বাংলাদেশিদের বন্ধু ইতিহাস গড়া আলেকজান্দ্রিয়া

দশবারের কংগ্রেসম্যান ও প্রভাবশালী ডেমোক্রেট নেতা জোসেফ ক্রাউলির বিরুদ্ধে লড়ছেন ২৯ বছর বয়সি এক তরুণী- এমন খবরে অনেকটাই বিস্মিত হয়েছিলাম। ইউএস কংগ্রেসের হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের নিউ ইয়র্কের ওই আসনটিতে ক্রাউলি এতটাই অপ্রতিদ্বন্দ্বি ছিলেন যে, এর আগে দলীয় প্রাইমারিতে তাকে কেউ নির্বাচনের মুখোমুখি করতে পারেননি।

শামীম আল আমিন, নিউ ইয়র্ক থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Nov 2018, 05:03 AM
Updated : 30 Nov 2018, 05:27 PM

বিজয়ী হলে তিনি হতে পারেন হাউজের স্পিকার; এমনটাও শোনা যাচ্ছিল। বাংলাদেশ ককাসের চেয়ার জোসেফ ক্রাউলির বিরুদ্ধে আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও কর্টেজ লড়ছেন, খবরটা আমাকে দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার তরুণ রাজনীতিবিদ রাসেল কবির রহমান। তবে এমন প্রভাবশালী নেতার বিরুদ্ধে রাজনীতিতে অনেকটাই অনভিজ্ঞ এক অল্প বয়সি নারীর লড়াই করার ঘোষণা আমার মতো অনেককেই তখন মনযোগী করতে পারেনি। তবে বিষয়টি নজরে আসে সোশ্যাল মিডিয়া এবং স্থানীয় টেলিভিশনগুলোতে আলেকজান্দ্রিয়ার উপর তৈরি কিছু বিজ্ঞাপন ও তথ্যচিত্র দেখে। 

‘আমার নাম আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও কর্টেজ’ পরিষ্কার বাংলায় যখন এ কথাগুলো বলে নিজের পক্ষে সমর্থন চেয়েছিলেন তরুণ এ ডেমোক্রেট নেতা; তখন থেকেই তিনি হয়ে উঠেছেন ‘আমাদের মানুষ’। গত জুন মাসের আগে আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও কর্টেজের বক্তব্যসহ বাংলায় বিজ্ঞাপন ও তথ্যচিত্র বাংলা ভাষাভাষী মানুষের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। তার পক্ষে বিভিন্ন ভাষায় তৈরি বিজ্ঞাপন, ব্যতিক্রমী প্রচারণা, কথা বলার আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গি আর সবাইকে আপন করে নেওয়ার তার অদ্ভুত এক ক্ষমতা ২৯ বছর বয়সি এ রাজনীতিবিদকে নিয়ে যায় অন্য উচ্চতায়।

ডেমোক্রেট প্রাইমারিতে জোসেফ ক্রাউলিকে ধরাশায়ী করে ইতিহাস গড়েছেন আগেই। গত ৬ নভেম্বরের চূড়ান্ত নির্বাচনেও জয়ী হয়েছেন। ফলে অনেক কম বয়সেই আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও কর্টেজ এখন ডেমোক্রেট পার্টি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস এর গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য।

বছর খানেক আগেও কেউ তাকে চিনতো না। বলার মতো তেমন বড় কোনো পরিচয়ও ছিল না তার। বস্টন ইউনিভার্সিটিতে পড়া শেষে কাজ করতেন বার টেন্ডার হিসেবে। কেবল মানুষের জন্য কাজ করার স্বপ্নটা ছিল বুকের ভেতরে। মানুষের অধিকার আদায়ে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চেয়েছেন সবসময়। তবে সেই স্বপ্নটাই যে এত দ্রুত ধরা দেবে, নিজেও ভাবতে পারেননি আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও কর্টেজ। ইতিহাস গড়ে তিনিই হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কনিষ্ঠতম কংগ্রেসওম্যান।

