কায়রোর চিঠি: ফেরাউনের গ্রামে

ঐতিহাসিক কিছু স্থাপনা দেখতে বের হলাম। প্রথম যা দেখলাম তার নাম হচ্ছে ‘আল মাসাল্লা’ ও ‘আন নাক্বেসা’। এগুলো পূজা-আর্চনার জন্য গ্রানিট পাথর দিয়ে তৈরি করা অসমাপ্ত স্তম্ভ। বিশাল আকৃতির ও অপরিপূর্ণ নির্মাণের কারণে এগুলো বিখ্যাত।

মোহাম্মাদ আবু জাবের, মিশর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Nov 2018, 03:27 AM
Updated : 14 Nov 2018, 03:28 AM

নীল নদের পূর্ব তীরে প্রস্তর ভূমির উত্তরাংশে এক কিলোমিটারেরও অধিক জায়গাজুড়ে অবস্থিত। তিনতি মাসাল্লার দুটি আজ থেকে প্রায় চার হাজারেও অধিক বছর পূর্বে ফেরাউন সম্প্রদায় ইবাদতের জন্য তৈরি করে। অন্যটি কয়েকশো বছর পূর্বের। এগুলোর একেকটির ওজন এক হাজার একশ ৬৪ মিটার। মজার বিষয় হচ্ছে- এ একই ধরনের স্তম্ভ দিয়ে অন্যান্য অঞ্চলে উপাসনার কাজ চলত। নীলনদ দিয়ে সেসব এলাকায় এগুলোকে স্থানান্তর করা হতো। এজন্য তারা এক জাতীয় মারকাব বা বাহন তৈরি করত। এরপর ভারি যন্ত্রপাতি ও রশির সাহায্যে সেসবকে মারকাবে চড়ানো হতো। মারকাবে চড়ানো কিংবা নীলনদ দিয়ে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে একটা বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা হতো, উপাস্য যাতে কোনরূপ ক্ষয়-ক্ষতির শিকার না হন। এজন্য তারা উল্লেখযোগ্য হারে নানা ধরনের পদার্থ ব্যবহার করতো।

বড় বড় পাথর কেটে এ জাতীয় মাসাল্লাগুলো তৈরি করা হয়েছে। এসব কিছু করা হয়েছে মূলত এদের একটি বিশ্বাসকে ঘিরে। এরা বিশ্বাস করত চন্দ্র সূর্য হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর জিনিস। আর বৃহৎ আকৃতির পাথরের উপর এগুলোর কিরণ পড়ে সর্বাপেক্ষা বেশি। কাজেই এ পাথরই উপাসনার জন্য বেশি উপযুক্ত। কিন্তু যখন এ পাথর কেটে লম্বা আকৃতির মাসাল্লা তৈরি হবে, তখন তাতে আলো পড়বে আরো অনেক বেশি। এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে এরা মাসাল্লা তৈরি করে এবং এগুলোর পূজা-আর্চনা করে। অনেক অঞ্চলে সরাসরি চাঁদ-সুরুজের পূজা করা হতো।

এ মাসাল্লাগুলো ফেরাউনি যুগের কোন শাসনামলে তৈরি করা হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য নেই। তবে ধারণা করা হয় যে, মিশরের রাণী হাবশেতসুতের শাসনামলে এগুলো তৈরি করা হয়েছে।

এই স্তম্ভগুলো অসমাপ্ত থাকার ব্যাপারে একটি চমৎকার ঘটনা আছে। তৎকালীন সময়ে মিশরিয় শ্রমিকরা যখন তিনদিক থেকে এগুলো তৈরির কাজ শেষ করে, তখন হঠাৎ একদিকে ফাটল দেখা দেয়। এরা সঙ্গে সঙ্গে এটাকে অশুভ লক্ষণ ভেবে কাজ বন্ধ করে দেয়। এরপর কখনও এ কাজে আর এরা হাত দেয়নি। ফলে এগুলো অসমাপ্ত থেকে যায়।

