নীল নদের পূর্ব তীরে প্রস্তর ভূমির উত্তরাংশে এক কিলোমিটারেরও অধিক জায়গাজুড়ে অবস্থিত। তিনতি মাসাল্লার দুটি আজ থেকে প্রায় চার হাজারেও অধিক বছর পূর্বে ফেরাউন সম্প্রদায় ইবাদতের জন্য তৈরি করে। অন্যটি কয়েকশো বছর পূর্বের। এগুলোর একেকটির ওজন এক হাজার একশ ৬৪ মিটার। মজার বিষয় হচ্ছে- এ একই ধরনের স্তম্ভ দিয়ে অন্যান্য অঞ্চলে উপাসনার কাজ চলত। নীলনদ দিয়ে সেসব এলাকায় এগুলোকে স্থানান্তর করা হতো। এজন্য তারা এক জাতীয় মারকাব বা বাহন তৈরি করত। এরপর ভারি যন্ত্রপাতি ও রশির সাহায্যে সেসবকে মারকাবে চড়ানো হতো। মারকাবে চড়ানো কিংবা নীলনদ দিয়ে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে একটা বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা হতো, উপাস্য যাতে কোনরূপ ক্ষয়-ক্ষতির শিকার না হন। এজন্য তারা উল্লেখযোগ্য হারে নানা ধরনের পদার্থ ব্যবহার করতো।
বড় বড় পাথর কেটে এ জাতীয় মাসাল্লাগুলো তৈরি করা হয়েছে। এসব কিছু করা হয়েছে মূলত এদের একটি বিশ্বাসকে ঘিরে। এরা বিশ্বাস করত চন্দ্র সূর্য হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর জিনিস। আর বৃহৎ আকৃতির পাথরের উপর এগুলোর কিরণ পড়ে সর্বাপেক্ষা বেশি। কাজেই এ পাথরই উপাসনার জন্য বেশি উপযুক্ত। কিন্তু যখন এ পাথর কেটে লম্বা আকৃতির মাসাল্লা তৈরি হবে, তখন তাতে আলো পড়বে আরো অনেক বেশি। এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে এরা মাসাল্লা তৈরি করে এবং এগুলোর পূজা-আর্চনা করে। অনেক অঞ্চলে সরাসরি চাঁদ-সুরুজের পূজা করা হতো।
এই স্তম্ভগুলো অসমাপ্ত থাকার ব্যাপারে একটি চমৎকার ঘটনা আছে। তৎকালীন সময়ে মিশরিয় শ্রমিকরা যখন তিনদিক থেকে এগুলো তৈরির কাজ শেষ করে, তখন হঠাৎ একদিকে ফাটল দেখা দেয়। এরা সঙ্গে সঙ্গে এটাকে অশুভ লক্ষণ ভেবে কাজ বন্ধ করে দেয়। এরপর কখনও এ কাজে আর এরা হাত দেয়নি। ফলে এগুলো অসমাপ্ত থেকে যায়।
সম্পূর্ণ এলাকা ঘুরেফিরে দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়। আমরা এখানে আর বিলম্ব না করে আবার নীলজলের উপর চড়ে বসি। এবার যাব মা’বাদ ফিলা। নীল নদ তীরবর্তী অঞ্চলের মাঝামাঝিতে একটি উপদ্বীপের উপর এই উপাসনালয়টি অবস্থিত। এই উপদ্বীপটির নাম ‘জাযিরাতুল ফিলা’। আসওয়ান নীল নদের যে তীরে অবস্থিত, এ উপদ্বীপটি অবস্থিত তার বিপরীতে। ফেরাউনদের চিরস্থায়ী উপাসনার জন্য এখানে অনেকগুলো মন্দির তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু মা’বাদ ফিলাছিল মিশরের দক্ষিণের সীমানায় একমাত্র উপাসনালয়। আসওয়ান জেলার উত্তর ও দক্ষিণ দুই দিকে নীল নদ স্বতন্ত্রভাবে প্রসারিত হয়েছে। একসময় এই উপাসনালয় নীল নদের দক্ষিণ প্রান্তে থাকলেও উচ্চ বাঁধ নির্মাণের সময় এটাকে তার মূল অবস্থান থেকে সরিয়ে উত্তর প্রান্তে আনা হয়।
এ মন্দিরটিতে অসংখ্য মূর্তির মাঝে চারটি মূর্তি বিশেষভাবে পরিচিত। সম্পর্কে এ উপাস্যগুলো ছিল চারজন ভাইবোন। ইযিয ও ইযুরিস দুই ভাই আর সাত্ত ও ইফিলিতিস দুই বোন। দুই ভাই তাদের দুই বোনকে বিয়ে করে। এরা একেকজন ছিল একেক ধরনের উপাস্য। ইযিয ছিল সমগ্র জাতির উপাস্য। ইযুরিস পুনরুত্থান জগতের আর সাত্ত এবং ইফলিতিস অন্যান্য কল্যাণের উপাস্য। যদিও সাত্ত অত্যাচারিণী হিসেবেই পরিচিত ছিল বেশি।
