মোনালিসার শহর প্যারিস

চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চির অসাধারণ চিত্রকর্ম মোনালিসার কথা কে না শুনেছেন! যখন স্কুল-কলেজে পড়তাম তখন থেকেই রহস্যময় মোনালিসার ছবি যেন আমায় পেছন থেকে ডাকত। ভাবতাম কোনদিন কি দেখা হবে তার সঙ্গে!

দেবাশিস সরকার, ফ্রান্স থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Sept 2018, 09:26 AM
Updated : 25 Sept 2018, 12:43 PM

মানুষ মন থেকে কোনো কিছু চাইলে আর সেটা পাবার জন্য পরিশ্রম করলে অসম্ভব বলে কিছু নেই। হ্যাঁ, সৌভাগ্যক্রমে দেখা হয়েছে আমাদের। তাই প্রথমবারের মতো ইউরোপে যাওয়ার পর প্যারিসে যেতে দেরি করিনি, বেশি দেরি করিনি মোনালিসার সঙ্গে দেখা করতে। একসঙ্গে ছবি তুলতেও সময় নেইনি। ছোটবেলার স্বপ্ন পূরণ বলে কথা।

ইউরোপের সৌন্দর্য হচ্ছে খুব সহজেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে বেড়ানো যায়। তবে ইউরোপের ভিসা পাওয়াটা একটু কঠিন। কোনো দেশ ভিসা দেয়ার ব্যাপারে খুব কঠিন আচরণ করে আবার কোনো দেশ তাদের নিয়ম অনুযায়ী আবেদন করলে খুব সহজেই ভিসা দিয়ে দেয়। তাই ইউরোপ ভ্রমণের আগে যে দেশ ভিসা দেয়ার ব্যাপারে একটু কম কড়াকড়ি করে সেখান থেকে ভিসা নিয়ে নিতে পারেন। আমি বেলজিয়ামের ভিসা নিয়ে প্রথম ইউরোপে যাই। আপনার যদি সেনজেন ভিসা থাকে তাহলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের যে কোনো দেশে নির্দ্বিধায় বেড়াতে পারবেন।

ইউরোপের একেক দেশের সৌন্দর্য একেক রকম। তবে প্রতিটা দেশই অসাধারণ সুন্দর। ইউরোপে খালি ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করে। আপনি ইউরোপে বিমানে, ট্রেনে কিংবা বাসে করে বেড়াতে পারবেন। তবে আমি বেশিরভাগ সময় বাসে ভ্রমণ করতাম। কারণ বাসে যাতায়াত করলে আপনি চারপাশের পরিবেশ দেখে দেখে যেতে পারবেন। দেশটাকেও খুব কাছ থেকে দেখতে পারবেন। যদিও বাসে সময় একটু বেশি লাগে, কিন্তু বেড়ানোর উদ্দেশ্যে বের হলে এটা কোনো কষ্টই না।

ফ্রাঞ্চের রাজধানী প্যারিসে জনসংখ্যা ২২ লাখের কিছু বেশি। তা ভ্রমণ করার মতো রোমাঞ্চকর বিষয় পৃথিবীতে আর কী আছে! কী নেই প্যারিসে! ভ্রমণের তেষ্টা মেটাবার সব কিছুই আছে প্যারিসে। এদেশের মানুষ তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মতই অনেক সমৃদ্ধ। হাজার বছরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির শহর প্যারিস। জাদুঘরের শহর প্যারিস। প্যারিস হচ্ছে বিশ্বের ফ্যাশন জগতের রাজধানী এবং কেনাকাটার জন্য সুবিখ্যাত। আলোর শহর প্যারিস। সন্ধ্যা হওয়ার পর অন্ধকার প্যারিস যখন আলোকিত উঠে তখন প্যারিসের সৌন্দর্যে অভিভূত না হয়ে থাকা যায় না।

প্যারিসের বুক দিয়ে বয়ে চলা সেইন নদীতে জাহাজে করে ভ্রমণ করতে কার না ভালো লাগে। আর যদি ভ্রমণ করতে করতে স্থানীয় খাবারের স্বাদ নেয়া যায় তাহলে তো কথাই নেই। পৃথিবীর বিখ্যাত আইফেল টাওয়ারের কথা কে না জানেন! প্যারিস আর আইফেল টাওয়ার একসঙ্গে গাঁথা। একটিকে বিচ্ছিন্ন করলে আরেকটি শ্রীহীন দেখাবে। ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং ৩২৪ মিটার উঁচু আইফেল টাওয়ারে টিকিট কেটে উপরে উঠতে পারবেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল উপরে উঠে প্যারিস দেখার। সুউচ্চ আইফেল টাওয়ার যেন আপনাকে স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত আসলে যখন আইফেল টাওয়ারের লাইট জ্বলে উঠে তখন তার সৌন্দর্য লিখে প্রকাশ করা যাবে না।

