প্রবাসীর ভ্রমণ: মেলবোর্ন ঘুরে দেখা

ঘুরে এলাম মেলবোর্ন। ভিক্টোরিয়া প্রদেশের রাজধানী মেলবোর্ন। অন্যতম জনবহুল শহর। সিটি সেন্টার, ফেডারেশন স্কয়ার, ইউরেকা টাওয়ার, রাণী ভিক্টোরিয়া বাজার, মেলবোর্ন স্টার, রয়েল ইকজেবিশন ভবন এ শহরের অন্যতম সেরা স্থান।

মো. শফিকুর রহমান, অস্ট্রেলিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Dec 2018, 06:14 AM
Updated : 4 Dec 2018, 06:14 AM

সড়কে পথেই যাত্রা করেছিলাম। আমাদের বাসা থেকে মেলবোর্নের দূরত্ব ছিল ৮০০ কিলোমিটার। রাতের খাবার শেষ করেই শুরু করেছিলাম আমাদের পথচলা। চওড়া রাস্তায় গতিসীমা ছিল প্রতি ঘণ্টায় ১২০-১৪০ কিলোমিটার। রাস্তার দুই ধারে আছে সীমাহীন মাঠ, যেখানে দৃষ্টি শেষ হয়ে যাবে কিন্তু মাঠের সীমারেখা টানা মুশকিল। মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন পশুখামার। কিছু জায়গায় আছে পাহাড়ি রাস্তা। রাস্তাগুলোতে চলে বড় ধরনের লরি।

চলতে চলতে হঠাৎ দেখি পাহাড়ের উঁচু থেকে একটা বড় ঢেউয়ের মতো কী যেন নেমে আসছে, তখন মনে হচ্ছে কোনো ড্রোন আমাদের গাড়িতে আঘাত করবে। কিছুক্ষণ পরই তা ভুল মনে হয়েছে। আমাদের দেশে মহাসড়কের পাশে একটু পর পর দোকান এবং মানুষের উপস্থিতি দেখা যায়, এখানে তেমনটা নয়। ১০০ কিলোমিটার গেলেও মানুষের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তবে মাঝেসাঝে দেখা যায় ক্যাঙ্গারু ও কোয়ালা।

ক্যাঙ্গারু খুবই গতিশীল প্রাণী। রাস্তার দুইপাশে আছে জঙ্গল। যখন এরা একপাশ হতে অন্যপাশে যায় তখন যদি গাড়িতে আঘাত খায় তখন ঘটে যেতে পারে বিপদ। তাই বেশ সাবধানে পথ চলতে হয়েছিল আমাদের। ৫০-৬০ কিলোমিটার পর পর দেখা যায় বিশ্রামস্থান। পৃথিবীর সেরা বাসযোগ্য নগরী দেখবো ভেবে মন পুলকিত হচ্ছে। এভাবে যেতে যেতে ভোর হয়ে আসলো, তখনও দেখি ৪৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে মেলবোর্ন যেতে।

তবে ভ্রমণপ্রেমী মানুষ হিসেবে এ দূরত্ব কিছুই মনে হয়নি আমার। সকালের নাস্তা শেষ করে আবার যাত্রা করলাম। চকচকে রোদ চারপাশে হলুদ প্রকৃতি মিলে পরিবেশটা অনেকটা অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটদলের জার্সির মতো মনে হচ্ছে। যতই মেলবোর্ন শহরের দিকে এগিয়ে আসছি ততই একটা আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। কেমন যেন সৌন্দর্যের গর্জন। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি বহুতল ভবন। আর একপাশে সমুদ্রের নীল জলরাশি।

এভাবে দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম মূল শহরে। হোটেলে সবকিছু রেখে বের হলাম খাবারের খোঁজে। সহজে পেয়ে গেলাম খাবারের দোকান। সবসময় একট প্রশ্নের উত্তর খুঁজলাম, তা হচ্ছে কেন এটা এক নম্বর নগরী। তেমন কোনো কারণ চোখে পড়ল না। কিন্তু যখন বাতাস শরীরে আছড়ে পড়ল তখনই মনে হলো সমীরণই শহরটিকে করছে নাম্বার এক।

