তখন বাংলা নামের দেশটির পাশে দাঁড়ানোর অসাধারণ একটি উদাহরণ তৈরি হয়েছিল সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার তখন পাকিস্তানকেই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল। জুন মাসের দিকে নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি খবরে বলা হয়- পাকিস্তানি দুটি সামরিক জাহাজ যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলীয় বন্দরের দিকে আসছে অস্ত্র বোঝাই করার জন্য। এমনকি সেই অস্ত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে কংগ্রেসের কোনো অনুমোদন ছিল না বলেও খবরে প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে বাংলার মানুষের উপর চালানো নিপীড়ন নির্যাতনের চিত্রও উঠে আসে।
রিচার্ড কে টেইলর নামের এক তরুণের নেতৃত্বেই মূলত এই আন্দোলনটি গড়ে ওঠে। তখন ‘মুভমেন্ট ফর এ নিউ সোসাইটি’ নামে একটি সংগঠন করতেন তারা। তাদের উদ্যোগেই পড়ে গড়ে ওঠে ‘ফ্রেন্ডস অব ইস্ট বেঙ্গল’ নামে আরেকটি সংগঠন। সেখানে ছিলেন স্যালি উইলোবি, উইলিয়াম গ্রিনোউ, ইলিয়ট জেভিসের মতো মানবতাবাদী মানুষ। যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী সুলতানা আলম, মজহারুল হক, মোনায়েম চৌধুরীসহ অনেকে। যে আন্দোলন দাগ কেটেছিল আমেরিকানদের হৃদয়ে।
২০০৮ এর দিকে কাজটা অনেকটাই গুছিয়ে আনেন। এরপর নেন অনেকটা সময়। ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে ফাঁকে তিল তিল করে তারা পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ শেষ করে ২০১৬ সালের দিকে তা সবাইকে দেখার জন্য মুক্তি দেন। আর এরপর থেকে বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী হয়েছে যা রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রানসিসকোতে ২০১৭ সালের ওয়ার্ল্ড’স ইন্ডিপেনডেন্ট ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রামাণ্যচিত্র ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পেয়েছে এ তথ্যচিত্রটি।
সেদিনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া রিচার্ড কে টেইলরের লেখা বইটিতে দুটি ভাগ রয়েছে। প্রথম ভাগে কীভাবে তারা অহিংস আন্দোলন করে পূর্ব উপকূলের এক একটি বন্দরে অস্ত্র নিতে আসা পাকিস্তানি জাহাজ ভেড়া ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলে, তার বর্ণনা। দ্বিতীয় ভাগটি হলো ভবিষ্যতে যারা অহিংস আন্দোলন করবে তাদের জন্য একটি সহায়িকা।
বিশাল একটি জাহাজের পটভূমিতে প্রায় খেলনা নৌকার সাইজের কিছু ডিঙি নিয়ে রিচার্ড টেইলরদের ঘেরাও করার ছবি হৃদয় স্পর্শ করে যায়। তারা জাহাজকে ঘিরে রেখেছিলেন যাতে সেটি অস্ত্র নেবার জন্য ভিড়তে না পারে।
‘ব্লকেড’ ফিল্মটিতে কথা বলেছেন সেদিনের একজন আন্দোলনকারী সুলতানা আলম। চলচ্চিত্রটি থেকে জানা যায়, যখন বাংলায় গণহত্যা শুরু হলো দেশ থেকে দূরে থেকে কিছু করতে না পারার অনুশোচনা থেকে সুলতানা নিজের কাছে নিজে ওয়াদা করেছিলেন যে প্রতিদিন ১০০ জনকে ফোন করে জানাবেন কীভাবে ছবির মতো একটি সুন্দর দেশে রক্তগঙ্গা বয়ে যাচ্ছে। তিনি স্মৃতিচারণে বলছিলেন যুদ্ধশেষে দেশে ফিরে যখন দেখলেন, এক হিন্দু বন্ধু পরিবারকে তার বাবা-মা পুরো নয় মাস নিজেদের বাসায় লুকিয়ে ছিলেন; তখন তিনি তাদের জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। সুলতানা আলম সেদিন একটি উপমা ব্যবহার করেছিলেন, সেই হিন্দু বন্ধু পরিবারটি নাকি ছিল তাদের পারিবারিক ‘অ্যানা ফ্রাংক’।
ইলিয়ট জেভিস ছিলেন বন্দরের সেই সব শ্রমিকদের একজন যারা সবাইকে সংগঠিত করেছিলেন সেইসময়। শ্রমিকরা যেন কোন পাকিস্তানগামী জাহাজে অস্ত্র তুলতে রাজি না হয় তার জন্য প্রচারণা চালিয়েছিলেন তিনি। হাজার মাইল দূরে বন্দরে কাজ করা একজন শ্রমিক যখন ঠিক করে দরকার হলে সেদিন কম অর্থ আয় করবে, তবুও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র পাঠাতে দেবে না; এমন দৃশ্য হৃদয়ে নাড়া দিয়ে যায়।
আরিফ ইউসুফ জানান, সেদিন কীভাবে আন্দোলনটি গড়ে উঠেছিল, কী ছিল তার প্রতিক্রিয়া এসব কিছুই তুলে ধরা হয়েছে তথ্যচিত্রে। আর সেদিনের আন্দোলনকারীদের কাছ থেকে তিনি অনেকগুলো ছবি সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি বলেন, “কেবল নৌকা দিয়ে জাহাজকে আটকে দেওয়া হয়, ভেবে দেখুন বিষয়টি। জাহাজের সামনে নৌকা নিয়ে যারা নেমেছিলেন, তাদের মধ্যে একজন ছবি তুলছিলেন। তিনিই আমাকে পরে ৬০/৭০টি ছবি দিয়েছিলেন।”
তথ্যের পর তথ্য নয়, অনেকটা গল্প বলার মতো করে তথ্যচিত্রচটি নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাতা হিসেবে তার লক্ষ্য ছিল ৮৫ মিনিটের এ ফিল্মটি দেখতে বসে কেউ যেন মাঝ পথে উঠে না যায়। পুরো তথ্যচিত্র দেখার পর বিষয়টি অনুভব ও হৃদয়ে ধারণ করতে পারেন। সেই লক্ষ্যে কাজ করেছেন তিনি। আরিফ ইউসুফ জানান, মানুষ প্রশংসা করছে। তাদের ভালো লাগছে। এতে তার দায়িত্ব বেড়ে গেছে। ভবিষ্যতে করতে চান আরও অনেক কাজ।
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |