প্রবাসীর ভ্রমণ: ইউরোপের রাজধানী বেলজিয়াম দেখা

বেলজিয়াম পশ্চিম ইউরোপের ছোট একটি দেশ। কিন্তু এ দেশের গুরুত্ব একেবারেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। আর ফুটবল বিশ্বকাপে বেলজিয়ামের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কথা কি আর ভুলে থাকা যায়?

দেবাশিস সরকার, অস্ট্রেলিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Jan 2019, 11:38 AM
Updated : 2 Jan 2019, 11:38 AM

ইউরোপের বড় বড় সব প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর বেলজিয়ামে অবস্থিত। যেমন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট ও ন্যাটো ইত্যাদি। বেলজিয়াম ইউরোপের কেন্দ্রস্থল। তাই বেলজিয়ামকে ইউরোপের রাজধানী হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। এক কোটির কিছু বেশি মানুষ আর ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটারের কিছু বেশি জায়গার দেশ বেলজিয়াম। এ পরিসংখ্যান থেকেই বুঝতে পারছেন বেলজিয়ামের অবস্থান।

বেলজিয়ামের ভিসা পাওয়া ওই দেশের সরকারের আমন্ত্রণ ছাড়া একটু জটিল। তবে আপনি বিভিন্ন শর্ট কোর্সের জন্য বৃত্তি নিয়ে সহজেই যেতে পারেন। এখন অনেক বাংলাদেশি ছাত্র পড়াশোনার জন্য বেলজিয়াম যাচ্ছেন। বেলজিয়াম বেড়াতে গেলে আপনি খুব সহজেই চারটি দেশ ঘুরে আসতে পারবেন। কারণ এ দেশের বর্ডার নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, জার্মানি আর লুক্সেমবার্গের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

বেলজিয়ামের কয়েকটি শহর বেশ বিখ্যাত। তার মধ্যে রাজধানী ব্রাসেলস, অন্টারপন, ব্রুজ, ঘেন্ট, লিয়েশ ও মন্স অন্যতম। একেকটা সিটি দেখতে একেক রকম সুন্দর। পর্যটকরা মূলত সব সিটিতে ঘুরতেই পছন্দ করেন। ব্রাসেলস থেকে খুব সহজেই ট্রেনে করে সব সিটিতে যাওয়া যায়। বরফ দেখতে চাইলে বেলজিয়ামের জুড়ি নেই। বেলজিয়াম বেড়াতে গেলে ইউরোপের প্রায় সব দেশের লোকজনের সঙ্গেই আপনার দেখা হবে। এ দেশের লোকজন ফরাসি ভাষায় কথা বলেন। তাছাড়া জার্মান বা ডাচ ভাষাও চলে। তাই যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটু সমস্যা হতে পারে, কিন্তু বড় বড় সিটিতে সবাই কম বেশি ইংরেজি বলতে পারেন। ইউরোপিয়দের ইংরেজি উচ্চারণ শুনতে বেশ মজাই লাগে! তাই কথা বলতে কৃপণতা করবেন না।

বেলজিয়ামের রাণী মাথালির সঙ্গে তিনবার দেখা হওয়ার সুযোগ হয়েছিল ক্ষুদ্রঋণের উপর বিশেষ ক্লাসে। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বাংলাদেশ সম্পর্কে। তিনি বললেন, প্রফেসর ইউনুস তার ভালো বন্ধু এবং বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণের ভূমিকার কথা। শুনে ভালোই লাগলো।

বিয়ার আর চকলেটের দেশ বেলজিয়াম। অসংখ্য ভ্যারাইটিজের বিয়ার আর চকলেট পাওয়া যায় এখানে। প্রায় আটশ প্রকারের বিয়ার রয়েছে বেলজিয়ামে। রাস্তার আশপাশে প্রায় সব জায়গায়তেই পানীয়ের দোকান। বেলজিয়ানদের বিয়ার প্রীতি দেখলে অদ্ভুত লাগে। সকালে আপনি হাঁটছেন তো দেখবেন কেউ কেউ বিয়ারের দোকানে বড় বড় গ্লাসে বিয়ার পান করে সকালের নাস্তা করছে। কোথাও খেতে বসলে কয়েক প্রকারের বিয়ার না হলে ওদের হয়ই না। প্রতি বছর প্রায় আড়াই লাখ টনের বেশি চকলেট তৈরি হয় বেলজিয়ামে।

