতে বয়ে যাওয়া বাতাস আর এলিস আইল্যান্ডে ক্ষণিকের বিরতিতে আমেরিকায় অভিবাসীদের আসার ইতিহাস সম্বলিত যাদুঘর ও একটি ডকুমেন্টারি দেখে আমাদের স্ট্যাচু অব লিবার্টি ভ্রমণ সার্থক হলো। সত্যিকথা বলতে স্ট্যাচু অব লিবার্টি যে বার্তা দেয়, তার চেয়ে ঢের বেশি শক্তিশালী বার্তা দেয় আমাদের অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্য। স্ট্যাচু অব লিবার্টি যে প্রজ্বলিত শিখা আঁকড়ে ধরে আছে তা মুক্তির বার্তা দিলেও মানুষ কি আসলে এখনো মুক্ত হয়েছে? বরং মানুষের মুক্তির সংগ্রাম এখনো চলমান। আমাদের অপরাজেয় বাংলা সেই বার্তাই দিয়ে যাচ্ছে।

শুধু বার্তা দিয়ে যে জীবন চলেনা তা আমাদের পেট বারবার জানান দিয়ে যাচ্ছিল। অগত্যা স্ট্যাচু অব লিবার্টি থেকে ফেরার পথেই গেলাম দিল্লী মাসালায়। দিল্লী মাসালা ওয়েস্ট ১২৪ স্ট্রিট এবং উইলিয়াম লি বোনার স্কোয়ারের কোনায় অবস্থিত একটি ভারতীয় খাবারের রেস্টুরেন্ট। এখানকার গ্রিল্ড স্যামন, ডাল মাখানী এবং চিলি চিকেন না খেলে নিউ ইয়র্কে আসাই বৃথা। কি সাদা, কি কালো, কি এশিয়ান, কি আফ্রিকান, কি ইন্ডিয়ান সব রকমের ভোজন রশিকদের মিলন মেলা এই রেস্টুরেন্ট। কেউ নিউ ইয়র্কে আছেন, কিংবা নিউ ইয়র্কে বেড়াতে গেছেন অথচ দিল্লী মাসালার খাবার খাননি এমনটা পাওয়া দুষ্কর। যদি কেউ এই রেস্টুরেন্টে না খান, তাদের নিউ ইয়র্কে থাকা বা আসাই বৃথা। বিশ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে এই রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া তাই বৃথা হলোনা। তবে সবকিছুর উর্দ্ধে মামা, চাচা ও ফুপুর বাসার খাবারের কথা ভোলার নয়। আমিন ভাই এবং মাহমুদা ভাবীর বাসায় নানান পদের দেশি খাবার আর পলি আপার সরপুটি এখনো মুখে লেগে আছে।

নিউ ইয়র্কের আরো দু একটি রেস্টুরেন্টেও অবশ্য খেয়েছি। বিশেষ করে কস্তুরীর চা আর ইত্যাদির সিঙ্গাড়ার কথা ভোলার নয়। জ্যাকসন হাইটসে গিয়েছিলাম কয়েকটি বাংলা বই কিনতে। তখনই ইত্যাদিতে ঢুকে ছিলাম। জ্যাকসন হাইটে এত বড় একটা বাংলা বই এর দোকান দেখে মন ভরে গেল। নাম মুক্তধারা। দোকানে ঢুকে দেখা হলো বিশ্বজিত সাহার সাথে। ভদ্রলোক কথা বলেন শুদ্ধ বাংলায়। বইও লিখেছেন বেশ কয়েকটি। গল্পচ্ছলে জানালেন উনারা এখানে নিয়মিত বইমেলার আয়োজন করেন। জানালেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্বীকৃতি ও পালনে উনাদের সক্রিয় ভূমিকার কথা। আসার সময় কি মনে করে যেন আমাকে একটি স্মরণিকাও উপহার দিলেন।

নিউ ইয়র্কে এসে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে যাবনা, এ কথা ভাবতেই মনটা কেমন খচখচ করছিল। আমিন ভাইকে নিয়ে তাই চলে গেলাম জাতিসংঘ সদর দপ্তরে। ছুটির দিন এবং রাত থাকায় অফিস বন্ধ, তাই বাইরে থেকেই একটা ছবি তুলে নিলাম। ফেরার পথে আমিন ভাই টাইম স্কোয়ারে নিয়ে গেলেন। আলো ঝলমলে টাইম স্কোয়ারের সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছিল। আগের রাতেই ছিল থার্টি ফার্স্ট নাইট। তাই সবকিছু কেমন যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। মনে পড়লো শালিক চত্বরের কথা। শালিক চত্বর এখন আর নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনের খোলা চত্বরের নাম দিয়েছিলাম শালিক চত্বর। এখন যেখানে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ভবন। প্রায় পনের বছর আগে শালিক চত্বরে আমরা প্রথম বাংলা নববর্ষ উদযাপন করেছিলাম। একটি যাত্রার আয়োজন করেছিলাম। ওখানেই তানিয়ার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল। আজ তানিয়া আর আমি নিউ ইয়র্কের টাইম স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে আছি। ভাবতেই মন ফুরফুরে হয়ে গেল।

সোহেলী আপার (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সাবেক সভাপতি) বাসায় যেদিন যাওয়ার কথা, সেদিনই খবর পেলাম তানিয়ার সেজো চাচী হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা গেছেন। দু:খজনক হলো উনি কোনও চিকিৎসাই পাননি। বাংলাদেশে ওইসময় নির্বাচন থাকায় হাসপাতাল ক্লিনিকে কোনও চিকিৎসকই ছিলেন না। মাঝে মাঝে ভাবি আমাদের দেশের মানুষ এই বিষয়গুলো কবে ঠিক করবে। চাচীর মৃত্যুতে আমাদের সবার মন খারাপ। আমাদের অনেক পরিকল্পনা বাদ দিলাম।

লেখক:

পিএইচডি গবেষক, ফ্যাকাল্টি অব এডুকেশন, ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়, মন্ট্রিয়ল, কানাডা।

ইমেইল: helaldhali@gmail.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!