কায়রোর চিঠি: তিমি উপত্যকায় দুজন অনারব

প্রায় বছরখানেক আগের কথা। তখন শীতকাল যায় যায়। সূর্যের চোখ রাঙানো ভাব পুরোপুরি আসেনি। চাইলে অনায়াসেই যেখানে ইচ্ছে বের হওয়া যায়।

মোহাম্মাদ আবু জাবের, মিশরের কায়রো থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Sept 2018, 10:21 AM
Updated : 28 Sept 2018, 10:24 AM

তবে মাঝ দুপুরে রোদের প্রখরতা বাড়ে বলে কেমন অস্বস্তি লাগে। মরুময় এলাকা বলে কথা, তাতে যাই হোক, আমি আর ইকবাল ভাই সিদ্ধান্ত নিই কোথাও ভ্রমণে বের হবো, সঙ্গী আমরা দুজনই। সংখ্যা বাড়াতে গেলে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয় বলে এই সিদ্ধান্ত। যাবো ‘ওয়াদি আল হিতান’। একদিনেই গিয়ে দেখে আবার ফিরে আসা যায় এ জাতীয় একটি অঞ্চল এটি। তবে ইতিহাস ঐতিহ্যে মিশরের অন্যান্য অঞ্চল থেকে এর গুরুত্ব কোন অংশে কম নয়।

কোন একদিন ভোরেই আমরা বেরিয়ে গেলাম ওয়াদি আল-হিতানের উদ্দেশ্যে। সঙ্গে জামা-কাপড় কিংবা খাবার দাবারের সরঞ্জামাদি বলতে কিছু নেই, শীত আর গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময় বলে অতিরিক্ত এসবের চাহিদা নেই। যদি প্রয়োজন পড়ে, তাহলে রাস্তায় দোকানপাট আছে, এই পরিকল্পনা। মানে চলাফেরার জন্য আছে গাড়ি, খাবারের জন্য আছে হোটেল কিংবা অন্যান্য প্রয়োজনে দোকান। ব্যস, আর কিছুর দরকার নেই। মুক্ত পৃথিবীতে এবার যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াও। সমগ্র পৃথিবীর দরজা তোমার জন্য খোলা।

‘ওয়াদি আল হিতান’ শব্দটি আরবি। ইংরেজিতে বলে ‘হোয়েল ভ্যালি’। বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘তিমি উপত্যকা’। এটি মিশরের সর্ব দক্ষিণের জেলা ফাইউমে অবস্থিত। তার উত্তর দিকের ওয়াদি আর-রাইয়ানের সংরক্ষিত এলাকার প্রায় এক হাজার সাতশত ৫৯ কিলোমিটার জুড়ে আছে এই ঐতিহ্যবাহী স্থানটি। রাজধানী কায়রো থেকে জায়গাটির দূরত্ব তিনশত ৫০ কিলোমিটার।

প্রায় শতাধিক তিমির ধ্বংসাবশেষ, এর বিশাল আকৃতির কঙ্কাল আর বসবাস করা গর্ত পাওয়া যাওয়ায় ২০০৫ সনে এ অঞ্চলটিকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থান বলে ঘোষণা দেয়। তখন এর নামকরণ করা হয় ‘ওয়াদি আল-হিতান’ কিংবা ‘হোয়েল ভ্যালি’ হিসেবে। উনিশ শতকের পর মিশরের ভূমিতে আবিষ্কার হওয়া অন্যান্য ঐতিহ্যের মধ্যে এটির তাৎপর্য সর্বাপেক্ষা বেশি। বালু আর পাথর খুঁড়ে খুঁড়ে আবিষ্কারের আগে এখানে চোখে পড়তো কেবলই ধু ধু মরুভূমি। তখন এইদিকে কারো তেমন কোন আকর্ষণ ছিল না।

