আমস্টারডাম মানে বিস্ময় অবিরাম

আমাদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলে প্রতিবারই সাইকেলে করে এদিক ওদিক দেখতে বের হয়ে যাই। সবুজ প্রকৃতি আর ছোট ছোট খালে বা পুকুরে জমে থাকা পানির দিকে তাকিয়ে ছোটবেলার স্মৃতি স্পষ্টভাবে দেখতে পাই। অন্যরকম স্বাধীনতার স্বাদ পাই। কিন্তু ইউরোপের একটা দেশের রাজধানীতে গেলেও যে সারি সারি সাইকেল কিংবা অসংখ্য খালের দেখা পাবো সেটা কখনো ভাবিনি। আর এমটাই ঘটেছে যখন আমস্টারডাম ঘুরে গিয়েছি।

দেবাশিস সরকার, ফ্রান্স থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Oct 2018, 03:14 PM
Updated : 7 Oct 2018, 03:39 PM

অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ইউরোপের একটি দেশ নেদারল্যান্ডস, যা হল্যান্ড নামেও পরিচিত। নেদারল্যান্ডসের রাজধানীর নাম আমস্টারডাম। এই দেশটির প্রায় ৫০ ভাগ জায়গা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১ মিটার উঁচু। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে নেদারল্যান্ডস এর প্রায় এক তৃতীয়াংশ জায়গা সমুদ্র সমতলের নিচে অবস্থিত। নেদারল্যান্ডসের মানুষ রীতিমতো পানির সাথে যুদ্ধ করে নতুন নতুন অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কারের মাধ্যমে আস্ত একটা রাষ্ট্রকে নিরাপদে রেখেছে। আর এজন্যই সারাবিশ্বে পানি ব্যবস্থাপনার জন্য নেদারল্যান্ডসের অনেক সুনাম আছে ।

নেদারল্যান্ডস একটা সুখি দেশ। ২০১৭ সালে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে নেদারল্যান্ডসকে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি সুখী দেশের মধ্যে একটি বলে ঘোষণা দেয়া হয়। এ থেকেই বোঝা যায় এই দেশ কতটা শান্তির। রাজনীতিবিদরা খুব সাধারণভাবে চলাচল করেন। বাইসাইকেলে করে প্রধানমন্ত্রী অফিসে যাচ্ছেন কিংবা অফিসে যাওয়ার সময় হাত থেকে পরে যাওয়া কফির কারণে নোংরা হয়ে যাওয়া জায়গা নিজেই পরিষ্কার করছেন এ রকম দৃশ্য নেদারল্যান্ডের রাজনীতির নিত্য দিনের সৌন্দর্য্য। নেদারল্যান্ডসের লোকজন ডাচ ভাষায় কথা বলেন, কিন্তু আপনি চাইলে ইংরেজিতেই কথা বলতে পারবেন। বলতে গেলে সবাই ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন।

উত্তর সাগরের পাশেই হচ্ছে আমস্টারডাম। আমস্টারডামে রয়েছে ৯০ টি ছোট-বড় দ্বীপ আর প্রায় ১২০০ এর মতো সেতু। আমস্টারডামে মানুষের সৃষ্ট বনভূমি আছে।

মাছ ধরার ছোট গ্রাম থেকে আজ ইউরোপের একটি উন্নত শহর হচ্ছে আমস্টারডাম। আমস্টারডামে প্রায় সাড়ে ৮ লাখ লোকের বসবাস। আমস্টারডম হচ্ছে সাইকেলের শহর। বিশ্বের বাইসাইকেলের রাজধানী হিসেবেও পরিচিত আমস্টারডাম। ছোট-বড়, ছেলে-মেয়ে সবাই সাইকেল চালায়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সাইকেল সাজানো আছে। আপনি চাইলে নির্দিষ্ট টাকা পরিশোধের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সাইকেল ভাড়া নিয়ে আমস্টারডাম শহর বেড়াতে পারবেন। আমস্টারডামে বাইক চালানের জন্য প্রশস্ত রাস্তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যাতে সবাই নিরাপদে চালাতে পারে। বলা হয়ে থাকে আমস্টারডামে যত মানুষ আছে তার চেয়ে বাইকের সংখ্যা বেশি!