বেলজিয়ামে বেড়ানোর একটি সুন্দর জায়গা হচ্ছে ‘অটোমিয়াম’। ১৯৫৮ সালে ব্রাসেলস ওয়ার্ল্ড ফেয়ার এক্সপো এর জন্য এটি স্থাপন করা হয়েছিল। টিকেট কেটে ১০২ মিটার উঁচু অটোমিয়ামের উপরে উঠে ব্রাসেলস শহর দেখতে অদ্ভুত সুন্দর দেখায়। সিটি সেন্টার বা গ্রান্ড প্যালেস হচ্ছে বেলজিয়ামের বিখ্যাত টুরিস্ট স্পট। গ্রান্ড প্লেস সারা বছর পর্যটকদের ভিড়ের মধ্যেই থাকে। এখানে আপনি ১০ শতক থেকে শুরু হওয়া দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য সমৃদ্ধ অসাধারণ স্থাপত্য দেখতে পারবেন।

রাতের বেলা যখন বিভিন্ন রঙে গ্রান্ড প্লেসকে রাঙিয়ে তোলা হয় সেটা দেখার মজাই আলাদা। এটার পাশেই অনেকগুলো খাবারের দোকান আছে। আপনি চাইলেই বেলজিয়ামের খাবারের স্বাদ নিতে পারবেন। সেই ১৯৭১ সাল থেকে প্রতি ২ বছর পর পর এ প্লেসের ফাঁকা জায়গায় প্রায় শ'খানেকের বেশি ভলান্টিয়ার ৭৫ মিটার লম্বা আর ২৪ মিটার প্রশস্ত ফুলের কার্পেট বানিয়ে বিছিয়ে রাখেন। এটা দেখার জন্য বিশ্বের মানুষজন সেখানে বেড়াতে আসেন।

ব্রাসেলসের একটি বিখ্যাত দর্শনীয় জিনিস হচ্ছে ‘মানকান পিস’। মানকান পিস হচ্ছে ব্রোঞ্জের তৈরি এক ছোট বালকের উলঙ্গ ছবি যে কিনা সারাদিন ধরে ঝর্নাতে প্রস্রাব করে যাচ্ছে। দেখতে অনেক ছোট হলেও তার গুরুত্ব সারা বিশ্বে অনেক। কারণ এ ছবি দেখলেই মানুষ ব্রাসেলসের কথা মনে করে। গ্রান্ড প্লেস হতে ৫ মিনিটের দূরত্বে এ মানকান পিস। বেলজিয়াম যে একটি আমোদপ্রিয় ও স্বাধীনচেতা মনের মানুষের দেশ সেটা এ স্থাপত্যশৈলী প্রকাশ করে।

ব্রাসেলসে রাজপরিবারের থাকার জায়গার যেনো অভাব নেই। অনেকগুলো রাজ্প্রাসাদ আছে যেগুলো দেখলে একদিকে যেমন নয়ন জুড়িয়ে যাবে তেমনি সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে যাবেন। তাছাড়া সুন্দর গোছানো পার্কে যখন ফুল ফোটে তখন আপনি বেড়াতে গেলে আপনার মনে হবে আপনার নিজের বাগানে বসে আছেন। তাছাড়া অত্যাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, উচ্চশিক্ষার জন্যও ব্রাসেলস বিখ্যাত। ইউনিভার্সিটি লিবার ডি ব্রাসেলস, ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি লুভেন বেলজিয়ামের বিখ্যাত কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। এগুলো ঘুরে দেখতেও আপনার ভালো লাগবে।