ফাইয়ুমের একেবারে দক্ষিণের শেষ সীমানায় অবস্থিত বলে ওয়াদি আল হিতান যেতে সরাসরি কোন বাস কিংবা ট্রেন নেই। তার জন্য রাস্তা ভেঙ্গে ভেঙ্গে একের পর এক গাড়ি পরিবর্তন করতে হয়। সর্বশেষ স্টেশন মাফরাক এর পর আর যাত্রীবাহী কোনকিছু নেই। ব্যক্তিগতভাবে ভাড়া নেয়ার জন্য আছে জিপ। একটি জিপের যাত্রীসংখ্যা কম হলেও পনের থেকে বিশ জন হয়। অর্থাৎ একটি ছোট খাট গ্রুপের মতো হলে জিপে ভ্রমণে সুবিধা। এক্ষেত্রে আমরা মানুষ মাত্র দুজন। দুজনে এতো বড় একটা জিপ টেনে নেয়ার কোন মানে হয় না। কাজেই বিকল্প ভাবতে লাগলাম।

মধ্য দুপুরে টকটকে লাল সূর্য তখন মাথার উপর। মরুভূমির লু হাওয়া পরিবেশটাকে উত্তপ্ত করে তুলছিল ধীরে ধীরে, আমরা কোন পর্যটককে পেলাম না, যে আমাদের সঙ্গী হয়ে ওয়াদি আল হিতান যাবে। সাধারণত গ্রীষ্মের মৌসুম শুরু হলে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে যায়। সেসময় মিশরের যত্রতত্র পর্যটকদের দেখতে পাওয়া যায়। মনে হয় পুরো দেশটাই পর্যটনস্থল, বিশ্ব ঐতিহ্যে ভরপুর। এদের অবাধ বিচরণে মিশরকে আর মিশর মনে হয় না, মনে হয় ইউরোপের কোন এক ভূখণ্ডে বাস করছি। কিন্তু আজ কেন এর ব্যাতিক্রম হচ্ছে, তার কোন হদিস খুঁজে পেলাম না।

জিপ ছাড়া আর আছে সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা সিএনজি। কোন উপায় না পেয়ে একটি সিএনজি ভাড়া করলাম। এখান থেকে পাড়ি দিতে হবে প্রায় ২০০ কিলোমিটার পথ। এই ক্ষুদ্রযানটির পক্ষে তা কীভাবে সম্ভব হবে ভেবে পেলাম না। তাও চালকের সাহস দেখে আমাদেরও মনে মনে সাহস সঞ্চার হলো। অবশ্য এখান থেকে রাস্তা যেমন মনে হচ্ছে, তাতে সম্ভব হবারই কথা!

প্রথম ১০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলাম আমরা খুব সহজেই। পিচঢালা পথ। দু’পাশে দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমি। চোখ যতদূর যায় দেখি শুধুই মরুভূমি। মাঝে মাঝে পাথর জমে জমে পাহাড়ের মতো গড়ে উঠেছে।

মরুর বুকে পাহাড়গুলো বড় বিচিত্র ধরণের। কোথাও কোথাও বাতাসের বেগে মরুঝড়ের মতো উড়ছে বালি আর পাথর কণা। এগুলো কখনও হঠাৎ চোখে এসে পড়লে চোখ অন্ধ হয়ে যাবে নিমিষেই। আমরা বালু আর পাথর কণার ভয়ে মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে ফেলি। কিন্তু পুনরায় আবার যখন চোখ মেলি, তখন দেখি নয়নাভিরাম কোন সৌন্দর্য। সঙ্গে সঙ্গে আফসোস হয়, চোখ বন্ধ থাকাকালীন না জানি হারিয়ে ফেললাম অপরূপ অন্যকোন দৃশ্য। সিএনজিটি আমাদেরকে নিয়ে এই পথটি শেষ করে বাম দিকে মোড় নিল। সোজা রাস্তাটি সরাসরি মিশরের সোয়াইদ জেলার দিকে গেছে।

এবারের পথটি আমাদের কাছে খুব ভীতিকর ঠেকল। এটি আর পিচঢালা নয়। কেবল দুপাশে বালু আর পাথরগুলো সরিয়ে রাস্তা বানানো হয়েছে। রাস্তা বলতে কিছু মনে হয়নি। পাথরগুলো আবার ফিরে এসেছে। বালুও বাতাসের ঝটকায় এসে স্থানে স্থানে স্তূপ হয়ে আছে। কোথাও কোথাও হয়ত পথের কোন নিশানাই থাকবে না। এখান থেকে পাড়ি দিতে হবে আরো একশত কিলোমিটার পথ। মানে পুরো রাস্তাটাই এমন। বাহন হলো আমাদের খুব দুর্বল এক সিএনজি। অবস্থা বেগতিক মনে হলো। এই পাথুরে আর বালুময় পথ পাড়ি দিয়ে আমরা কী করে গন্তব্যে পৌঁছব ভেবে হতাশ হতে লাগলাম।

