দুবাইয়ের চিঠি: জাগো জাগো বাংলাদেশ জাগো

সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাটিতে যে বেদনার পুরাণটি রচিত হলো শুক্রবার রাতে, ৮-৯ লাখ ক্রিকেটপ্রেমী প্রবাসী যে বিষাদ বেদনার সাক্ষী হলেন, তার ক্ষত থেকে বেরিয়ে আসতে তাদের বহু সময় লেগে যাবে। এমনকি যারা প্রতিবেশী ওমান, কুয়েত, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন গালফ দেশগুলো থেকে ক্রিকেটের এই মহারণের সাক্ষী হতে ছুটে এসেছিলেন সেই প্রবাসীদেরও।

জাহাঙ্গীর কবীর বাপপি, সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Sept 2018, 11:42 AM
Updated : 30 Sept 2018, 11:49 AM

এখনো যে কোন আমিরাত প্রবাসীর কাছে এশিয়া কাপ নিয়ে প্রশ্ন করুন, দেখবেন এখনো আবেগে তার গলা বুজে আসছে। ভারতের সঙ্গে ফাইনালের শেষ ওভারের সেই শ্বাসরুদ্ধকর সময়ের বেদনাবিধুর স্মৃতি ভার থেকে কোনমতেই সে বেরিয়ে আসতে পারছে না, কোনভাবেই না। থার্ড অ্যাম্পায়ারের হাতে লিটন দাসের বিতর্কিত আউটটি না হলে, মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের কাণ্ডজ্ঞানহীন ব্যাটিং না হলে বিজয় আমাদের অবধারিত ছিল- এ কথা এখনো ঘুরছে প্রবাসের অফিসপাড়ায়, দেশি চা-খানায় আর বাংলাদেশিদের অ্যাসেম্বলি পয়েন্টে।

আবুধাবিতে পাকবধের পর যে আশার পিদিম জ্বলে উঠেছিল তা সবার মনে আশার সঞ্চার করেছিল। তা বুকে নিয়ে ফাইনাল দেখার জন্য শুরু হয় বাংলাদেশিদের আয়োজন যজ্ঞ। সবার মুখে একটিই কথা- টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না, কোথাও না। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক টিকেটের উৎস হয়ে দাঁড়াল তখন পাকিস্তানিরা। ফাইনালে পাকিস্তান নেই তাই তাদের রণে থাকার আগ্রহ নেই। আর তাতে দুইগুন তিনগুন দাম বাড়িয়ে চলেছে মৌসুমি বাণিজ্য আর এদের টার্গেট ছিল বাংলাদেশিরা।

অসহায় প্রবাসীদের কাছে জাল টিকিট বিক্রি করে আর চড়া দামে অনেকে সে টিকিট কিনেও খেলা দেখতে না পেরে বিফল মনোরথে ফিরে যান। এমনকি যারা চড়া দামেও টিকিট পেয়ে ঢুকতে পেরেছেন তারা যেন সোনার হরিণ পেয়েছেন হাতের মুঠোয়। যারা পাননি স্টেডিয়ামের বাইরে বসে মোবাইল ফোনে ঝাঁক বেঁধে দাঁড়িয়ে বসে দেখেছেন খেলা, ওখান থেকেই ‘জাগো জাগো বাংলাদেশ জাগো’ শ্লোগান দিয়েছেন।

স্টেডিয়ামের গ্রিন কর্নারে ছিল বাংলাদেশিদের দুর্গ। অরেঞ্জ কর্নারে ভারতীয়দের মধ্যে থেকেও দমে ছিল না বাংলাদেশ। ড্রামের তালে তালে নেচে গেয়ে, শ্লোগান করতালিতে আর শিস-ধ্বনিতে মুখর হয়ে, লাল সবুজের পতাকা দুলিয়ে, রঙ-বেরঙের প্ল্যাকার্ড উঁচিয়ে তারা ম্যাশ বাহিনীকে সারাক্ষণ অনুপ্রেরণা যোগাতে থাকেন। আর শেষ ওভারে এসে সব হৈ-হল্লা থামিয়ে, ব্যানার ফেস্টুন নামিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে প্রার্থনার করপুট ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন প্রবাসীরা। তারপরের ইতিহাস তো এশিয়া কাপ ফের অধরা হয়ে যাবার ইতিহাস।

আহমদ ইখতিয়ার আলম পাভেল দুবাই ওয়াটার অ্যান্ড ইলেক্ট্রিসিটির একজন প্রকৌশলী। তিনি বলেন, “স্টেডিয়ামে আমার পেছনে একটা ছেলে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অফুরান প্রাণশক্তি নিয়ে দেশকে সাপোর্ট করে গেছে। হাতে বিশাল বড় পতাকা, একা নাড়াতে পারে না। আমাদের মত মৃতপ্রায় সমর্থকদের ডেকে ডেকে তার সঙ্গে পতাকা ধরে নাড়াতে সাহায্য করতে বলছিল। বোঝাই যাচ্ছিল, খুব বড় কোন জব করে না, জিজ্ঞেস করতেই বলে- আজমানে একটা গ্যাস সাপ্লাই কোম্পানিতে কাজ করে, শেষ সম্বল ৪০০ দিরহামের মতো পকেটে ছিল। তা নিয়েই এসে গেছে। আমাদের দলের অবস্থা তখন খারাপ, স্কোরবোর্ডের দিকে তাকিয়ে সে খুব ভারি গলায় বললো, জানেন কেন আসছি ভাইজান? কারণ আমি যেদিন মাঠে আসি বাংলাদেশ হারে না, আজ বাংলাদেশকে জেতাতে এসেছি। এমন দেশপ্রেম থাকলে জয় আমাদের একদিন হবেই।”

খেলা শেষে দুবাই প্রবাসী সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার রফিকুজ্জামান লিটন বলেন, “পতাকা গায়ে জড়িয়ে স্টেডিয়াম ছাড়ছি। নামতে নামতে কমপক্ষে ২০ জন ভারতীয় দর্শক হ্যান্ডশেক করেছেন, জড়িয়ে ধরেছেন। সবাই সান্তনার কথা শুনিয়েছেন- তোমরা ভালো ফাইট দিয়েছ, শুধু দিনটা তোমাদের ছিল না, তোমরা আসলেই ট্রফি ডিজার্ভ করো।” 

আবুধাবি প্রবাসী মোহাম্মদ দিদারুল আলম হার মানতে নারাজ। তিনি বলেন, “একটা ছোট্ট কাপ দিয়ে কী হবে, ওরাতো ষোল কোটি মানুষের মন জয় করে নিয়েছে, সাবাস টাইগার বাহিনী।”

দুবাই প্রবাসী সংস্কৃতিকর্মী ও টিম-৭১ এর সভাপতি শহীদুল বাপ্পা এখানেই দমে যাবার নন। তিনি বলেন, “এবারের এশিয়া কাপে প্রবাসীদের হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা ছিল বাংলাদেশ টিমের সবচেয়ে বড় পাওনা। সেটাকে শক্তি করে আর আপামর দেশবাসীর ভালবাসাকে অনুপ্রেরণা করে টিম বাংলাদেশ তার যে কোন প্রতিপক্ষকে ভবিষ্যতে মোকাবেলা করবে।”

শারজাহ প্রবাসী তরুণ ব্যবসায়ী ও অভিনয়শিল্পী আমির মোহাম্মদ বলেন, “বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে জানে, মাশরাফি বাহিনীর এই তুমুল যুদ্ধ দুবাই বহুদিন মনে রাখবে।”

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!