প্যারিসের আরেকটি বিখ্যাত দর্শনীয় জায়গা হচ্ছে ল্যুভর জাদুঘর। ল্যুভর জাদুঘর বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাদুঘর যা ১৭৯৩ সালে প্ৰতিষ্ঠিত হয়। ৬ লাখ ৫২ হাজার ৩০০ বর্গফুট জায়গা নিয়ে এই জাদুঘর। বুঝতেই পারছেন কত বিশাল। ল্যুভর জাদুঘরে ঢোকার জায়গাটা ১৯৮৯ সালে নির্মিত কাচে ঘেরা ২১ মিটার উচুঁ পিরামিড আকৃতির। অসাধারণ সব শিল্পকর্ম আছে এই ল্যুভর জাদুঘরে। ল্যুভর জাদুঘরে গিয়ে মোনালিসার সঙ্গে সেলফি তুলতে পারলে আর কী লাগে!

মোনালিসার ছবি মনে হতে পারে অনেক বড় আকৃতির, কিন্তু বাস্তবে অনেক ছোট আকারের (২১ আর ৩০ ইঞ্চি)। এই বিখ্যাত চিত্রকর্ম দেখতে গেলে আপনাকে অনেক মানুষের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে দেখতে হবে। ছবির চতুর্দিকে নিরাপত্তার খাতিরে রীতিমতো বেড়া দেওয়া হয়েছে। সেটার বাইরে থেকে দেখতে হয়। আপনি যদি পুরো ল্যুভর জাদুঘর একবারে ঘুরতে যান তাহলে আমি নিশ্চিত আপনি ঘুরতে ঘুরতে দুর্বল হয়ে যাবেন। এত বিশাল জাদুঘর, এত সংগ্রহ, ভালোভাবে সবকিছু দেখতে গেলে বহুদিন লেগে যাবে।

বলা হয়ে থাকে আপনি যদি প্রতিদিন কোনো বিরতি ছাড়া ৩০ সেকেন্ড করে একেকটা আইটেম দেখতে থাকেন তাহলেও সবকিছু দেখতে আপনার ১০০ দিন লাগবে। আমি কিছুক্ষণ ঘুরে আবার বসার জায়গায় বিশ্রাম নিয়ে ঘুরতে বের হতাম। এই জাদুঘরে যাওয়া মানে বিশ্বের অনেক বিখ্যাত জিনিস এক জায়গায় দেখে ফেলা। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে!

প্যারিসে ভ্রমণ করলে হাজার হাজার বছরের ঐতিহাসিক স্থাপত্যের নিদর্শন দেখা যাবে। প্যারিসে যাওয়া মানে টাইম মেশিনে পুরনো দিনে ফিরে যাওয়া।  এক শৈল্পিক কাজের নিদর্শন নটরডেম ক্যাথেড্রেল বা উপাসনালয় (১৩০ মিটার লম্বা ও ৬৯ মিটার উঁচু) । প্রায় ৮০০ বছরের পুরনো এই ক্যাথেড্রেল। এটা বানাতেই প্রায় ২০০ বছর লেগে যায়। এ থেকেই বুঝা যায় কত শত হাজার বছরের ইতিহাস আপনি প্যারিস ভ্রমণ করলেই দেখতে পারবেন। তাছাড়া ‘আর্ক দে ট্র্যামফে’ হচ্ছে বিখ্যাত বীরযোদ্ধা নেপোলিয়নের যুদ্ধ বিজয়ের স্মৃতিস্তম্ভ। একটু নিখুঁতভাবে তাকালেই দেখা যাবে অসংখ্য যোদ্ধার ছবি সম্বলিত এই অসাধারণ স্থাপনা।

ফুটবল মাঠের মতো প্রশস্ত রাস্তা দেখতে হলে প্যারিসের জুড়ি নেই। নদীর পার দিয়ে হেঁটে হেঁটে চাইলে পুরো প্যারিস শহরটাকেই দেখে নেওয়া যাবে। প্যারিসের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখা পেলাম এক রিকশার মতো যানবাহন। দেখি আর ভাবি ভদ্রলোক মনে হয় বাংলাদেশের রিকশা ভ্রমণের রোমাঞ্চকর অনুভূতি থেকেই এরকম রিকশা চালাচ্ছেন। যাই হোক, পরিবেশ বান্ধব যানবাহন বলে কথা। মানুষের আচরণ অনেক ভালো। রাস্তা পার হতে চাইলে গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার আপনাকে আগে পার হতে দিবে। যদি বুঝতে পারে যে আপনি রাস্তা পার হবেন তাহলে ড্রাইভার আপনাকে অনুরোধ পর্যন্ত করবে আগে রাস্তা পার হবার জন্য। এজন্য ভালোলাগার অনুভূতিটাই অন্যরকম।

ফরাসিকে বলা হয় ‘ভালোবাসার ভাষা’, আবার ফ্রান্সকে বলা হয় ‘রোমান্টিক শহর’। তবে ফ্রান্সে গিয়েই বুঝেছি ভালোবাসার শহর কেন বলা হয়। প্যারিসের সেইন নদীর ব্রিজে ‘লাভ লক’ এর অভাব নেই। ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে প্রেমিক-প্রেমিকেরা নিজেদের নাম লিখে ব্রিজে তালা মেরে ঝুলিয়ে রাখে। চাইলে আপনিও লিখে আসতে পারেন। তবে ছবি নিতে ভুলবেন না। বলা তো যায় না পরে কাজে লাগতে পারে।

বিভিন্ন রকমের খাবার প্যারিসে পাওয়া যাবে। রাস্তার পাশেই অনেক খাবারের দোকান পাবেন। তাই ক্ষুধা লাগলে চিন্তার কিছু নেই। বাজেটের মধ্যেই খেতে পারবেন। তবে সেটা নির্ভর করে কোথায় খাবেন আর কী খাবেন তার উপর। ‘বাগেট’ হচ্ছে ফ্রান্সের একটি পরিচিত খাবার। যেখানেই যাবেন সেখানেই পাবেন। ‘বাগেট’ মূলত একধরণের লম্বা রুটি যার মধ্যে বিভিন্ন ধরণের সবজি, মসলা, পছন্দ অনুযায়ী মাংস, সালাদ ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা হয়। আমার তো প্রথম দিকে মুখে দিলেই মুখের ভেতরের ছাল উঠে যেত। আর স্যান্ডউইচ, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ, হরেক রকমের কেক হচ্ছে তাদের প্রিয় খাবার। রাস্তার মোড়ে মোড়ে কেকের দোকান। দেখলেই জিভে জল চলে আসে। তবে বিভিন্ন দেশের খাবার পাওয়া যায় প্যারিসে।
রেস্তোরাঁয় খেতে বসলে প্যারিসের লোকজন কয়েক কোর্স খাবার একসঙ্গে খায়। একবার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমাদের খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন রেস্তোরাঁয়। প্রথমে হালকা খাবার দেয়ার পর একটু পরে আরেক প্রকার খাবার দিলেন। যেহেতু দুইবার খাবার পরিবেশন করা হয়েছে আমিতো পেট ভরে খেয়ে নিয়েছি। পরে দেখি বিশাল এক সামুদ্রিক মাছ টেবিলে হাজির। এটা নাকি আসল কোর্স। আমি তো হতবাক। পরে দেখি আবার খাবার এসেছে, হালকা ডেজার্ট এবং শেষে ডেজার্টের আসল কোর্স। অতপর কফি খেয়ে মোটামুটি সব কোর্স শেষ হলো। বিদেশের মাটিতে কয়েক কোর্স খাবারের অভিজ্ঞতা ওই প্রথম।

প্যারিসে আমি দুই দিন ছিলাম। এই দুই দিন বাংলাদেশের খাবারের অনেক অভাব বোধ করেছি। মিষ্টি জাতীয় খাবার খেতে খেতে যখন আরো বেশি দেশের খাবারের কথা মনে পড়ছিলো। তখন হঠাৎ রাস্তায় পেয়ে যাই শ্রীলঙ্কার এক দোকান যেখানে পরোটা আর প্রচণ্ড ঝাল দিয়ে রান্না করা মুরগির মাংস বিক্রি হয়। পেট ভরে খেয়ে নিলাম। মনে হচ্ছিলো ঢাকার নীলক্ষেতে খাচ্ছি!

এক ক্যাফেতে কফি অর্ডার করতে গিয়েছি তখন দোকানি জিজ্ঞেস করলো দোকানে বসে খাবো কিনা। আমি ভাবলাম এটা কোনো প্রশ্ন হলো! পরে জানতে পারলাম বসে খেলে তার জন্য আলাদা টাকা দিতে হবে, আর দাঁড়িয়ে কিংবা সঙ্গে করে নিয়ে গেলে অতিরিক্ত টাকা দিতে হবে না। হায়রে প্যারিস, আমরা ঢাকা শহরে দোকানে বসে ১০ টাকার চা খেয়ে কতো সময় যে ব্যয় করি তার কি কেউ হিসাব রাখে!

প্রথমবার যখন প্যারিস গিয়েছিলাম তখন মূল শহর থেকে একটু বাইরে এক পুরনো সস্তা হোটেলে উঠেছিলাম। আমার বিছানার উপরে আরো দুইটা বিছানা ছিল। বুঝতেই পারছেন অবস্থা। তবে দূরত্ব যতই হোক, ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকলে এসব কোনো বিষয় না। যেমন সকালবেলা হোটেল থেকে বের হয়ে ট্রামে করে চলে গিয়েছিলাম আইফেল টাওয়ারের কাছে।

ভালোবাসার শহরে বারবার যেতে ইচ্ছে করে। ফরাসি ভাষায় প্যারিসকে বলতে ইচ্ছে করে- ‘ম্যাক্সি বকু’, মানে অনেক ধন্যবাদ। ‘জতেম প্যারিস’ মানে আমি তোমাকে ভালোবাসি প্যারিস।

লেখক: পর্যটক ও গবেষক

ইমেইল : debashisemp@gmail.com

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!