মেমসাহেব

‘কত বয়স হবে মেয়েটির। পনের-ষোল। কিশোরীই বলা চলে। সেই মেয়েটিরও আবার একটি শিশু সন্তান আছে। কিছুদিন আগে বিয়ে হয়েছে - প্রথম যাচ্ছে স্বামীর কাছে'। এক নাগাড়ে এতটা বলে চায়ের মগে দীর্ঘ চুমুক দিলেন আমার সামনে টেবিলের ওপাশে বসা ভদ্রমহিলাটি।

সেলিম জাহান, নিউ ইয়র্ক থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Dec 2018, 02:48 PM
Updated : 1 Dec 2018, 02:48 PM

বিমানবন্দেরের ক্যাফেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক মানুষের ভিড়। অন্য কোথাও কোনও আসন খালি নেই, শুধু জানালার ধারে যে টেবিলে আমি এক মগ চা নিয়ে বসেছিলাম, সেটা ছাড়া। খালি আসনটি দেখে ভদ্রমহিলা আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। কাঁধে একটি মাঝারি মাপের ব্যাগ, এক হাতে একটি বই, অন্য হাতে  ধূমায়িত চায়ের একটি মগ। বুঝলাম আমার মতোই বিমান যাত্রী - অপেক্ষা করছেন উড্ডয়নের। বসতে বললাম তাকে।

এলোমেলো কথা-বার্তা শুরু হল। নানান বিষয় - বিশ্ব, দেশ, সমাজ, সাহিত্য নিয়ে। ভদ্রমহিলা শিক্ষিত, মার্জিত, রুচিশীল এবং সুন্দরীও বটেন। বিদেশের ভদ্রতা আর ব্যবহারের সূক্ষ্ণতা তার  মধ্যে এতটাই সুন্দর যে ভাবছিলাম তাকে মনে মনে 'মেমসাহেব' বলবো। আমাদের কথাবার্তার মাঝে ক্যাফের বাইরে দিয়ে একজন অল্প বয়স্ক তরুণী একটি শিশুকে বুকে নিয়ে পেরিয়ে গেলেন। তার দিকে তাকিয়ে মেমসাহেব একটু আনমনা হলেন। তারপরেই ওপরের গল্পের অবতারণা।

'ভীত সন্ত্রস্ত ছিল মেয়েটি। জীবনে কখনও বাড়ির বাইরে যায় নি, বিমানে চড়েনি। স্বামীর সাথে মাত্র এক সপ্তাহের আলাপ বিয়ের পরে। তারপরই স্বামী চলে গেছে বিদেশের কর্মক্ষেত্রে। শিশু সন্তানটির জন্মও পিতা দেখেনি। লেখাপড়া জানে না সে- বোঝে না কাগজপত্রও। সব কথাই বলছিল সে তার পাশের আসনে বসা মহিলাটিকে' - জানালেন মেমসাহেব।

'কথা বলতে বলতে তরুণীটির বড় বড় কাজল কালো চোখে জলধারা নামে'- মেমসাহেবের গল্প এগোতে থাকে। এর মধ্যেই কোলের শিশুটি কেঁদে ওঠে। তাকে দুলিয়ে দুলিয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করে তরুণী মা। তার মাঝেই অশ্রুভেজা মুখে লাজুক হাসি ফুটিয়ে মেয়েটি বলে, "সাত দিন মোডে দ্যাখছে। যদি না চ্যানে? হের মুকডাও তো মোর ভালো মোনে নাই"। এবার পাশে বসা মহিলাটি হেসে ওঠেন।

আশ্বস্ত করেন তরুণ মাতাটিকে তার চিবুকে হাত রেখে। 'এমন সুন্দর মুখ সে ভুলবে না।' লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে মাথা নামায় মেয়েটি। 'চিন্তা করো না তুমি। আমি সাহায্য করব। ঘাবড়িয়ো না।'। বলতে বলতে কোলের শিশুটি আবারও কেঁদে ওঠে।