মঙ্গলবারের মধ্যবর্তী নির্বাচনে তিনি প্রায় ৮০ ভাগ ভোট পেয়ে নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশি অধ্যুষিত কংগ্রেশনাল ডিস্ট্রিক্ট ১৪ থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। তার আগে চলতি বছরের জুন মাসে দশবারের কংগ্রেসম্যান, হাউজে চতুর্থ প্রভাবশালী ডেমোক্রেট নেতা এবং বাংলাদেশ ককাসের এক সময়ের চেয়ারম্যান জোসেফ ক্রাউলিকে দলীয় প্রাইমারি ভোটে হারিয়ে চমকের সূচনা করেন তিনি। এরপর ডেমোক্রেট অধ্যুষিত নিউ ইয়র্ক থেকে তার হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের সদস্য হওয়া ছিল কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র।

কিন্তু জোসেফ ক্রাউলি প্রাইমারি নির্বাচনে হেরে গিয়েও, দলের বাইরে থেকে চূড়ান্ত নির্বাচনে থাকার ঘোষণা দিয়ে কিছুটা জমিয়ে তুলেছিলেন। তবে এ নির্বাচনে তিনি পেয়েছেন মাত্র ছয় শতাংশের কিছু বেশি ভোট। রিপাবলিকান প্রার্থীর পর তার অবস্থান তৃতীয়।

গত ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হবার দৌড়ে থাকা বার্নি স্যান্ডার্সের হয়ে কাজ করেছেন আলেকজান্দ্রিয়া। এরপর যখন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অন্য কোনো নির্বাচনে অংশ না নিয়ে সরাসরি ইউএস কংগ্রেসে সরাসরি প্রার্থী হলেন, তখন তা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল তাকে। যদিও জোসেফ ক্রাউলিকে নির্বাচনের মুখোমুখি করার মধ্য দিয়ে রীতিমতো আলোড়ন তোলেন তিনি। দেশের মানুষের জন্যে কাজ করতে চান, সবার মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে চান। ফলে যেখান থেকে কাজটি করা সম্ভব, সেখান থেকেই শুরু করতে চান তিনি। তাই সরাসরি ইউএস হাউজে সরাসরি নির্বাচন করার কথা ভাবেন আলেকজান্দ্রিয়া। ব্যক্তিগতভাবে আমার নেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে এমনটাই বলেছিলেন তিনি।

নিউ ইয়র্কের টিবিএন টোয়েন্টিফোর টেলিভিশনের ‘দ্য ভিউজ’ অনুষ্ঠানে দারুণ মেধাবী এ তরুণ রাজনীতিবিদের একঘণ্টার একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। সেখানে অনেক বিষয়েই কথা বলেছিলেন তিনি। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর ছিল দারুণ বুদ্ধীদিপ্ত, স্বতস্ফূর্ত আর কথা বলার ভঙ্গি ছিল অত্যন্ত গোছানো। আলেকজান্দ্রিয়া জানেন, তিনি আসলে কী বলতে চান। তার কথা বলার ভঙ্গি দারুণ; আকর্ষণীয়। বিশেষ করে তার বিনয় চোখে পড়ার মতো। তবে বিনয়ের কারণে তার অঙ্গীকার, প্রজ্ঞা এবং সাহস ঢাকা পড়ে যায় না। দৃঢ়চেতা তরুণ এ ডেমোক্রেটিক নেতা যখন উডসাইডের টিবিএন টোয়েন্টিফোর টেলিভিশন ভবনে এলেন, আমরা তখন তাকে স্বাগত জানাতে বাইরে দাঁড়িয়ে। গাড়ি থেকে নেমে সহাস্যে আলেকজান্দ্রিয়া এমনভাবে হাসলেন, করমর্দন করলেন, আলিঙ্গণে বাঁধলেন, মনে হয়েছে কতদিনের চেনা। কত আপন।