কিন্তু তারপরও প্রথমদিকে উদ্যমতার জোয়ার সৃষ্টি করে রওয়ানা হয়ে গেলাম। যা হবার পরে একটা হবে আপাতত চললাম। আমরা চললাম তো চললাম, পথ যেনো আর শেষ হচ্ছে না। আমাদের যানবাহনটি তো না চলার মতোই। খুব ধীর যে তার চলার গতি! বালু আর পাথর দিয়ে এটি চলতে অভ্যস্ত নয়, বোঝা যাচ্ছে। তাও ঠুকঠাক শব্দে চলছে। কখনও পাথরের ধাক্কায় এদিক ওইদিক কাত হয়ে পড়ে। আবার চলতে শুরু করে। আবার ধাক্কা লাগে, সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়, আবার স্টার্ট নেয় এভাবে।

একসময় বড় ধরনের একটি পাথরে আঘাত লেগে যানবাহনটির সামনের চাকা খুলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে চালকও সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। আরেকটু হলে কাচে আঘাত লেগে তার মাথাটাই ফেটে যেতো। এদিকে আমাদেরও মাথায় হাত দেবার মতো হলো। কী ভেবে কী করলাম। কেন এই ক্ষুদ্র যানটি নিতে গেলাম। এই সিদ্ধান্ত ছিল বড়শি দিয়ে সাগরে মাছ ধরার মতো। আমাদের আকাশে-বাতাসে হতাশার কালোমেঘ আরো ঘনীভূত হয়। চারদিক যেনো অন্ধকার হতে শুরু করে। অবাক বিস্ময়ে বিচলিত মনে ভাবি, পারব কী আজ গন্তব্যে পৌঁছতে!

চালক সাহেব খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চাকা বদলালেন। যেনো কিছুই হয়নি। এরকম তার মাঝে মধ্যেই হয় এমন ভাব। জিজ্ঞেস করলাম, এ পথ দিয়ে এই যানবাহনটি নিয়ে ইতিপূর্বে আর কয়বার এসেছেন। বললেন, বছর তিনেক পূর্বে একবার এসেছিলেন। তখনকার রাস্তাটি এমন ছিল না। এই তিন বছরে কত পরিবর্তন হয়ে গেছে, কিন্তু আমাদেরকে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিলেন। আমি মনে মনে ভাবলাম, পাহাড় আর মরুভূমিতে যাদের বসবাস, তাদের এটা কী, এরচেয়ে বড় কোন বিপদ এলেও বিচলিত হবার কথা নয়। আমি ফিরে যেতে চাইলাম। অবস্থা যা বুঝেছিলাম, তাতে অন্তত নিরাপদে ফিরে যাওয়াটাই উত্তম মনে হচ্ছিল। কিন্ত সঙ্গে থাকা ইকবাল ভাই বেশ সাহসী মানুষ। আমাকে অভয় দিয়ে বললেন- ‘ইনশাল্লাহ আমরা সবকিছু দেখে শুনে নিরাপদে ফিরতে পারব।’ কথাটি আমার ভাবাবেগে কোন পরিবর্তন আনল বলে মনে হলো না।

আমরা আবারও চলতে শুরু করলাম। এ পর্যায় পূর্বের ধারণামাফিক আর কোন রাস্তা দেখা যাচ্ছে না। বালু আর পাথরগুলো নিজ নিজ জায়গাতে ফিরে এসেছে। পথের কোন চিহ্নই রাখতে চায় না এরা। যেন কেউ এলে মরুর ধাঁধায় চিরকালের জন্য হারিয়ে যায়। প্রকৃতির কী লীলাখেলা! তবে কোথায় চলছি, কোনদিকে যাচ্ছি আমরা। আশপাশে শুধুই মরুভূমি। এছাড়া আর কোনকিছু চোখে পড়ছেনা। এই কূল-কিনারাহীন মরুর কোন প্রান্তে ছুটব? আরবের বিদুঈনরাই বা এপর্যায়ে কী করে, যখন গন্তব্যে পৌঁছার মতো কোন চিহ্ন না থাকে? নাকি আজ এই মরুর ঘুরবিপাকেই জীবনলীলা সাঙ্গ হবে। কত মানুষই তো পৃথিবীর দিক নির্ণয় করতে গিয়ে হারিয়ে যান, আমরাও না হয় তাদের মতো হলাম।

আশপাশে তো আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। জনমানবশূন্য নির্জন পথপ্রান্তর। পুরো অঞ্চল জুড়ে একজন মানুষের ছায়াও নেই। কোথাও কোন গাড়িও চলতে দেখা যাচ্ছে না। বেদুঈনদের কোন উটও নেই। কয়েক বছর ধরে এপথে কারো কোন যাতায়েত নেই মনে হচ্ছে। প্রকৃতি তো দেখছি কেমন এক উদাস ভঙ্গিতে আমাদের দিকে চেয়ে আছে। সন্তানহারা জননীর মতো একদিকে চেয়ে আছে, হতাশামাখা তার সেই চাহনি। নাকি আমাদের হতাশ আর বেদানাবিধুর মন প্রকৃতিতে প্রভাব ফেলছে। সেও আমাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করছে।

আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে বুঝি! কিছুক্ষণের মধ্যেই মুষলধারে বৃষ্টি নামতে আরম্ভ করবে! সবকিছু ভারি করে তুলবে। নিস্তব্দ পরিবেশে বৃষ্টির শব্দগুলো কানে কী চমৎকার শোনাবে! সেইসঙ্গে শুরু হবে বজ্রপাত। অন্ধকারচ্ছন্ন আকাশ নেমে আসবে কখন পৃথিবীতে! কেয়ামতের বিভীষিকা বুঝি আজই শুরু হলো!

নাকি দুনিয়া কাঁপিয়ে মরুঝড় আমাদের দিকে তেড়ে আসছে লাগামহীন ঘোড়ার মতো। যেখানে যাচ্ছে সব তছনছ করছে। পৃথিবীর সবকিছু উলট-পালট করে দিচ্ছে। পথে যাকে পাচ্ছে আস্ত গিলে ফেলছে। আমরা তাহলে এই ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ ঝড়ের করাল গ্রাসে নিঃশেষ হয়ে গেলাম! বড় বিচিত্র এই পৃথিবীর ধরন, বড় বিচিত্র তার প্রকৃতি। আমাদেরকে একটু আশ্রয় দেবার কেউ কোথাও নেই। মাইলের পর মাইল যাচ্ছি কারো তো ছায়া চোখে পড়ছে না। পৃথিবীতে কোন মানুষ নেই আর! সবাই মারা পড়েছে কোন এক আকস্মিক দুর্ঘটনায়!

মনে পড়ে গেল তখন, আগের দিন মায়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম দেশে। মা বললেন- তিনি নাকি আমাকে নিয়ে কী এক আজে-বাজে স্বপ্ন দেখেছেন। আমি বারবার জানতে চাইলেও বলেননি মা, কী স্বপ্ন। আজ ভাবতে লাগলাম, এই বুঝি মায়ের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে চলছে। আমি বুঝি নিরুদ্দেশ হয়ে গেলাম। এই সুবিশাল পৃথিবীর গর্ভে হারিয়ে গেলাম। মায়ের দেখা স্বপ্ন তো আর মিথ্যে হয় না। এগুলো ভাবতে ভাবতেই অনেক দূর পথ চলে এলাম। হঠাৎ দেখি সামনে একটা বোর্ডে লেখা- ‘ওয়াদি আল-হিতান, ৫ কিলোমিটার’। আমি আবার নিজেকে ফিরে পেলাম। মনে মনে বললাম, না, এখনি একেবারে চলে যাওয়ার সময় আসেনি, আরো কিছুকাল হয়তো পৃথিবীতে থাকব।