ইযুরিসকে এরা পুনরুত্থান জগতের উপাস্য ভাবত। তাদের বিশ্বাস ছিল পরকালের যাবতীয় বালা-মুসিবত আর আপদ-বিপদ থেকে সে তাদের রক্ষা করবে। এজন্য বিশেষভাবে ইযুরিসের মূর্তি স্থাপন করা হতো। এমনকি মন্দিরের প্রায় সব জায়গাতেই ইযুরিসের মূর্তি আছে। তাকে বিশেষভঙ্গিতে দাঁড় করিয়ে স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে তার ডান পা সামনে আর বাঁ পা পেছনে। মানে ইযুরিসের চিরকাল জীবিত থাকার ইঙ্গিত। তার ভেতর যখন তখন আত্মা আসা যাওয়া করে। সে চলাফেরা করছে সব জায়গায়, সবখানে।
পরদিন সকাল সকাল বের হলাম উচ্চ বাঁধ ‘আস-সাদ্দুল আলি’ দেখতে। নীলনদের পানি সংরক্ষণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য পদ্মফুলের আকৃতিতে এবাঁধটি নির্মাণ করা হয়। প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুন নাসেরের তত্ত্বাবধানে ১৯৬০ সাল থেকে শুরু হয়ে ১৯৭০ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। নির্মাণ কাজে সার্বিক সহায়তা করেন পাকিস্তান ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী অঞ্চলের সাওফিয়্যা নামক একটি গোষ্ঠী। এদের প্রায় চার শতাধিক লোক এ দীর্ঘ সময় সহায়তা দেন। বাঁধটির দৈর্ঘ্য তিন হাজার আটশত ৩৩ মিটার। নিচের দিক থেকে প্রস্থ নয়শ ৮০ মিটার এবং উপরের দিক থকে ৪০ মিটার। পুরত্ব ৪৩ মিলিয়ন মিটার এবং উচ্চতা একশত ১১ মিটার।
দুপুর বারোটা নাগাদ আমরা ‘আস-সাদ্দুল আলি’ পরিদর্শন করি। সেইসঙ্গে বিপরীত প্রান্তে থাকা হ্রদটিও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করি। এগুলোর ইতিহাস, এগুলোর সুবিধা-অসুবিধার কথা জেনে নেই। আর এরমধ্য দিয়ে আমাদের আসওয়ান ভ্রমণও শেষ হয়। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ধরি লুক্সর গমনের জন্য। জানি না বেলা কয়টায় আমরা লুক্সর গিয়ে পৌঁছব। তবে সময় যতটুকই গড়াক, তাতে নেই কোন ক্লান্তি, কিংবা কোন ক্লেশ, বরং সবকিছুই উপভোগ করছি দু’চোখ ভরে। যাতে পিপাসার্ত হৃদয়ের তৃষ্ণা মেটে। অজানার পাতাগুলো ধীরে ধীরে কমতে থাকে। যদিও অপূর্ণতার একটা রেশ রয়ে যাচ্ছে সবখানেই। যদি আরেকটু সময় হতো!
তাছাড়া লাখো লাখো পর্যটকদের আনাগোনায় তার বিরক্তিবোধ নেই। বরং সে অধিক উচ্ছ্বসিত, আহ্লাদিত। অন্যদেরকেও কাছে ডাকছে উচ্চস্বরে- এসো আমার কোলে। দেখে যাও বহু কাল আগের ধ্বংসাবশেষ। দেখে যাও খোদাদ্রোহীদের নির্মম পরিণতি। কেমন করে উন্নত জাতিগুলো কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। তাদের সভ্যতা আর অট্টালিকাগুলো কেবলই স্মৃতিচিহ্ন হয়ে আছে। এরা কোনোদিন আর কোন জাতিকে শাসন করবে না। এদের দম্ভে আর আত্মঅহমিকায় পুড়বে না কোন জাতি। আমরা তাই দেখতে এলাম। এলাম ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে। এই ধ্বংসাবশেষকে স্বচক্ষে দেখতে।
প্রায় সাত হাজার বছর পূর্ব থেকে শহরটির অস্তিত্ব বিদ্যমান। মিশরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নগরী ও জেলা হিসেবে শহরটিকে গণ্য করা হয়। প্রাচীন ফেরাউনি সভ্যতা ও শীতকালীন ছুটি কাটানোর জন্য এটি অধিক বিখ্যাত। কায়রো থেকে শহরটির দূরত্ব ছয়শ ৭০ কিলোমিটার। ২০১২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এ শহরের জনসংখ্যার পরিমাণ তের লাখ। শহরটির পূর্বে বাহর আল-মাইয়েত জেলা, পশ্চিমে ওয়াদি আল-জাদিদ জেলা। এতে মাফোজ নামে একটি নৌবন্দর আছে, আর আছে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ২৫ দশমিক ৭০ ডিগ্রি অক্ষাংশে এবং ৩২ দশমিক ৬৫ ডিগ্রি দ্রাঘিমায় অবস্থিত এ শহর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে শহরটির উচ্চতা ৮৯ মিটার।
লেখক: প্রবাসী শিক্ষার্থী, আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর
এ লেখকের আরও লেখা-
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |