স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ডে যখন গেলাম...

একজন ছাত্রের কাছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সব সময়ের জন্যই গৌরবের। অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল যদি একবার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারতাম! একবার একটা কোর্স করার জন্য ৫০ শতাংশ বৃত্তি পাই, কিন্তু বাকিটা নিজ থেকে ব্যবস্থা করতে না পারায় আর যাওয়া হয় নি। এখানে পড়াশোনা করা অনেক ব্যয়বহুল। মনটা ভীষণ খারাপ হয়েছিল। কিন্তু হাল ছাড়িনি। ঠিক কিছুদিন পর হার্ভার্ডে একটা কনফারেন্সে গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপনের সুযোগ পেয়ে যাই। শেষ পর্যন্ত মনটা কিছুটা হলেও ভালো হয়েছিল।

দেবাশিস সরকার, অস্ট্রেলিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Oct 2018, 01:16 PM
Updated : 23 Oct 2018, 01:16 PM

আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই, হার্ভার্ড তার নিজের নামেই পরিচিত। তারপরেও কিছু তথ্য হয়তো ইতোমধ্যে ভুলে যেতে পারেন।  তাই সেগুলো মনে করিয়ে দিতে চাই। ১৬৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত আমেরিকার অতি প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় আড়াই শ একর জায়গা জুড়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০ হাজারের উপরে। দাতা জন হার্ভার্ডের নামে এটির নামকরণ করা হয়। বোস্টনের খুব কাছেই অবস্থিত ক্যামব্রিজ সিটিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, মাইক্রোসফটের বিল গেটস কিংবা ফেইসবুকের মার্ক জুকারবার্গ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমেরিকার ৮ জন প্রেসিডেন্ট এই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা করেছেন। তাছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য অনেক নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এই হার্ভার্ডেরই গবেষক এবং শিক্ষক।

যাই হোক সুযোগ পাওয়ার পর আসলো ভিসা আবেদনের বিষয়। কাছের মানুষজন বললো ভিসা পাওয়াটা কঠিন কিন্তু সাহস নিয়ে করেই ফেললাম। যথারীতি ভিসা অফিসে যেয়ে যখন ভিসা অফিসারের মুখোমুখি হলাম তখন অফিসার আমাকে জিজ্ঞেস করল প্রফেসর ইউনুস এর কথা আর ক্ষুদ্রঋণ সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গির কথা। যেহেতু আমার গবেষণার বিষয় ছিল ক্ষুদ্রঋণ সেহেতু এ কারণেই হয়তো এ ধরনের প্রশ্ন করেছিল। তবে প্রশ্নের ধরন শুনেই বুঝতে পারলাম ভিসা পেয়ে যাবো। কিছুদিন পর পেয়েও গেলাম। ভালোই লাগলো। এখানে উল্লেখ্য আপনি যদি ভিজিট কিংবা কোনও কনফারেন্সের জন্য আমেরিকা যেতে চান তাহলে আপনাকে ৫ বছর মেয়াদী ভিসা দিবে। আপনি এই ৫ বছরে প্রতিবার আমেরিকা গিয়ে ৬ মাসের বেশি থাকতে পারবেন না। 

এবার যাত্রার পালা। কনফারেন্স হচ্ছে দুই দিনের তাই সেটা শেষ করে এক সপ্তাহের ভ্রমণ করবো এই পরিকল্পনা করে বেরিয়ে পড়লাম। হোটেল ভাড়া করলাম বোস্টনের ক্যামব্রিজ সিটিতে। আমার হোটেল থেকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় হেঁটে যেতে ২৫ মিনিট লাগতো। হোটেলে উঠে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে হোটেল থেকে একটা ম্যাপ নিয়ে বের হয়ে গেলাম হার্ভার্ডের পথে।  হাঁটছি  আর অভিভূত হচ্ছি। আর রাস্তার দুই পাশে সাদা রঙের ছোট ছোট একতলা বাড়ি দেখতে বেশ ভালো লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো মাথায় নীল আকাশ নিয়ে সাদা বনের মাঝপথে হেঁটে চলেছি। হাঁটার জন্য এরকম সুন্দর রাস্তা আর কি হয়! হাঁটতে হাঁটতে চলেই আসলাম স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রথমেই ফাঁকা মাঠের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পেয়ে গেলাম হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল। স্মৃতি হিসেবে ছবি তুলে রাখলাম। বিল্ডিংয়ের সৌন্দর্য্য দেখে মনটা জুড়িয়ে গেলো। কি সুন্দর পরিচ্ছন্ন ক্যাম্পাস। লাল ইটের তৈরি বিল্ডিং হচ্ছে হার্ভার্ডের ঐতিহ্যের অংশ। দেখতে অসাধারণ লাগে। সারা বিশ্ব থেকে নামি দামি মানুষজন এইখানে পড়াশোনা করেছেন ভাবতেই ভালো লাগে। তারপর ইউনিভার্সিটির পাশ দিয়ে বয়ে চলা চার্লস নদীর সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে ক্যাম্পাসের একাংশ দেখার চেষ্টা করেছি। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলো তাই আর ওই দিনের মতো বেশি দেরি না করে আমার কনফারেন্সের ভেন্যুটা চিনে রাতের খাবার কিনে আবার হাঁটতে হাঁটতে হোটেলে চলে আসি।

পরদিন সকালে আমার উপস্থাপনা তাই একটু চিন্তার মধ্যেই ছিলাম। কিন্তু সব ভালো ভাবে হওয়াতে অন্যরকম ভালো লাগছিলো। আমাদের দেশটাকেও অন্যদের সাথে তুলে ধরতে পেরে গর্বিত লাগছিলো। তারপর সারাদিন অন্যদের প্রবন্ধ উপস্থাপনা শেষ হলে আবার হার্ভার্ড ঘুরে দেখতে বের হয়ে যাই। সাথে মেক্সিকোর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, মরক্কো থেকে আসা একজন প্রফেসর আর ভারতের কলকাতার একজন যিনি এখন আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে শিক্ষকতা করছেন।

ঘুরতে ঘুরতে মাথায় আসলো যেহেতু হার্ভার্ডের কাছেই বিশ্ববিখ্যাত ‘ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’, যা সংক্ষেপে এমআইটি নামে পরিচিত, সেহেতু ঘুরে আসলে মন্দ না। সবাই মিলে ট্রামে করে চলে গেলাম এমআইটিতে। এমআইটির কিছু বিল্ডিং এর গড়ন এমন দেখলে মনে হবে যেন সেগুলো নাচানাচি করছে। তারপর কিছু ছবি তুলে গল্প করতে করতে বের হয়ে গেলাম ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে।

পরদিন আবার কনফারেন্সের বাকি প্রবন্ধ পাঠ শুনে শেষ করে বেরিয়ে পড়লাম হার্ভার্ডের ভেতরের অন্য জিনিসগুলো দেখতে। যেমন বই বিক্রির দোকান, হার্ভার্ড স্কয়ারে বিভিন্ন সুভেনিয়রের দোকান, রেস্টুরেন্টেও ঢুঁ মারলাম। হার্ভার্ডের বিখ্যাত রেস্তোরাঁর নাম হচ্ছে চার্লিস কিচেন। ওখানে বার্গার না খেলে কি হয়?

১৭২০ সালে প্রতিষ্ঠিত ম্যাসাচুসেট্স হল দেখা, কথিত জন হার্ভার্ড এর প্রতিকৃতির সাথে ছবি তোলা অনেক রোমাঞ্চকর অনুভূতির কয়েকটা মাত্র। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে জন হার্ভার্ডের যে মূর্তি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত আছে সেটা আসলে একজন ছাত্রের।

হেরি এলকিন্স ওয়াইডেনার মেমোরিয়াল লাইব্রেরি হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যলয়ের বড় লাইব্রেরি। এর চারতলা মাটির নিচে। আর কারণ হচ্ছে দাতার সাথে চুক্তি হয়েছিল যে কোনও অবস্থাতেই লাইব্রেরির বাহ্যিক কাঠামোতে কোন পরিবর্তন আনা যাবে না, তাই উপরের দিকে না বাড়িয়ে দৃশ্যমান কোন পরিবর্তন ছাড়াই মাটির নিচে লাইব্রেরির জায়গা বাড়ানো হয়েছে।

হার্ভার্ডের পথে হাঁটলে অন্যরকম অনুভূতি হয় যেটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। মনে হয় যেন সব কিছুতেই জ্ঞানের ছোঁয়া। বার বার মনে হচ্ছিলো যদি কিছু সময় নিয়ে এখানে একটা কোর্স করা যেত! তবে এখানে পড়াশোনার সুযোগ পাওয়াটা অনেক কঠিন হলেও অসম্ভব কিছু না। বাংলাদেশের অনেক মেধাবী ছেলেমেয়েরা এখানে পড়াশোনা করছেন। 

তারপর একদিন যাই বোস্টনে বেড়াতে। পরিপাটি আর আভিজাত্যের শহর বোস্টন। বোস্টনে ঘুরতে ঘুরতে ‘চায়না টাউন’ এর দেখাও পেলাম। মূলত চায়নিজরা একসাথে নির্দিষ্ট জায়গায় থাকে বলেই এই ধরনের নামকরণ করা হয়েছে।

তারপর বোস্টন থেকে বাসে করে রওনা হলাম নিউ ইয়র্কের দিকে। আরেক স্বপ্ন পূরণের পথে!

লেখক: পর্যটক ও গবেষক

ইমেইল: debashisemp@gmail.com


এই লেখকের অন্যান্য লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!