এরপর পুরোটা সময় জুড়ে তিনি যেভাবে সহায়তা করলেন, বিনয় নিয়ে পুরো সাক্ষাৎকার পর্বটিতে অংশ নিলেন, তাতে আমার মুগ্ধতা বেড়ে গেছে বহুগুণ। মনে হয়েছে, যিনি মানুষকে ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন, তিনি অনেক বড় হবেন, এমনটাইতো স্বাভাবিক। সেদিন নানা বিষয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তরই দিয়েছিলেন আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও কর্টেজ। দেশের বদলে যাওয়া রাজনীতি, ব্যক্তিগত চিন্তার প্রকাশ এবং ভবিষ্যত নিয়ে নিজের ভাবনা- সবকিছুই উঠে এসেছে। অনেক প্রশ্ন হয়তো করাই হয়নি, তবে বোঝা গেছে তার গন্তব্য অনেক দূর।

নির্বাচনের আগে ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট এ কর্মী তার ভিন্নধর্মী প্রচারণা দিয়ে সবার দৃষ্টি কাড়েন। কাজে লাগান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে। মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে যান আলেকজান্দ্রিয়া এবং তার তরুণ কর্মীরা। ঘোষণা দিয়েই কোনো কর্পোরেট হাউজের অনুদান নেননি তিনি। তাতেও সাফল্য থেমে থাকেনি আলেকজান্দ্রিয়ার। জয় হয়েছে মানুষের শক্তির। তাই পুরো বিষয়টি নিয়ে নতুন করেই ভাবতে হচ্ছে রাজনীতির রথি মহারথীদের।

১৯৮৯ সালের ১৩ অক্টোবর নিউ ইয়র্কের ব্রঙ্কসে জন্ম আলেকজান্দ্রিয়ার।

অভিবাসীদের বন্ধু তরুণ এ রাজনীতিবিদ নির্বাচনের সময়টায় খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন বাংলাদেশিদের সঙ্গেও। প্রবাসী বাংলাদেশিদের নানান অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। তার জন্য নির্বাচনের মাঠে থেকে কাজ করেছেন অনেক বাংলাদেশিও। ফলে অন্যান্য প্রবাসীর মতো, বাংলাদেশিদের উন্নয়নেও তিনি কাজ করতে চান বলে একাধিকার জানিয়েছেন নতুন এ কংগ্রেসওম্যান। আলেকজান্দ্রিয়ার বিজয়ে উচ্ছ্বসিত প্রবাসী বাংলাদেশিরাও। বাংলাদেশিদের সঙ্গে গভীরভাবে মেশার কারণে, আমাদের ইস্যুগুলো সম্পর্কে খুবই পরিচিত তিনি। এ কারণে অনেকেই মনে করছেন, আমাদের খুব কাছের মানুষ হয়েই থাকবেন তিনি।

আলেকজান্দ্রিয়া কেবল নিজে বিজয়ী হননি। হাউজে ডেমোক্রেটদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা রেখেছেন। প্রাইমারিতে তার বিজয়, তার বক্তব্য, বিভিন্ন কাজ প্রভাব ফেলেছে মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফলাফলে। এর মধ্য দিয়ে তারুণ্যেরও বিজয় হয়েছে। ফলে দেশজুড়ে অনেক নারী ও তরুণ প্রার্থী এবার নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসতে পেরেছে বলেও মনে করেন অনেকে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতিতে অনেক দূর যাবেন আলেকজান্দ্রিয়া। কেউ কেউ তাকে দেশের ভবিষ্যত প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দেখছেন। আমার নেওয়া সাক্ষাৎকারে এমন একটি প্রশ্ন করা হলে আলেকজান্দ্রিয়া হেসে উত্তর দিয়েছিলেন , ‘আমার মায়ের কাছে এখনি আমি প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছি’।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!