সম্পূর্ণ এলাকা ঘুরেফিরে দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়। আমরা এখানে আর বিলম্ব না করে আবার নীলজলের উপর চড়ে বসি। এবার যাব মা’বাদ ফিলা। নীল নদ তীরবর্তী অঞ্চলের মাঝামাঝিতে একটি উপদ্বীপের উপর এই উপাসনালয়টি অবস্থিত। এই উপদ্বীপটির নাম ‘জাযিরাতুল ফিলা’। আসওয়ান নীল নদের যে তীরে অবস্থিত, এ উপদ্বীপটি অবস্থিত তার বিপরীতে। ফেরাউনদের চিরস্থায়ী উপাসনার জন্য এখানে অনেকগুলো মন্দির তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু মা’বাদ ফিলাছিল মিশরের দক্ষিণের সীমানায় একমাত্র উপাসনালয়। আসওয়ান জেলার উত্তর ও দক্ষিণ দুই দিকে নীল নদ স্বতন্ত্রভাবে প্রসারিত হয়েছে। একসময় এই উপাসনালয় নীল নদের দক্ষিণ প্রান্তে থাকলেও উচ্চ বাঁধ নির্মাণের সময় এটাকে তার মূল অবস্থান থেকে সরিয়ে উত্তর প্রান্তে আনা হয়।

গ্রিক শব্দ ‘ফিলা’ মানে প্রেমিকা। আরবিতে যাকে বলা হয় ‘হাবিবা’। মূলত এটি ‘এক হাজার এক রজনী’আরবি উপন্যাসে উল্লেখিত ‘আনাস’চরিত্রের প্রতি ইঙ্গিত করে। খ্রিস্টপূর্ব দুই শতাব্দী পূর্বে উপাসনার জন্য গ্রিকরা এটি নির্মাণ করেন। এর প্রাচীন মিশরিয় এবং কিবতি নাম হচ্ছে ‘বিলাক বা বিলাখ’। এর মানে হলো ‘সর্বশেষ সীমানা’, কারণ এটি মিশরের দক্ষিণের শেষ সীমানায় অবস্থিত ছিল। এ উপাসনালয়ে উপাস্য ইযিযের আরাধনা করা হতো। যদিও দ্বীপটিতে আরো অন্যান্য উপাসনালয় বিদ্যমান ছিল। যেমন- মা’বাদ আমিনহাওতেপ, মা’বাদ হাতহুর ইত্যাদি। এছাড়া এখানে রোমান শাসনামলের আরো কয়েকটি মা’বাদ আছে।

এ মন্দিরটিতে অসংখ্য মূর্তির মাঝে চারটি মূর্তি বিশেষভাবে পরিচিত। সম্পর্কে এ উপাস্যগুলো ছিল চারজন ভাইবোন। ইযিয ও ইযুরিস দুই ভাই আর সাত্ত ও ইফিলিতিস দুই বোন। দুই ভাই তাদের দুই বোনকে বিয়ে করে। এরা একেকজন ছিল একেক ধরনের উপাস্য। ইযিয ছিল সমগ্র জাতির উপাস্য। ইযুরিস পুনরুত্থান জগতের আর সাত্ত এবং ইফলিতিস অন্যান্য কল্যাণের উপাস্য। যদিও সাত্ত অত্যাচারিণী হিসেবেই পরিচিত ছিল বেশি।

ইযুরিসকে এরা পুনরুত্থান জগতের উপাস্য ভাবত। তাদের বিশ্বাস ছিল পরকালের যাবতীয় বালা-মুসিবত আর আপদ-বিপদ থেকে সে তাদের রক্ষা করবে। এজন্য বিশেষভাবে ইযুরিসের মূর্তি স্থাপন করা হতো। এমনকি মন্দিরের প্রায় সব জায়গাতেই ইযুরিসের মূর্তি আছে। তাকে বিশেষভঙ্গিতে দাঁড় করিয়ে স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে তার ডান পা সামনে আর বাঁ পা পেছনে। মানে ইযুরিসের চিরকাল জীবিত থাকার ইঙ্গিত। তার ভেতর যখন তখন আত্মা আসা যাওয়া করে। সে চলাফেরা করছে সব জায়গায়, সবখানে।