তারপরের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত। মহিলাটিই বেশির ভাগ সময়েই শিশুটিকে দেখে রাখেন। তাকে নিয়ে খেলা দেন, হাঁটেন, বুকে নিয়ে ঘুম পাড়ান। মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখেন তরুণী মাতাটি গুটিসুটি মেরে গভীর ঘুমে অচেতন। ভারী মায়া হয় মেয়েটির দিকে তাকিয়ে। জেগে গেলে তার খাবার ব্যবস্থা করে দেন বিমান সেবিকাকে ডেকে। তার আগমন পত্রটি পূরণ করে দেন। পাসপোর্ট গুছিয়ে দেন।

গন্তব্যস্থলে পৌঁছালে জিনিসপত্র, শিশুটি, কাগজপত্র নিয়ে মেয়েটিকে সাহায্য করেন। তরুণিটির একটাই কথা, 'আমারে একা রাইখ্যা যাইবেন না কিন্তু। আমনে আমার মা', বলতে বলতে তরুণীটি মহিলাটির শাড়ির আঁচল শক্ত করে ধরে রাখে সর্বক্ষণ। পরম মমতায় অতি যত্নে মহিলাটি তরুণী আর শিশুটিকে আগমন প্রক্রিয়ার মাঝ দিয়ে বার করে আনেন, তাদের মাল-পত্র সংগ্রহ করেন, তারপর বেস্টনির বাইরে এসে দাঁড়ান সবাইকে নিয়ে।

শিশুটিকে বুকে ধরে উৎসুক চোখে তরুণীটি দ্রুত চোখে চারদিকে খোঁজে। এত মানুষ চারদিকে, কত মানুষ কতজনকে নিতে এসেছে, চারদিকে কত চুম্বন, আলিঙ্গন, কত সুখ, কত আনন্দের অশ্রু। কিন্তু তার মানুষটি কোথাও নেই। ভাবতে ভাবতে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মেয়েটি।

তরুণীটির পিঠে হাত রাখেন মহিলাটি। আদর করে দেন একটু। আশ্বাসের স্বরে বলেন, 'মাঝে মাঝে পথে দেরি হয়। এসে যাবে। চিন্তা করো না। এসো, কিছু খেয়ে নেয়া যাক'। পরম মমতায় মহিলাটি তরুণী আর শিশুটিকে নিয়ে খাবার জায়গায় বসেন। কেক আর চা নিয়ে আসেন। খাওয়ার মাঝেই হন্তদন্ত হয়ে তরুণ স্বামীটি এসে উপস্থিত হন। তারপর মধুরেণ সমপায়েৎ।

মেমসাহেব গল্পটি শেষ করেন। এতক্ষণ তন্ময় হয়ে ওর গল্প শুনছিলাম। চমক ভাঙলো বিমানের ঘোষণায়। আমাদের বিমান আলাদা। মেমসাহেবের বিমানের যাত্রীদের আরোহন ফটকের দিকে যেতে বলা হয়েছে। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন মিষ্টি হাসি হেসে, 'বড় ভালো লাগল আপনার সঙ্গে গল্প করতে। আসি'।

তার হাত ধরে বললাম, 'এমনভাবে গল্পটা বললেন যেন আপনি নিজের চোখে দেখেছেন পুরোটাই। ওই বিমানে ছিলেন আপনি'? স্মিত হাসিতে ভরে গেল মেমসাহেবের সারা মুখ, 'আমিই তো ওই সহযাত্রী মহিলাটি।' আস্তে আস্তে হাত ছাড়িয়ে নিলেন তিনি। তারপর হাঁটতে শুরু করলেন তার আরোহন ফটকের দিকে।

আমি ভদ্রমহিলাটির চলার পথের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁডিয়ে থাকলাম যতক্ষণ না তিনি মিলিয়ে গেলেন একটি বাঁকে। আমাকেও উঠতে হবে আস্তে আস্তে। জিনিসপত্র তুলে নিলাম হাতে। হঠাৎ চোখে পড়ল ভদ্রমহিলা তার বইটি ভুলে টেবিলের ওপর ফেলে গেছেন। হাতে তুলে নিলাম বইটি। বইটির নাম দেখেই চমকে উঠলাম - বইটি আর কিছুই নয়। নিমাই ভট্টাচার্যের- 'মেমসাহেব'।

লেখক পরিচয়: সেলিম জাহান নিউ ইয়র্কে হিউম্যান ডেভলপমেন্ট অফিসের ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এই লেখকের আরও পড়ুন-

ইমেইল: selim.jahan@undp.org

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!