পর্যটকদের কাছে আমস্টারডাম এতটাই জনপ্রিয় যে এখানে প্রতিবছর প্রায় ৫০ লাখ মানুষ বেড়াতে আসে। আমি কয়েকবার আমস্টারডামে গিয়েছি। প্রথমবার গিয়েছি সকাল বেলা, তারপর সারাদিন, সারারাত ঘুরে খুব ভোরে আবার আমার গন্তব্যে ফেরত আসি । সেদিন প্রচন্ড শীতের সাথে ছিল অঝোরে বৃষ্টি। তাপমাত্রা ছিল মাত্র ২ ডিগ্রি। ভাবেন তো ওদিন আমার কি অবস্থা ছিল?

কিন্তু ইউরোপে বৃষ্টি হলে সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আবার অনেক সময় দেখা যায় সারাদিন ফুঁই ফুঁই করে বৃষ্টি পড়ছে। মানুষ এই ধরনের বৃষ্টি গায়েই লাগায় না। বাংলাদেশে যেমন বৃষ্টির দিনে মানুষ লম্বা ছাতা হাতে রাখেন, তেমনি এখানকার বাসিন্দারারও লম্বা লম্বা ছাতা নিয়ে ঘোরাঘুরি করে। যাই হোক, তার মধ্যেই সারাদিন সারারাত শহরে ঘুরে কাটিয়েছি। আমস্টারডাম যেমন রাতে ঘুমায় না, তেমনি আমিও ঘুমাইনি। সে এক অন্যরকম অনুভূতি!

আরেকবার গিয়েছি প্রাণোচ্ছ্বল দম্পতি এবং আত্মীয় শ্যামল ও নিপা পরিবারের আমন্ত্রণে। বাংলাদেশিরা দেশের কাউকে পেলে যে কি আনন্দিত হয় সেটা তাদের সাথে না মিশলে বোঝা যেত না। তাদের বাসায় যেয়ে দেখি হরেক রকমের খাবার রান্না করা । একজন মানুষ আর কী পরিমাণ খেতে পারে কিন্তু তাদের শুভেচ্ছা আর ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ অন্তত ২০ আইটেমের রান্না দেখে তো আমি অবাক! দেশের মানুষ বলে কথা। তারাও হয়তো জানতেন সব আমি খেতে পারবো না কিন্তু দেশের মানুষকে সাদরে আমন্ত্রিত করার জন্য একটুও কষ্ট অনুভব করেননি। এ ঘটনা থেকেই বোঝা যায় তারা দেশের আত্মীয় স্বজনের কত অভাব অনুভব করেন। আমার বেড়ানোর সেই সময়টাতে নেদারল্যান্ডস এর মানুষ কিংস ডে পালন করছিলো। কমলা রঙের জামাকাপড়, মাথায় টুপি পরে মানুষজন রাস্তায় নেমে আনন্দ ফূর্তি করে। আশেপাশের পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছিলো যেন আমিও কমলার রঙে মিশে যাচ্ছি। 
খালের শহর আমস্টারডাম। আমস্টারডামের মধ্য দিয়ে অনেকগুলো খাল কাটা আছে। সপ্তদশ শতাব্দীতে এই খালগুলো কাটা হয়েছে। আমস্টারডামে প্রায় ৬০ মাইল এর বেশি খাল রয়েছে। শহরটা যেন খালের উপর দাঁড়িয়ে আছে! এসব খালের উপর মাঝে মাঝে ভাসমান বাড়ি দেখা যায়। সন্ধ্যা হলে যখন লাইট জলে তখন তার আলোকচ্ছটা পানিতে পড়লে পুরো ভাসমান বাড়িটাকেই মনে হয় স্বপ্নপুরী। ঈর্ষা হয় দেখে, যদি এরকম আমার একটা ভাসমান বাড়ি থাকতো! খালের পাশের বাড়িগুলোর রং একেকরকম। দেখতে খুব সুন্দর লাগে ।

আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির কথা নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মানবিক বিপর্যয়ের ফুটে উঠেছে এই ডায়েরিতে। ছোট্ট আনা ফ্রাঙ্ক সে কথাগুলো এমনভাবে লিখে গেছে যাতে অগণিত মানুষের চোখে এসেছে পানি। সেই আনা ফ্রাঙ্কের বাড়ি দেখতে আমস্টারডামে অনেকেই ভিড় করেন । 

আনন্দ প্রিয় জাতি ডাচরা। তারা যেকোনো অনুষ্ঠানে আনন্দে বিভোর থাকে। যেমন ধরুন, ছুটির দিনগুলোতেও দেখবেন মানুষজন রাস্তাঘাটে, খালে আনন্দ করছে। নেচে গেয়ে বেড়াচ্ছে।

সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে ওপেন মার্কেট বসে। এই দিনে গেলে আপনি অনেক কম দামে ভালো ভালো জিনিস কিনতে পারবেন। পাশাপাশি চাইলে সকালের কিংবা দুপুরের খাবারও ওপেন মার্কেটে বসে খেতে পারেন। অনেকটা আমাদের দেশে গুলিস্তানের ফুটপাথে যেইরকমভাবে জিনিস বিক্রি হয় ঠিক তেমন।

আপনি অনেক ধরনের ফুলের দেখা পাবেন আমস্টারডামে। বিচিত্র ফুলের শহর বলা চলে আমস্টারডামকে। ভাসমান ফুলের বাজার আমস্টারডাম এর সৌন্দর্য যেন অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়। রাস্তায় হরেক রকমের ফুলের সমাহার ঘটে। আপনি চাইলে ফুলের বীজ কিনে নিয়ে আসতে পারেন।

শত শত বছরের পুরনো কারুকার্যময় স্থাপত্যশৈলী দেখতে চাইলে আমস্টারডামের জুড়ি নেই। রাস্তা দিয়ে হাঁটি আর অবাক হয়ে দেখতে থাকি শৈল্পিক সৌন্দর্য্য। ভ্রমণের সময় দেখা এই জিনিষগুলো আজীবন আপনার স্মৃতিতে গাঁথা হয়ে থাকবে।

বিখ্যাত শিল্পী ভিন্সেন্ট ভ্যান গগ এর শহর আমস্টারডাম।ভ্যান গ জাদুঘরে না বেড়ালে কি আর আমস্টারডাম বেড়ানো হলো? ঐতিহাসিক সব ছবি দেখলে আপনার প্রাণ জুড়িয়ে যাবে। তবে সবকিছু বুঝতে গেলে আবার হিতে বিপরীত হতে পারে!

আপনি মাদাম তুসোর জাদুঘর ঘুরে আসতে পারেন। এখানে পৃথিবীর বিখ্যাত লোকজনের প্রতিকৃতি সংরক্ষণ করা আছে। আমাদের পক্ষে তো আর বিখ্যাত লোকজনের সাথে দেখা স্বাক্ষাৎ হওয়ার সুযোগ নাই তাই আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কিংবা নায়ক শাহরুখ খানের সাথে ছবি তুলে সংগ্রহে রাখতে চাইলে তুসোর জাদুঘরের বিকল্প কী আর আছে?

ঘুরতে ঘুরতে ক্ষুধা লাগলে খাবারের জন্য চিন্তার কিছু নেই। আমস্টারডাম ছোট একটা শহর। আপনি আপনার পছন্দ মত খাবার খেয়ে নিতে পারবেন। এমনকি আমাদের দেশের মাছ ভাতও পাবেন। তবে স্থানীয় খাবার খেতে ভুলবেন না।  মূলত আলো, সবজি, বিভিন্ন মাংস, সালাদ দিয়েই স্থানীয় খাবার তৈরি করা হয়। চিজ বা পনির পাগল আমস্টারডামের মানুষজন। যেকোনো রেঁস্তোরায় কিংবা খাবারে দেখবেন পনির রয়েছে। এমনকি পনির জাদুঘরও আছে আমস্টারডামে।

ভ্রমণের জন্য সাইকেল ভাড়া করে নিতে পারলে অনেক ভালো। তাহলে আপনি খুব সহজেই শহরটা ঘুরে দেখতে পারবেন। তবে নৌকায় করেও শহরটা দেখতে পারেন।

তবে সবচেয়ে ভালো লেগেছে যখন দেখেছি বাবা মায়ের সাথে তাদের ছোট বাচ্চারাও সাইকেল চালাচ্ছে! আমিও অপেক্ষা করছি কবে আমার ছেলেটা একটু বড় হবে। আমিও আমার পরিবার নিয়ে সাইকেলে করে ঘুরে বেড়াতে চাই। ঢাকার রাস্তায় যদি বাবা মায়ের সাথে সন্তানরা নির্ভয়ে, নিরাপদে সাইকেল চালাতে পারতো তাহলে কি মজাই না হতো!

লেখক: পর্যটক ও গবেষক

ইমেইল : debashisemp@gmail.com

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!