এরচেয়ে আরো বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, প্রাচীন মিশরিয়দের বিশ্বাস ছিল পাথরের মধ্যে মানুষের আকৃতি দিলেই তার ভেতর জীবিত মানুষের আত্মা প্রবেশ করে। একটা জীবিত মানুষের যা করার ক্ষমতা থাকে, এ পাথরেরও সেই পরিমাণ ক্ষমতা থাকে। তার আরো অতিরিক্ত ক্ষমতায়িত হচ্ছে, এটি মানুষকে কল্যাণ কিংবা অকল্যাণ করতে পারে। তাদের ধারণা অনুসারে একসময় মানুষের মতো এ পাথরগুলোরও মৃত্যু হতো। তখন তারা এগুলোকে ঠিক মানুষের মতোই পোশাকাদি দিয়ে দাফন করত। চতুর্দিক থেকে এ মন্দিরটিকে সীমানা দিয়ে বেষ্টন করা হয়েছে। আর নানাভাবে সুসজ্জিত করে পর্যটকদের জন্য বিশেষভাবে প্রদর্শন করা হয়েছে।

পরদিন সকাল সকাল বের হলাম উচ্চ বাঁধ ‘আস-সাদ্দুল আলি’ দেখতে। নীলনদের পানি সংরক্ষণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য পদ্মফুলের আকৃতিতে এবাঁধটি নির্মাণ করা হয়। প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুন নাসেরের তত্ত্বাবধানে ১৯৬০ সাল থেকে শুরু হয়ে ১৯৭০ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। নির্মাণ কাজে সার্বিক সহায়তা করেন পাকিস্তান ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী অঞ্চলের সাওফিয়্যা নামক একটি গোষ্ঠী। এদের প্রায় চার শতাধিক লোক এ দীর্ঘ সময় সহায়তা দেন। বাঁধটির দৈর্ঘ্য তিন হাজার আটশত ৩৩ মিটার। নিচের দিক থেকে প্রস্থ নয়শ ৮০ মিটার এবং উপরের দিক থকে ৪০ মিটার। পুরত্ব ৪৩ মিলিয়ন মিটার এবং উচ্চতা একশত ১১ মিটার।

বাঁধটিতে পানি প্রবাহের জন্য একশ ২০টি দরজা আছে। ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে এটি উদ্বোধন করা হয়। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, এই বাঁধটির প্রাথমিক নকশা এঁকেছিলেন কিন্তু নয়শ খ্রিস্টাব্দের দিকে জন্ম নেওয়া বিখ্যাত দার্শনিক হাসান বিন হাসান আল-হায়সামি। এ বাঁধটির অন্যতম একটি অসুবিধেও আছে। এর ফলে নীলনদের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয়। কখনো কখনো পানিও কমে যায়, এবং এর ফলে জনগণকে নানা জটিলতায় পড়তে হয়। আস-সাদ্দুল আলির সামনেই আছে পৃথিবী বিখ্যাত হ্রদ‘বুহায়রা নাসের’। হ্রদটির এক তৃতীয়াংশ মিশরে এবং বাকি এক অংশ সুদানে অবস্থিত। তবে এ হ্রদটি সৃষ্টির ফলে এই অঞ্চলে বসবাস করা নুবিয়ানদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ফলে তাদের বৃহত্তর একটি অংশ অন্যত্র পাড়ি জমায়।

দুপুর বারোটা নাগাদ আমরা ‘আস-সাদ্দুল আলি’ পরিদর্শন করি। সেইসঙ্গে বিপরীত প্রান্তে থাকা হ্রদটিও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করি। এগুলোর ইতিহাস, এগুলোর সুবিধা-অসুবিধার কথা জেনে নেই। আর এরমধ্য দিয়ে আমাদের আসওয়ান ভ্রমণও শেষ হয়। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ধরি লুক্সর গমনের জন্য। জানি না বেলা কয়টায় আমরা লুক্সর গিয়ে পৌঁছব। তবে সময় যতটুকই গড়াক, তাতে নেই কোন ক্লান্তি, কিংবা কোন ক্লেশ, বরং সবকিছুই উপভোগ করছি দু’চোখ ভরে। যাতে পিপাসার্ত হৃদয়ের তৃষ্ণা মেটে। অজানার পাতাগুলো ধীরে ধীরে কমতে থাকে। যদিও অপূর্ণতার একটা রেশ রয়ে যাচ্ছে সবখানেই। যদি আরেকটু সময় হতো!