শহরের কেন্দ্রে আরও আছে পাবলিক লাইব্রেরি, রয়েল মেলবোর্ন ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (আরএমআইটি) ও মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়। তাই সহজেই এগুলো ঘুরে দেখলাম। দেখলাম শতবর্ষী পুরাতন ভবন। মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। হেঁটে দেখলাম বিভিন্ন বিভাগ। রসায়ন বিভাগের প্রতি একটু বেশি আকর্ষণ থাকায় একটু বেশি সময় পার করলাম সেখানে। অসংখ্য ল্যাব দেখতে পেলাম। সব ল্যাবের আছে এক একটা নাম। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই আছে আরএমআইটি সিটি ক্যাম্পাস।

শহরটি অ্যাডিলেইডের মতো শান্ত নয়। রাতেও থাকে সরগরম। পাবলিক লাইব্রেরির সামনেই দেখলাম একদল তরুণীর অসাধারণ নৃত্য। নাচের দৃশ্য অনেকটা টাইটানিক সিনেমার রোজের মতো। বিশেষ সঙ্গীতের সঙ্গে নেচে চলেছে তারা, যা ছিল খুব উপভোগ্য। লাল নীল বাতির আলো, চকচকে গাড়ির মৃদুশব্দ, আর সুন্দরী রমণীর শক্তিশালী পথচলা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো।

এভাবে দেখতে দেখতে রাত গভীর হয়ে গেলো। আর রাতের গভীরতা বাড়ায় আমরা হোটেল ফিরে এলাম। ক্লান্ত থাকায় খুব সহজেই ঘুম এসে গেলো। সকাল হতেই দেখি স্বচ্ছ কাচ ভেদ করে রৌদ্র আমাদের ঘরে ঢুকে পড়েছে। তাই আবারও বের হলাম শহর দেখার জন্য। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়ালাম। সবই অপরিচিত হওয়ায় যেখানে যা ভালো লাগে সেখানেই নেমে পড়লাম। শহরে আছে রয়েল বোটানিকাল গার্ডেন। তার পাশে আছে হ্যালিপ্যাড।

এখানে ধনী মানুষজন পাহাড়ের উপর থাকতে ভালোবাসে। তারা শহরে আসে হেলিকপ্টারে। এ দৃশ্য নিজেই দেখলাম। একটু দূরেই আছে ‘হাফ মুনবে’। দেখলাম বড় জাহাজ দাঁড়ানো থাকতে, আাছে একপাশে দুনিয়াখ্যাত ক্রিকেট স্টেডিয়াম ‘মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড’। কতো খেলা দেখেছি এবং ধারাভাষ্যকারদের চমৎকার কথা শুনে মন জুড়িয়ে যেতো, তা আজ কাছ থেকে দেখলাম।

বেশ কিছু নদী আছে মেলবোর্নের পাশে। ইয়ারা নদী এদের মধ্যে একটি, যার দৈঘ্য ১৪০ মাইল। এখানে গড় বৃষ্টিপাত একটু বেশি। বন্যার হাত থেকে রক্ষা করেছে এ নদী। আমাদের দেশেও নতুন নতুন শহর তৈরি হচ্ছে জলাধার ভরাট করে অথবা গাছপালা উজার করে। আমাদের আচরণ দেখে মনে হয় যেন এগুলোর দরকার নেই। কিছু দালানই যেন সব সৌন্দর্য। কিন্তু মেলবোর্নে তার বিপরীত চিত্র ধারণ করে আছে।

শহরকে ঘিরে রেখেছে নীলরঙের জলাধার। একে অস্ট্রেলিয়ার শিল্প ও সংস্কৃতির শহর বলা হয়। দেখা যায় রাস্তার মোড়ে বার। আর ছিল পার্কিং এর অভাব। শুরুতে বেশ বিরক্ত অনুভব করলাম। সময় গড়াতে গড়াতে কেমন যেন একটা টান অনুভব করতে শুরু করলাম। প্রাণবন্ত এ নগরী যে বেঁধে রাখতে পারে প্রাণকে, যখনই ছেড়ে আসলাম তখনই বুঝলাম।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, অ্যাডিলেড বিশ্ববিদ্যালয়, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া

ই-মেইল: mohammad.s.rahman@adelaide.edu.au

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!