আমরা হোয়েল ভ্যালিতে পৌঁছলাম। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে বালু আর পাথরের পাহাড়। দীর্ঘ আয়তন নিয়ে পাহাড়গুলো গড়ে উঠেছে। এগুলোর মাঝখানে মাঝখানে বিশাল ফাঁকা জায়গা। এগুলোতেই তিমির বসবাস ছিল। মূলত এ অঞ্চলটি তিমির কঙ্কাল আর পূর্ণাঙ্গ গর্ত পাওয়া যাওয়ার দরুণ খ্যাতি লাভ করে। যখন গোটা উপত্যকাটি বড় একটি মহাসাগরের অংশবিশেষ ছিল। যার বয়স আজ থেকে প্রায় ৪০ মিলিয়ন বছর।

তৎকালীন মিশরের আইয়ুসিনদের শাসনামল। এই মহাসাগরটিকে তখন থেকে প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছর পূর্বে বলা হতো তিথিস সাগর। গোটা উত্তর আফ্রিকা জুড়ে ছিল এই সাগরটির ব্যাপ্তি। ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে বালু আর পাথর জমতে জমতে এর সাগরের কোন নিদর্শনই আজ আর অবশিষ্ট নেই। জানা গেছে ভূমধ্যসাগর আর লোহিত সাগরের মধ্যবর্তী জায়গায় এই সাগরটির অবস্থান ছিল। প্রাচীন পৃথিবীর কোন মানচিত্রে এই দৃশ্যটি দেখা যেতে পারে।

এখানে ছিল আরো সামুদ্রিক বড় বড় গর্ত। উন্মুক্ত যাদুঘরে এর কিছু নিদর্শন এখনও আছে। স্পর্শ না করার শর্তে পর্যটকদের এর ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। আমরা ৪০ পাউন্ড দিয়ে টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ১৯০৩ সনে মিশরি জীবাশ্মবিদদের তৎপরতায় এই গর্তগুলোর সন্ধান পাওয়া যায়। অনুসন্ধানে পাওয়া যায় সবচেয়ে বড় মাছটির গর্ত, যেটি ‘ব্যাসিলুসরস ইযিস’ নামে বিখ্যাত। এটি লম্বায় ১৮ মিটার। এর চেয়ে কম দৈর্ঘ্যের মাছটির নাম ‘দুরিউদুন ইসরুক্স’। পাওয়া যায় এরও কঙ্কাল এবং বসবাসের গর্ত।

১৯০২ সনে লন্ডনের মিজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্টরিতে নতুন প্রজাতির তিমি হিসেবে এগুলোকে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়। ১৯৮৯ সনে মিশরি এবং মার্কিন জীবাশ্মবিদদের উদ্যোগে এখানে আরো নানা প্রজাতির তিমির কঙ্কালের আবিষ্কার করা হয়। নিদর্শন হিসেবে ছিল এগুলোর বসবাস করা গর্ত।

ডানে বামের দুই প্রান্তে বড় দুটো যাদুঘর আছে। পাহাড়ের ভেতর বেশ দীর্ঘ আয়তন নিয়ে তৈরি করা। প্রবেশ করলে মনে হবে বুঝি পাহাড়ের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছি। একদিনে জাদুঘর দুটি একসঙ্গে ঘুরে শেষ করা যাবে না। এগুলোতে আছে প্রাচীন পৃথিবীর গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে নিদর্শনাবলী। কীভাবে এখানে সাগর বিলীন হয়ে মরুভূমি সৃষ্টি হয়েছে সেসংক্রান্ত নানা নিদর্শন। পৃথিবীর বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া নানা বিচিত্র প্রাণীর আকৃতি। তিমির কঙ্কাল পড়ে আছে দীর্ঘ জায়গা নিয়ে। এই মরুভূমিতে কী করে তিমি এলো তাতেই পর্যটকদের বিস্ময়। একটাকে দেখলাম ইয়া বড় হা করে আছে। কাউকে আস্ত গিলে ফেলবে এমন ভাব। আমি কাছে গিয়ে স্পর্শ করতে চাইলাম। ভাবতেই অবাক লাগে আজ থেকে ৪০ মিলিয়ন বছর পূর্বে এখানে এদের বসবাস ছিলো।