আমরা লুক্সর শহরে এসে পৌঁছলাম বেলা তিনটায়। সূর্য তখন মাথার উপর থেকে খানিক হেলে পড়েছে। এ সময় শহরটিকে মনে হচ্ছিলো এমন, যেন তার গায়ে আজ বসন্তেরমৃদু সমীরণ প্রবাহিত হচ্ছে। তার হিমশীতল বাতাসে দেহমন কি এক স্নিগ্ধতায় মোহিত হচ্ছিলো। আজ বড় বর্ণিল সাজে সেজেছে শহরটি। চারদিকে তার সাজ সাজ রব রব ধ্বনি মুখরিত। যুগের পুর যুগ আর শতাব্দীর পর শতাব্দী চলতে চলতে এটি ক্লান্ত হয়ে পড়েনি। বরং অসংখ্য অগণিত সভ্যতা আর ঐতিহ্য ধারণ করতে পেরে বেজায় আনন্দিতসে। সোনালি সেসব দিনের গর্বে তার বুক ফুলে উঠছে।

তাছাড়া লাখো লাখো পর্যটকদের আনাগোনায় তার বিরক্তিবোধ নেই। বরং সে অধিক উচ্ছ্বসিত, আহ্লাদিত। অন্যদেরকেও কাছে ডাকছে উচ্চস্বরে- এসো আমার কোলে। দেখে যাও বহু কাল আগের ধ্বংসাবশেষ। দেখে যাও খোদাদ্রোহীদের নির্মম পরিণতি। কেমন করে উন্নত জাতিগুলো কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। তাদের সভ্যতা আর অট্টালিকাগুলো কেবলই স্মৃতিচিহ্ন হয়ে আছে। এরা কোনোদিন আর কোন জাতিকে শাসন করবে না। এদের দম্ভে আর আত্মঅহমিকায় পুড়বে না কোন জাতি। আমরা তাই দেখতে এলাম। এলাম ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে। এই ধ্বংসাবশেষকে স্বচক্ষে দেখতে।

তবে সবকিছুর প্রথমে আমরা লুক্সর শহর সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা নিই। লুক্সর শব্দটি ইংরেজি, এ নামেই শহরটি অধিক পরিচিত। আরবিতে বলা হয় ‘আল-উক্বসুর’।মুসলমানদের মিশর বিজয়ের প্রাক্কালে শহরটির এ নাম রাখা হয়, এর বুকে থাকা অসংখ্য অট্টালিকা আর হাজারো সভ্যতার প্রতি লক্ষ্য করে। সুদীর্ঘকাল থেকেই এ লুক্সর‘পর্যটন শহর’ বলে খ্যাত। বছরের যেকোনো সময়ই এখানে পর্যটকদের মেলা বসে। ইতিহাসের পাতায় এ শহরের অনেকগুলো নাম পাওয়া যায়। এ শহরকে সবার আগে‘নিতো বা নিনো’ নামে ডাকা হতো। বাতলিমিউস যুগে এর নাম ছিল তিবা, আর ইউনানি যুগে বলা হতো আন্তলিউস। এছাড়াও এর আরো অধিক নাম ছিল, যেমন- আলোর শহর, সূর্যের শহর, একশো দরজার শহর ইত্যাদি।

প্রায় সাত হাজার বছর পূর্ব থেকে শহরটির অস্তিত্ব বিদ্যমান। মিশরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নগরী ও জেলা হিসেবে শহরটিকে গণ্য করা হয়। প্রাচীন ফেরাউনি সভ্যতা ও শীতকালীন ছুটি কাটানোর জন্য এটি অধিক বিখ্যাত। কায়রো থেকে শহরটির দূরত্ব ছয়শ ৭০ কিলোমিটার। ২০১২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এ শহরের জনসংখ্যার পরিমাণ তের লাখ। শহরটির পূর্বে বাহর আল-মাইয়েত জেলা, পশ্চিমে ওয়াদি আল-জাদিদ জেলা। এতে মাফোজ নামে একটি নৌবন্দর আছে, আর আছে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ২৫ দশমিক ৭০ ডিগ্রি অক্ষাংশে এবং ৩২ দশমিক ৬৫ ডিগ্রি দ্রাঘিমায় অবস্থিত এ শহর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে শহরটির উচ্চতা ৮৯ মিটার।

লেখক: প্রবাসী শিক্ষার্থী, আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর

এ লেখকের আরও লেখা-

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!