ছুটির দিনে ওপেন মার্কেট বসে এখানে। মানুষজন অনেক মজা করে বাজারও করে আবার খাবারও খায়। অনেকটা আমাদের দেশের মেলার মতো। সবজি থেকে সবকিছু পাওয়া যায়। অনেক এনটিক জিনিস পাওয়া যায় ওপেন মার্কেটে। এক বাংলাদেশি ভদ্রলোক দেখি পুরনো জিনিসপত্র নিয়ে বসেছেন বাজারে। তার সঙ্গে কথা বলে বাংলাদেশিদের সম্পর্কে জানতে পারলাম। বেলজিয়াম বেড়াতে গেলে আপনি ব্রুজ আর ওন্টারপন সিটি বেড়াতে ভুলবেন না। ব্রুজে যেমন আপনি অনেক খাল পাবেন যেগুলো বাসাবাড়ির মাঝপথ দিয়ে গেছে তেমনি ইউরোপের এক অসাধারণ রেলস্টেশন দেখতে পাবেন ওন্টারপন গেলে।

ভালো কথা, ওন্টারপন সিটিতে গেলে ডায়মন্ডের দোকান ভিজিট করতে ভুলবেন না। তাছাড়া মন্স সিটিতে যাওয়ার পথে বীরযোদ্ধা নেপোলিয়ান যেখানে জীবনের শেষ যুদ্ধে পরাজিত হন সেই ওয়াটারলুতেও বেড়াতে পারেন। বেলজিয়ামের মানুষও সাইকেল চালাতে পছন্দ করে।  সাইকেল ভাড়া নিয়ে আবার ঘুরে ফিরে জমাও দিতে পারবেন। আসলে উন্নত দেশের নাগরিক সুবিধা মানুষের জন্য অপেক্ষা করে, যে যার সুবিধামতো ব্যবহার করতে পারেন।

ফ্রেন্স ফ্রাই বা আলুভাজির কথা শুনলে মনে হবে এটা ফ্রান্সেই মনে হয় প্রথম চালু হয়। কিন্তু বেলজিয়ামের মানুষ গর্ব করে বলে এটা তাদের আবিষ্কার। বেলজিয়ামের সব জায়গাতেই আপনি এ ফ্রাই পাবেন। ক্ষুধা লাগলেই খেয়ে নিতে পারেন। অথবা বিখ্যাত ওয়েফারও খেয়ে দেখতে পারেন। তবে আমার হাঁসের মাংশ দিয়ে ফ্রাই খেতে খুব ভালো লেগেছিলো। ব্রাসেলস স্প্রাউট সবজি খেতে অসাধারণ লাগে। আর এটা প্রায় ৪০০ বছর ধরেই ব্রাসেলসে উৎপাদিত হয়।

ছোট দেশ হলে কি হবে, বৈচিত্র আর সৌন্দর্যের দিক থেকে অনেক বড় দেশ হচ্ছে এ বেলজিয়াম। আমাদের সবার প্রিয় ফিরোজ ভাইয়ের সহায়তায় বেলজিয়াম ঘুরে বেড়ানো কিংবা প্রিয় শাহাদাত ভাইয়ের নিজ হাতে রান্না করা সুস্বাদু বাঙালি খাবার আর আদরের ছোট ভাই নাসির, মানস আর মেজবাহের সঙ্গে দুষ্টামি করার আনন্দের কথা কিংবা বন্ধু মাহবুবের সঙ্গে ব্রুজ ঘুরে বেড়ানো, শাহাব ভাই, বন্ধু সুজন আর রিয়াজ ভাইয়ের সঙ্গে ওন্টারপনে সময় কাটানোর কথা ভুলে থাকা সত্যি অসম্ভব। এ যেন এক টুকরো বাংলাদেশ।

অবশেষে বেলজিয়ামের মায়া কাটিয়ে ট্রেনে করে চলে যাই ইউরোপের আরেক ছোট দেশ লুক্সেমবার্গে।

লেখক: পর্যটক ও গবেষক

ইমেইল: debashisemp@gmail.com

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!