পুরো অঞ্চলটি পাহাড়বেষ্টিত হওয়ায় কী এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছে। মরুর বুকে সারি সারি পাহাড়। উপরে উন্মুক্ত আকাশ চেয়ে আছে নিচে মরুর দিকে। এখানের মরুবালি অন্যান্য বালির মতো নয়। এটাকে তাই সাদা মরুভূমি বললে ভুল হবে না। এখানে কেউ একদিনের ভ্রমণে আসে না। আসতে হয় ন্যূনতম সপ্তাহখানেকের জন্য। রাতের বেলা সবচেয়ে চমৎকার দৃশ্যটির অবতরণ হয়। মরুতে তাবু গেড়ে রাত্রিযাপনের পদ্ধতি আছে। তখন শুয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকালে দেখা যাবে তারকারাজির বিচরণ। সারারাত কীভাবে এগুলো আকাশের গায়ে চলাফেরা করছে, এদিক ওদিক যাচ্ছে। তখন খোলা আকাশের নিচে নয়, বরং মনে হবে তারকার প্রহরায় শুয়ে আছি।

তাবু ছাড়াও রাত্রিযাপনের জন্য এখানে অনেকটা প্রাচীন আদলে মাটির ঘরের মতো ছোট ছোট ঘর বানানো আছে। বড় বড় পাথর কেটে এগুলো তৈরি করা। ঘরের ভেতর থাকলেও উপরে কিন্তু খোলা আকাশ দেখার ব্যবস্থা আছে। সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, একবার টিকিট কাটলে দ্বিতীয়বার আর কোনকিছুর জন্য টিকিট কাটতে হয় না। প্রতিটি স্পটে যতক্ষণ ইচ্ছে থাকা যায়। এক্ষেত্রে যারা সপ্তাহখানেকের ভ্রমণে আসেন তাদের জন্য আরো বেশি সুবিধা। সরকারি সময়ের হিসাবটা গণ্য করা হয় যারা একদিনের ভ্রমণে আসেন তাদের ক্ষেত্রে। খাবার দাবারের খরচের ব্যাপার কিন্তু প্রত্যেকের জন্যই এক। অর্থাৎ নিজ খরচে খাওয়া দাওয়া।

এখানে অনেক ধরনের হোটেল থাকলেও মানসম্মত তারকা মানের কোন হোটেল নেই। তাই খাবের প্রয়োজনীয় জিনিস সঙ্গে নিয়ে আসলেই বেশি ভালো। বিদেশি পর্যটকরা মিশরিয় খাবারে কম সময়ই তৃপ্ত হয়ে থাকে। পাকশাক করে এখানে অনাসায়েই দিনের পর দিন পার করা যাবে। তখন পৃথিবীর অন্য কিছুর প্রতি আর কোন ভাবনা থাকবে না। এর মনোরম পরিবেশ আর মনোমুগ্ধকর চিত্র-বিচিত্রের প্রেমে পড়বে যে কেউ।

আমরাও এর প্রেমে পড়ে গেলাম। যাওয়া কথা মনে উঠতেই কেমন হাহাকার ভাব বিরাজ করল। মন ভরে কোনোকিছু দেখতে পারছিলাম না। কোথাও সময় একটু বেশি ব্যয় হলে ফেরার তাড়া আসছিল সঙ্গে সঙ্গে। তাই আর যেতে চাচ্ছিল না মন, তারপরও তো যেতে হবে। পৃথিবীর ধরনটাই যে এমন, যেখানে মানুষ আসে শুধু ফিরে যাওয়ার জন্য। আমরাও ফিরে চললাম, একরাশ অভিজ্ঞতা নিয়ে। যাকে বলা যায়, জীবনের বিরল এক অভিজ্ঞতা। কোনদিন এর কোন অংশে কাজে লেগে যায় বলা যায় না, হতে পারে অন্য কোন পৃথিবী দেখার কাজে।

 লেখক: প্রবাসী শিক্ষার্থী, আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো

এই লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!